April 20, 2024, 12:16 pm


সামি

Published:
2018-05-06 22:26:24 BdST

বহুজাতিক কোম্পানির রাজস্ব কেলেঙ্কারি১৪ কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ


এফটি বাংলা

বাংলাদেশে কর্মরত বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নজিরবিহীন রাজস্ব কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাজস্ব অনিয়ম ও রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে।

অথচ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তালিকায় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানকারী হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু তদন্তে এসব কোম্পানির রাজস্ব অনিয়মের চাঞ্চল্যকর ঘটনায় এনবিআর বিব্রত। অভিযোগ প্রমাণিত হলেও ফাঁকি দেয়া অর্থ আদায় করা যাচ্ছে না।

যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সার্বিক রাজস্ব আদায়ে। সন্দেহ করা হচ্ছে, রাজস্ব ফাঁকির মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত বিপুল অর্থের বেশির ভাগই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। তদন্ত অনুযায়ী, অনিয়মের শীর্ষে আছে গ্রামীণফোন এবং ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ লি. (বিএটিবি)।

অথচ দীর্ঘদিন ধরেই এ দুটি প্রতিষ্ঠান দেশের সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানকারী হিসেবে বিবেচিত। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এনবিআরের দায়িত্বশীল সূত্র স্বীকার করেছে, সর্বোচ্চ অঙ্কের রাজস্ব দিয়েও অভিযুক্ত ১৪ বহুজাতিক কোম্পানি সেরা করদাতার সম্মান থেকে বঞ্চিত। আয়কর ও ভ্যাট- কোনো খাতেই এসব কোম্পানিকে সম্মান দেয়া যাচ্ছে না।

অপবাদের বোঝা কাঁধে নিয়ে তারা কলঙ্কিত হলেও অনিয়ম থামছে না। প্রতি বছরই অভিযুক্ত কোম্পানিগুলোর নতুন নতুন অনিয়ম আর ফাঁকি উদ্ঘাটিত হচ্ছে।

জানা গেছে, অভিযুক্ত ১৪ বহুজাতিক কোম্পানিই মূল্য সংযোজন কর বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (ভ্যাট এলটিইউ) নিয়ন্ত্রণে। একাধিক তদন্ত এবং নিরীক্ষায় দেখা গেছে, বিএটিবি, গ্রামীণফোনসহ অধিকাংশ নামিদামি বহুজাতিক কোম্পানিই দেশের সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির সঙ্গে জড়িত।

আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়েই রাজস্ব অনিয়ম বেশি উদঘাটিত হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের আইনি জটিলতায় এ বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আদায় হচ্ছে না।

উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ায় আইনি জটিলতায় বকেয়া আদায় বিলম্বিত হচ্ছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বহুমুখী প্রতারণা, জালিয়াতি, উৎপাদন ও বিক্রি কম দেখানো, কাগজপত্রে মিথ্যা তথ্য এবং ঘোষণা প্রদান, অবৈধ রেয়াত নেয়াসহ নানা কায়দায় রাজস্ব ফাঁকি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এলটিইউ সূত্র জানায়, সরকার প্রতি বছরই সর্বোচ্চ আয়কর এবং ভ্যাট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা পদক দিয়ে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী অভিযুক্ত কোম্পানিগুলোর এ পদক পাওয়ার কথা।

কিন্তু এ কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এসব বহুজাতিক কোম্পানি। তারা এ পুরস্কার দাবিও করছে না। সুনাম বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অবজ্ঞা করে অতিরিক্ত মুনাফা এবং সরকারকে ফাঁকি দেয়াই এসব কোম্পানির লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অথচ দেশ সেরা ও সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানকারী হিসেবে সম্মান পাচ্ছে তুলনামূলক অখ্যাত এবং কম রাজস্ব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো, যা বিব্রতকর। আইনে রাজস্ব অনিয়মে জড়িত হলে এবং এজন্য সরকারের পাওনা পরিশোধ না করার দুর্নাম থাকলে রাষ্ট্রীয় এ সম্মাননা পাওয়ার সুযোগ নেই।

সূত্র মতে, এলটিইউর একাধিক তদন্তে ১৪টি বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকির গুরুতর অনিয়ম প্রমাণিত হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, সরকারের কোষাগারে পাওনা রাজস্ব জমা না দেয়ায় ফাঁকি দেয়া অর্থ প্রকারান্তরে আত্মসাতেরই নামান্তর।

এখন এ অর্থ কিভাবে সরকারের কোষাগারে ফেরত আনা যায় তা নিয়ে গলদঘর্ম সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ভ্যাট আইনে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবিলম্বে বকেয়া পরিশোধে দাবিনামা এবং চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হয়েছে।

কিন্তু তারা এতে কর্ণপাত করেনি, উল্টো উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়ে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব প্রদানে বিলম্ব করছে। এলটিইউ কর্তৃপক্ষের দাবি, এখন পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ফাঁকি ৯ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলেও তা আদায় করা যাচ্ছে না। এ জন্য লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের শীর্ষ রাজস্ব প্রদানকারী ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ লি. (বিএটিবি)। যুক্তরাজ্যভিত্তিক এ বহুজাতিক কোম্পানিটি গত বছর প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পরিশোধ করে।

এরপরই আরেক বহুজাতিক কোম্পানি গ্রামীণফোনের অবস্থান। দেশের শীর্ষ এ মোবাইল ফোন কোম্পানি রাজস্ব দিয়েছে ২ হাজার ৩শ’ কোটি টাকা। কিন্তু এ দুটি প্রতিষ্ঠানই সর্বোচ্চ অঙ্কের রাজস্ব অনিয়ম আর ফাঁকির দায়ে অভিযুক্ত।

এর মধ্যে বিএটিবির বিরুদ্ধে একাধিক অনিয়ম মামলায় ২ হাজার ৪২১ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে উচ্চ এবং মধ্যম মূল্যস্তরের সিগারেটকে নিু মূল্যস্তরের অসত্য ঘোষণা প্রদান এবং ঘোষণার অতিরিক্ত উপকরণ থেকে পণ্য তৈরি করে সম্পূরক শুল্ক এবং ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়েছে।

এ ছাড়া গ্রামীণ ফোনের বিরুদ্ধে রিপ্লেসমেন্ট সিমকার্ড ইস্যুর নামে গ্রাহকের কাছে নতুন সিমকার্ড বিক্রয়ের মাধ্যমে ১ হাজার ২৩ কোটি টাকা, গ্রাহক সংখ্যা কম দেখিয়ে সিম বিক্রয়ের তথ্য গোপন করে ৭৩০ কোটি ২৮ লাখ টাকা, সরবরাহকৃত সিমকার্ডের ওপর প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক এবং ভ্যাট হিসেবে ৪৫২ কোটি ৫৩ লাখ টাকার রাজস্বসহ এ পর্যন্ত ১৮টি অনিয়মের মামলায় ফাঁকির পরিমাণ হচ্ছে ৩ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। ভ্যাট কর্তৃপক্ষের দাবি, দুটি বহুজাতিক কোম্পানির এসব অনিয়ম উদঘাটিত ও প্রমাণিত। কিন্তু বাস্তব অনিয়ম আরও অনেক বেশি বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

এ ছাড়া মোবাইল অপারেটর বাংলালিংক ৬১৮ কোটি টাকা, রবি ১ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। অন্য বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ২২ কোটি টাকা, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট (বাংলাদেশ) লিমিটেড ১২২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, বাটা শু কোং বাংলাদেশ ৩৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা, হোলসিম বিডি লিমিটেড ২০ কোটি ৩২ লাখ টাকা, নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেড ১০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, সানোফি এভেন্টিস (বাংলাদেশ) লিমিটেড ৩৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা, এইচএসবিসি ৯ কোটি টাকা এবং নিউজিল্যান্ড মিল্ক প্রো. (বাংলাদেশ) লি. ৫৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে বলে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো রাজস্ব ফাঁকি দেয় না- এমন ধারণা ছিল প্রতিষ্ঠিত। রাজস্ব অনিয়মের সব দায় এতদিন ছিল দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। কিন্তু সেই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে নজিরবিহীন রাজস্ব জালিয়াতি আর অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে এসব নামিদামি কোম্পানি।

ভ্যাট এলটিইউর কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, অডিট হলেই বহুজাতিকের অনিয়ম ধরা পড়ছে। আগে এসব কোম্পানির ওপর তেমন নজরদারি ছিল না। কিন্তু এখন প্রতি বছরই যেভাবে রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটিত হচ্ছে তাতে আশঙ্কা অতীতে এসব কোম্পানি এর অনেকগুণ ফাঁকি দিয়েছে, যা অজানা।

শুধু তাই নয়, নামিদামি এসব কোম্পানিকে অনেকবার সতর্ক করা হয়েছে। ভ্যাট আইনে পাওনা অর্থ আদায়ে দাবিনামা জারি, অর্থদণ্ডসহ বিভিন্ন আইনি পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও ফাঁকি থামছে না। প্রতি বছরই নতুন নতুন কায়দায় এসব বহুজাতিকের রাজস্ব অনিয়ম বেড়ে চলেছে বলে দাবি ভ্যাট কর্তৃপক্ষের।

ধারণা করা হচ্ছে, রাজস্ব ফাঁকির এ বিপুল অংকের অর্থ বিদেশে মূল বিনিয়োগকারীদের কাছে পাচার করা হয়েছে। যদিও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তা স্বীকার করছে না। তাদের দাবি, এসব অভিযোগ বিতর্কিত। যদিও ভ্যাট কর্তৃপক্ষ সরকারের বকেয়া আদায়ে কোম্পানিগুলোকে একাধিকবার দাবিনামা জারি করেছে।

নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফাঁকি দেয়া অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এ দাবিনামা অগ্রাহ্য করে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে, যা এখন বিচারাধীন।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা