March 29, 2024, 4:15 am


আবু তাহের বাপ্পা

Published:
2019-12-08 04:12:21 BdST

ঢাকায় খরচ বেশি বলে কলকাতা-কলম্বোমুখি রপ্তানিকারকরাবিমানের পন্য পরিবহন ব্যবসায় ধস


এফটি বাংলা

হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে পণ্য রপ্তানিতে ব্যয়বহুল হওয়ায় সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের জন্য কলকাতা ও কলম্বো বিমানবন্দরের দিকে ঝুঁকছেন দেশের রপ্তানিকারকরা। ফলে আকাশপথে কার্গো বা পণ্য পরিবহনের বাজার হারাতে বসেছে বাংলাদেশ।

একই সঙ্গে কার্গো পরিবহন ও হ্যান্ডলিং খাতে আয়ও কমে গেছে বাংলাদেশ বিমানের। এজন্য বিমানের বাড়তি ভাড়া ও শাহজালাল বিমান বন্দরের স্ক্যানিং ও গ্রাউড হ্যান্ডলিংয়ের অতিরিক্ত চার্জকে দায়ী করছেন আকাশপথে পণ্য পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে দেশের যে পরিমান পন্য রপ্তানি হতো কার্গো পরিবহনের মাধ্যমে শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে, সম্প্রতি সেগুলো যাচ্ছে বেনাপোল হয়ে কলকাতা বিমানবন্দর দিয়ে। কিছু পণ্য যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে কলম্বো বিমানবন্দর দিয়ে। ফলে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিগত ৪ মাসে গেল বছরের একই সময়ের চেয়ে বিমানের কার্গো পরিবহন কমেছে ৩ হাজার ২৩৬ টন। এর প্রভাব পড়ছে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়েও। ফলে আয় কমেছে ৭৩ কোটি টাকা। এজন্য প্রতিবেশী দেশের অসম বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতাকে দায়ী করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে মালামাল পরিবহন করে বিশ্বের বড় বড় এয়ারলাইন্স। এর মধ্যে এমিরেটস, কাতার, কুয়েত, ইতিহাদ, মালয়েশিয়া, সাউদিয়া, এয়ার অ্যারাবিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, চায়না ও ওমান এয়ারলাইন্স অন্যতম।

খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, এটি আমাদের জন্য খারাপ খবর। আমাদের প্রচুর পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করতে হয়। সাধারণত সমুদ্র পথে ব্যর্থ হলে বিমানেই পণ্য পাঠাতে হয়। বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ কার্গো সরাসরি রপ্তানি হয়, তা থেকে মাসে কমপক্ষে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতো বিমান বাংলাদেশ। কিন্তু দেশীয় উদ্যোক্তারা অন্য দেশের বিমান বন্দর ব্যবহার করলে সেই আয় থেকেও বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ।

বিমান সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, বিমানবন্দরে আয়ের বড় খাত কার্গো পরিবহন। সেবা বাড়িয়ে পণ্য পরিবহনে উৎসাহিত করা এবং রাজস্ব আয় কিভাবে বাড়ানো যায় সেই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। উন্নত মানের সেবা দিতে গিয়ে চার্জ কিছুটা বেশি পড়লেও সুযোগ সুবিধার কোন অভাব নেই। তবে তিনি বলেন, প্রতিবেশীরা যে দামে পাচ্ছে সে দামেই কার্গোগুলো বহন করছে।

তবে ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারদের দাবি, শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহনের খরচ তুলনামূলক বেশি। রয়েছে অবকাঠামো সমস্যাও।

রপ্তানিকারকদের মতে, প্রথমত স্কেনিং চার্জ, দ্বিতীয়ত হ্যান্ডলিং চার্জ সব মিলিয়ে বাংলাদেশে খরচ হয় ১৮-২০ সেন্ট ইউএস ডলারের মত, কলকাতা বা কলম্বোতে ১২ সেন্টে হয়ে যায়।

যুক্তরাজ্যে নিয়মিত পোশাক রপ্তানি করেন মাহিনুর ইসলাম। তিনি জানান, সমুদ্রপথে যখন ক্রেতার কাছে নিদিষ্ট সময়ে পণ্য পাঠানো যায় না, তখন বাধ্য হয়ে আকাশ পথে পাঠাতে হয়। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে সমুদ্রপথে ক্রেতার কাছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি চালান রপ্তানি করতে ব্যর্থ হলে পরে চালানটি আকাশপথে পাঠাতে বাধ্য হয়।

প্রথমে ৫ হাজার কেজির পোশাকের চালানটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে পাঠাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সময় ও খরচ কমের কথা ভেবে পরে তিনি কলকাতা বিমানবন্দরের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করেন। কারণ ঢাকার চেয়ে তার কাছে কলকাতা বিমানবন্দর দিয়ে পণ্য পাঠাতে প্রতি কেজি ৩০ সেন্ট বা ২৫ টাকা ৫০ পয়সা কম খরচ হয়েছে।

শুধু মাহিনুর একা নয় এমন অনেক পোশাক ও বিভিন্ন ব্যবসায়ী যারা কলকাতা এয়ারপোর্টের মাধ্যমে তাদের পণ্য পরিবহন করেন। এতে শুধু ব্যয় কমানো নয় সময় এবং পণ্য পরিবহন চার্জ এবং পর্যাপ্ত জায়গা ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। যেটা ঢাকা এয়ারপোর্টে নেই বলে মন্তব্য করেন মাহিন।

সূত্র জানায়, কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করলে রপ্তানিকারকরা কমপক্ষে ৫ ঘণ্টা সময় বাঁচাতে পারে।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার এসোসিয়েশনের (বিএএফএফএ) পরিচালক (ইনচার্জ পোর্ট অ্যান্ড কাস্টমস, ঢাকা) সৈয়দ মো. বখতিয়ার বলেন, সাধারণত ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি ইউরোপে পণ্য রপ্তানিতে প্রতি কেজিতে ২ থেকে ২.২০ ডলার খরচ পড়ে। তার ওপর রপ্তানিকারকদের প্রতিকেজিতে বিমান বাংলাদেশের টার্মিনাল হ্যান্ডেলিং চার্জ বাবদ ৮ সেন্ট এবং সিভিল অভিয়েশন অথরিটি অফ বাংলাদেশকে (সিএএবি) বিভিন্ন সিকিউরিটি স্ক্যানিং চার্জ বাবদ ৬ সেন্ট দিতে হয়। সংগঠনটির তথ্য অনুসারে, কার্গোতে পণ্য পরিবহন করতে গেলে ২ সেন্ড দিতে হয়।

বখতিয়ার বলেন, এই চার্জ হার সিঙ্গাপুর থেকেও অনেক ব্যয়বহুল। তার মতে, ঢাকা হচ্ছে পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় ব্যয়বহুল পণ্য পরিবহন এয়ারপোর্ট।

অন্যদিকে কলকাতায় খরচ অনেক কম। এখানে টার্মিনাল হ্যান্ডেলিং এবং সিকিউরিটি স্ক্যানিং চার্জ বাবদ ৪ সেন্ট দিতে হয়।

সূত্র জানায়, এ সব ব্যয় বাদেও বিভিন্ন নামে-বেনামে কার্গোতে পণ্য পরিবহনের জন্য অলিখিত চার্জ বা ঘুষ দিতে হয় একজন রপ্তানিকারককে। ফলে কলকাতার মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করলে ২৫% খরচ কম হয়।

তাদের মতে, শুধু এখানেই শেষ নয়, চার্জ পরিশোধ করার পরও ঢাকা এয়ারপোর্টে মাঝে মাঝে অদক্ষ লোকদের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করা হয়। অনেক সময় মালামাল হারিয়েও যায়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস হচ্ছে কার্গো নিয়ন্ত্রণের একমাত্র স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠান। কিন্তু অবকাঠামো এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা মূলক কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে সিএএবি।

বখতিয়ার বলেন, বাংলাদেশ বিমান বন্দরের কার্গো পরিবহন এলাকাটি অনেক ছোট যার কারণে অনেক সময় পণ্যকে খোলা আকাশের নিচে রেখে দিতে হয়। ফলে মাঝে মধ্যেই চুরির মতো ঘটনা ঘটে। পণ্যের মান নষ্ট হয়।

রপ্তানিকারকরা জানান, প্রতি মাসে এই আকাশপথে আড়াই হাজার টন পোশক রপ্তানি হয়। ভরা মৌসুমে এর পরিমাণ আরো বাড়ে।

বাংলাদেশ এক্সপোর্টার এসোসিয়েশনের (বিইএ) সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিশ্বের যেকোনো বিমানবন্দরের চেয়ে আমাদের বিমানবন্দরের হ্যান্ডেলিং চার্জ কয়েক গুন বেশি। আমরা যখন সমুদ্রেপথে ব্যর্থ হই। তখন আকাশপথের কথা চিন্তা করি। যেহেতু আমাদের বিকল্প নেই তাই বিমানবন্দরে মনোপলি ব্যবসা করে একটি গ্রুপ। এ কারণে ব্যয়টা বেশি পড়ে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজ নামে যে জায়গা আছে তা বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। আর সব খানে অব্যবস্থাপনায় ভরপুর। এসবের সংস্কার প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, বর্তমানে শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সুবিধা আন্তর্জাতিক মানের নয়। বাণিজ্য সুবিধার ক্ষমতা অপর্যাপ্ত। আমদানি করা কাঁচামাল খোলা অবস্থায় রাখা হয়।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, সত্যিকার অর্থে আমাদের বিমানবন্দরে সঠিক কার্গো ভিলেজ নেই। এই কার্গো এলাকাটির অবকাঠামোও নিম্নমানের ও পুরানো। এ ছাড়া প্রতি বছর এয়ার কার্গোর চাহিদা ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু জায়গাটি বাড়েনি বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৬ হাজার টন কার্গো পরিবহন হয়। এই সময় কার্গো পরিবহন ও হ্যান্ডলিং করে আয় করেছে ৬৯৬ কোটি টাকা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০ হাজার ৮৬ টন কার্গো পরিবহন করে ১৯৭ কোটি টাকা আয় হয়েছে।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা