04/14/2025
নেহাল আহমেদ, কবি ও সাংবাদিক | Published: 2025-04-09 09:31:57
শিশুদের জ্যোতির্ময় এক জগৎ সৃষ্টি করতে চেযেছিলেন এক বাঙালি যার অনন্য সৃষ্টি 'হাট্টিমাটিম টিম' কবিতা।
হাট্টিমা টিম টিম। তারা মাঠে পাড়ে ডিম, তাদের খাড়া দুটো শিং, তারা হাট্টিমা টিম টিম। এই ছড়াটি জানেন না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিলই বটে। মোটামুটি কথা ফুটলেই বাঙালি শিশুদের যে কয়েকটি ছড়া কণ্ঠস্থ করানো হয়, তার মধ্যে এটি একটি।
কিন্তু জানেন কি? এই ছড়াটি মোটেই চার লাইনের নয়।রোকনুজ্জামান খানের লেখা একটি ৫২ লাইনের সম্পূর্ণ ছড়া এটি। যদিও কেউ কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন।
বরেণ্য লেখক, সাংবাদিক ও শিশু সংগঠক রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের শততম জন্মদিন আজ। এই উপলক্ষে রাজধানীর নারিন্দায় আলোচনা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। তিনি ১৯২৫ সালে ৯ এপ্রিল রাজবাড়ী জেলার পাংশায় জন্মগ্রহণ করেন।
রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাই কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, সওগাত ও বেগম পত্রিকার পরিচালক ও দৈনিক ইত্তেফাকের ফিচার এডিটর ছিলেন। তিনি হাট্টিমা টিম টিম, খোকন খোকন ডাক পাড়ি, আজব হলেও গুজব নয় গ্রন্থের প্রণেতা।
আজ দাদাভাই নেই কিন্তু তাঁর মেধা ও বিবেক যে কত মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন, তিনি শিশুদের মনে স্বপ্ন প্রোথিত করতে পেরেছিলেন। তার ছড়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তিনি শিশুদের স্বপ্ন দেখাতে পারতেন। তিনি স্বপ্নের জগতে নিয়ে যেতে পারতেন।
শিশু-কিশোরদের চিত্তবৃত্তির উন্মেষ ও সহজাত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে তাদের প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা ও দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে দাদাভাই আমৃত্যু ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে গেছেন। পরবর্তীকালে সেই গুণী মানুষগুলো আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
আজকে দেশ জুড়ে যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বরেণ্য অথবা সম্মানের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন নিজ নিজ পেশায়; বিশেষ করে সাহিত্যক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বরেণ্য ব্যক্তিরা কোনো না কোনোভাবে সান্নিধ্য পেয়েছেন এই গুণী মানুষটির।
আজ যারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত, সাহিত্যে অবদান যাদের অনস্বীকার্য এমন হাজারো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সততা ও নিষ্ঠার সাথে এখনও অনেক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, দাদাভাইকে আজ আর কেউ স্মরণ করেন না। যারা তাঁকে অবহেলা করছেন তাঁরাই একদিন নিশ্চিহ্ন হবেন। আর দাদাভাই আমাদের মাঝে থাকবেন চিরকাল, চিরদিন, চিরঞ্জীব হয়ে।
রোকনুজ্জামান রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলায় সাহিত্য-সংস্কৃতসমৃদ্ধ একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং অনুরূপ পরিমন্ডলেই তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়। এয়াকুব আলী চৌধুরী ও রওশন আলী চৌধুরী ছিলেন জ্ঞাতি সম্পর্কে তাঁর নানা। তিনি সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের কন্যা নূরজাহান বেগমকে বিয়ে করেন। নূরজাহান সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
রোকনুজ্জামান কলকাতার ইত্তেহাদ (১৯৪৭), শিশু সওগাত (১৯৪৯) ও দৈনিক মিল্লাত (১৯৫১) পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। তিনি ইত্তেহাদের ‘মিতালী মজলিস’ এবং মিল্লাতের ‘কিশোর দুনিয়া’র শিশুপাতা সম্পাদনা করতেন। ১৯৫৫ সালে তিনি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় যোগদান করে ‘দাদাভাই’ ছদ্মনামে শিশুদের পাতা ‘কচি-কাঁচার আসর’ সম্পাদনা শুরু করেন এবং আমৃত্যু এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আর এ থেকেই তিনি ‘দাদাভাই’ নামে দেশব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠেন।
রোকনুজ্জামান নিজে অনেক কবিতা ও ছড়া লিখেছেন এবং শিশুদের লেখা সংশোধন ও সম্পাদনা করে পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। শিশুদের চিত্তবৃত্তির উন্মেষ ও প্রতিভার বিকাশে তিনি নিরলস প্রয়াস চালিয়েছেন। তাঁর সম্পাদিত আমার প্রথম লেখা (১৯৫৭) গ্রন্থে বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক ও লেখকদের সেসব লেখা স্থান পেয়েছে, যেগুলি কচি-কাঁচার পাতায় প্রথম মুদ্রিত হয়েছে।
তাঁর প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থ হচ্ছে হাট্টিমাটিম (১৯৬২), খোকন খোকন ডাক পাড়ি, আজব হলেও গুজব নয় প্রভৃতি। তাঁর সম্পাদিত ঝিকিমিকি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিশুসংকলন। এসব রচনার মাধ্যমে তিনি কোমলমতি শিশুদের মনে নীতিজ্ঞান, দেশপ্রেম ও চারিত্রিক গুণাবলি জাগ্রত করার চেষ্টা করেন। তিনি কচি ও কাঁচা (১৯৬৫) নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন।
রোকনুজ্জামানের অপর একটি বড় অবদান ‘কচি-কাঁচার মেলা’ (১৯৫৬) নামে একটি শিশুসংগঠন প্রতিষ্ঠা। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এর শাখা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকায় এর মূল কেন্দ্র অবস্থিত। সম্প্রতি নোরাডের আর্থিক সহায়তায় সেগুনবাগিচায় এর কেন্দ্রীয় ভবন নির্মিত হয়েছে। এতে শিশুদের গান, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়াও তাদের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য ‘কাকলী পাঠাগার’ স্থাপিত হয়। লক্ষ্য একই দেহে ও মনে শিশুদের সৎ ও আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। তিনি বাঙালি সংস্কৃতি লালন করতেন বলে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা কচি-কাঁচার মেলার অফিস ভাংচুর করে এবং বইপত্র পুড়িয়ে দেয়।
রোকনুজ্জামান খান সৃজনশীল ও সাংগঠনিক কর্মের পুরস্কারস্বরূপ বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৮), শিশু একাডেমী পুরস্কার (১৯৯৪), একুশে পদক (১৯৯৮), জসিমউদ্দীন স্বর্ণপদক এবং রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ও রোটারি ফাউন্ডেশন ট্রাস্টির পল হ্যারিস ফেলো সম্মানে ভূষিত হন।
ছেলেবুড়ো সবার কাছে যিনি দাদা ভাই নামেই সম্যক পরিচিত ছিলেন। মানুষ গড়ার কারিগর দাদা ভাই গড়তেই ভালোবাসতেন তাই গড়তেই শিখেছিলেন। অন্য কোন লোভ-লালসা, পদমর্যাদা, অর্থ-বিত্ত তাঁকে কখনও স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান ছিল একটি শিশুকে কিভাবে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলা যায়। শিশুদের চিত্তবৃত্তির উন্মেষ ও প্রতিভার বিকাশে তিনি নিরলস প্রয়াস চালিয়েছেন।
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81