08/04/2025
শাহীন আবদুল বারী | Published: 2025-08-04 15:28:10
২০২৪ সালে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দলের নেতাকর্মীদের মাঠে নামিয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এটা কোন নতুন খবর নয়। গত এক বছরে এই বিষয়ে কোথাও কোন কৃতিত্ব দাবী করেননি তারেক রহমান। দেশব্যাপী এটাই এখন আলোচ্য বিষয়। চলমান রাজনীতিতে কৃতিত্ব নেয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্ম। তারেক রহমান সেটা না করে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দিয়েছেন ছাত্র-জনতা ও আপামর জনসাধারণকে। এখানেই তারেক রহমান এগিয়ে আছেন সবার থেকে।
বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের বক্তব্য ও তারেক রহমানের বক্তব্যের ধরনের মাঝে রয়েছে আসমান-জমিন তফাৎ। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে ভাষায় বা যে ইঙ্গিত করে কথা বলেন দলের অনেক নেতারা হয়ত তা ধরতে পারেন না। দলের নেতাকর্মীরা কোথায় কি করছেন তাও খবর রাখছেন। বিভিন্ন ভাবে কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে যেমন যোগাযোগ রাখছেন, তেমনি মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথেও যোগাযোগ অটুট রেখেছেন তারেক রহমান। অনেকটা বাবার আদর্শকে ধরে রাখার আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যেসব নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উঠছে তা বারন করার চেষ্টাও করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন অভিযোগে গিয়াস কাদের চৌধুরী সহ অনেক নেতাকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। তারেক রহমানকে আগ বাড়িয়ে অনেক নেতা কথা বলতে গিয়েও আগের মতো সুবিধা করতে পারছেন না। অত্যন্ত বিচক্ষণতা এবং বিনয়ের সঙ্গে কথা বলেন তারেক রহমান। প্রতিটি কথা ঠোঁট থেকে ছাড়ার আগে চুলচেড়া বিশ্লেষণ করেন জননন্দিত নেতা তারেক রহমান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তারেক রহমান নিজেকে বর্তমান সময়ে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। পেয়েছেন ভবিষ্যৎ নতুন বাংলাদেশ গড়ার নীরব সমর্থন। ৩১- দফা নিয়ে আর দেশের বিভাগীয় পর্যায়ে জনসমাবেশ গুলোতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সরাসরি বা কোনভাবেই আন্দোলন সংগ্রামের এ বিজয়কে দলের একক কৃতিত্ব দাবী করেননি তারেক রহমান। তিনি এ বিজয়কে সামষ্টিক অর্জন হিসেবে তুলে ধরেছেন বার বার। গত বছরের ৫ আগষ্টের অর্জন ও বিজয়কে সংহত করতেও তাৎক্ষনিক কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। তারেক রহমান বলেছেন, 'প্রতিশোধ নেয়া কোন রাজনীতিবিদদের কাজ নয়।' এখনো এ কথার ওপর ভিত্তি করে আছেন তিনি। বিছিন্ন কিছু ঘটনায় দলের কিছু নেতা-কর্মীর জড়িত থাকার কথা প্রকাশ হওয়ার পর দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছেন। শোনা যায়, দোষী ও চিহ্নিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি ঘটনাস্থলের বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতাদের তিরস্কার করেছেন রূঢ় ভাষায়। দ্বিতীয়বার এমন ঘটনার অবতারণা হলে পদ হারানোর মতো কঠোর সতর্কবানী শোনানো হয়েছে নেতাদের। এতে স্থানীয় নেতারা পড়েছেন বিপাকে। কর্মী সামলাবেন না সংগঠন গোছাবেন-এমন উভ সংকটে রয়েছেন নেতৃবৃন্দ। তবে দলের কিছু সিনিয়র নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে যারা এখনো রাজনীতি বহির্ভূত সমাজ ও আইন বিরোধী কর্মকান্ডে নিজেদের জড়িত রেখেছেন তাদের জন্য সামনে শাস্তির নানা খড়গ ঝুলছে। আম-ছালা উভয়ই হারানোর শংকায় চিহ্নিতরা। তবে এই দুষ্টু চক্রকে নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে মাঠ পর্যায়ে বড়ো ধরনের ক্ষতি হবে। কার্যত কেউ স্বীকার না করলেও দলের সবাই জানেন দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে থানা-ওয়ার্ড পর্যন্ত প্রতিটি নেতা-কর্মীর বিভিন্ন কর্মকান্ডের ফিরিস্তি লিপিবদ্ধ করা হয় নানা কৌশলে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্তির সময় এই ফিরিস্তিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
ওয়ান ইলেভেন থেকে গত বছরের ৫ আগষ্ট পর্যন্ত তারেক রহমান নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, অসংখ্য সাজানো মামলার আসামী হয়েছেন। তার -অনুপস্থিতিতে বিচার হয়েছে, সাজা দেয়া হয়েছে, বার বার আবেদন করেও পাসপোর্ট পাননি, অরাজনৈতিক ব্যক্তি হয়েও তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধেও মামলার আসামী করা হয়েছিল। মৃত ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোকে নিয়ে নোংরা ভাষায় কথা বলা হয়েছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় ৫ আগস্টের পর একটি বারও তারেক রহমান কোন প্রতিহিংসামূলক বক্তব্য দেননি। কারো বিরুদ্ধে কোন বিষোদগার করেননি।
গত সাড়ে ১৬ বছরে তাঁর বিরুদ্ধে যত খবর প্রচার ও প্রকাশ হয়েছে স্বাভাবিক কারনেই সেসবের প্রতিবাদ জানানোর কথা। মানুষের সহমর্মিতা আদায় করার কথা। কিন্ত তিনি কোন জবাব দেননি। মিথ্যা অভিযোগ-অপবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেননি। তবে বার বার বলছেন, দলের নেতা-কর্মীদের মামলা- হামলা, জেল- জুলুম ও গুম-খুনের কথা। বিচার চেয়েছেন এসব ঘটনার। পতিত সরকারের সীমাহীন দুর্নীতির বিচারও চেয়েছেন অসংখ্য বার। কিন্তু কোথাও কোন কর্মসূচীতে নিজের ওপর, তার পরিবারের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক কোন শব্দ উচ্চারণ করেননি তারেক রহমান। তাঁর এ ভূমিকা নিশ্চয়ই প্রমান করে তারেক রহমান এখন আর ২০০১-২০০৬'র চেনা মানুষটি নন, একজন পরিপূর্ণ ও পরিনত রাজনীতিবিদ হিসেবে হাজির হয়েছেন জাতির সামনে। নিজেকে তৈরি করেছেন এক ভিন্ন ভাবমূর্তিতে। একই সময় জাতির সামনে একক নেতৃত্বের সুযোগও চলে আসছে তারেক রহমানের সামনে। জাতীয় নাগরিক পার্টি - এনসিপি' গত ২৮ ফেব্রুয়ারী দল ঘোষনার আগ থেকে কথা চালাচালি করছে। রাজনৈতিক মঞ্চে যতোই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠকরা সমালোচনা বা রক্ত চক্ষু প্রদর্শন করুক না কেন, তারেক রহমান ঠিকই তাদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদরা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনর নেতাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, 'কোটা আন্দোলনের শুরু থেকেই লন্ডনে যোগাযোগ রক্ষা ও সময় সময় আন্দোলনের গতি প্রকৃতি নিয়ে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে কথা বলেছেন ছাত্র নেতারা।' সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন। তারেক রহমান হয়ত অনুধাবন করেছেন ফ্যাসিবাদ উৎখাতের সেই যুদ্ধের শেষ বাঁশিটা যে ছাত্ররাই বাজিয়েছিল। ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে উত্তাল সময়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে ৩ আগস্ট একদফার ঘোষনা দিয়েছিল এই সাহসী তরুণেরা। ৪ আগস্ট হঠাৎ করেই 'মার্চ টু ঢাকা' একদিন এগিয়ে আনা হলো। পতন তরান্বিত হলো ফ্যাসিস্ট সরকারের। এ সবই ছিল পরিকল্পিত কর্মসূচি। এটা অস্বীকার করার জো নেই যে, সেদিন পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার ব্যানারে। তারেক রহমান ছিলেন অদৃশ্যের চালিকাশক্তি।
তারেক রহমানের এই ভূমিকাকে একদিকে যেমন বলা যায় রাষ্ট্রনায়কসুলভ আচরণ, তেমনি বিজয়ী ছাত্রদের ইস্পাত-দৃঢ় ঐক্য হার না মানার শপথ। এই যুগলবন্দীই দেশকে দিয়েছে নতুন সূর্য।
২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান নিয়ে নানা আঙ্গিকে গবেষণা হচ্ছে। তবে সবকিছু নিয়েই জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান এক ঐতিহাসিক সময়োচিত সিদ্ধান্ত। ইতিহাস সবার ভূমিকাকে যার যার মর্যাদায় স্থান দিবে নিশ্চয়ই। তা না হলে যুগে যুগে প্রতিবাদ-বিপ্লব হতেই থাকবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, ওয়ান ইলেভেনের দুই বছর এবং আওয়ামী দুঃশাসনের সাড়ে ১৫ বছরে অনেকটাই কোনঠাসা ছিল বিএনপি । নেতা-কর্মীদেরদের মামলা-মকদ্দমা দিয়ে হয়রানি, ঘুম-খুনের শেষ ছিলনা। সরকারের কিছু পা-চাটা প্রশাসনের লোকজন খালি করেছে হাজার হাজার মায়ের বুক। প্রশাসনের নির্মম পাষণ্ডতায় এতিম হয়েছে হাজার হাজার শিশু সন্তান। তাদের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠলেও মন গলেনি নিষ্ঠুর পাষণ্ডদের। বাবাকে ফিরে পেতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গিয়েও ফেরত তো পায়ইনি উপরন্তু মিথ্যা নাটক করা হয়েছে। বিএনপিকে রাজধানী সহ দেশের কোথাও দিতে হতোনা মিটিং-মিছিল এবং অনুষ্ঠানের অনুমতি। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারম্যান দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মামলা দিয়ে সাজাঁ দিতেও কারপন্ন করেনি পতিত সরকার। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হত্যা মামলা সহ বিভিন্ন মামলায় আসামি করে তাকে করা হয় দেশান্তরী। শুধু তাই নয়, ফখরুদ্দিন-মঈনূদ্দিনের নির্মম নির্যাতনের শিকার হোন তারেক রহমান। নির্যাতন ও মামলার যাতেকলে পড়ে পাড়ি জমান লন্ডনে। সেখান থেকেই দলের হাল ধরেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য পুত্র তারেক রহমান। ওয়ান ইলেভেনের সময় ছোট ভাই আরাফাত রহমান ককোকে হারান। সরকারি ভাবে বরাদ্দকৃত ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের বাসা টিও ছাড়তে বাধ্য করে আওয়ামী সরকার। স্ত্রী জুবায়দা রহমানকেও কৌশলে সরকারি চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। আটকানোর চেষ্টা করা হয় দুদকের জালে। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। কঠিনতম বাস্তবতা এবং নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করে বিএনপি জিয়াউর রহমানের আদর্শের পথে এগুচ্ছে। মাঠ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতা-কর্মীদেরকে চাঁদাবাজি, দখল বাণিজ্য, মারামারি-হাঙ্গামা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
সাংগঠনিকভাবে দল গোছানোর পাশাপাশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে কৌশলী পথে এগোচ্ছে বিএনপি। বিভিন্ন দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলের মতো সরকার ও দল পরিচালনার মধ্যে সীমারেখা টানতে চাইছে বিএনপি। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এমন চিত্র দেখা গিয়েছিল দলের মধ্যে। বিগত ১৭ বছরের ত্যাগী ও পরীক্ষিত সব নেতার মূল্যায়নের চেষ্টা চলছে। বিগত সরকার যে সব ভুল করেছে বিএনপি সে পথে হাটবেনা। তারেক রহমান প্রতিটি মুহুর্ত মনিটরিং করছেন।
সারাদেশে এখন সবচেয়ে বড় দল বিএনপি। এখানে অনেক সুযোগ সন্ধানীরা ঢুকে পড়েছে। আবার দলটির অনেক নেতাকর্মীও বিপথগামী হয়েছে। এটা অভ্যুত্থানের পক্ষে সবদলেই কমবেশি হয়েছে। জামায়াত, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, ইসলামী আনোলনের মতো দলগুলোর উচিত বিএনপিকে গঠনমূলক সমালোচনা করা। আর বিএনপিরও উচিত সমালোচনা ইতিবাচকভাবে নেয়া।
বিএনপি এমন দল যার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সততা সর্বজনবিদিত ছিল। তিনি সৎ লোক খোঁজে এনে দলে নিয়েছেন। মন্ত্রীদের সততা ও যোগ্যতার পরীক্ষা পর্যন্ত নিয়েছেন। তিনি দেশের সমগ্র জাতিগোষ্ঠীকে একীভূত করতে বাঙালীর পরিবর্তে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা দিয়েছেন, একদলীয় থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও অন্তর্ভূক্তিমূলক রাজনীতির সূচনা করেন। উন্নয়ন ও উৎপাদনমুখি রাজনীতির জন্য জিয়া ১৯ দফা প্রণয়ন করেন। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে নিজে ঘুরেছেন। বেসরকারি খাতের বিকাশ, কৃষি, শিল্প, পররাষ্ট্রনীতি কোথায় তাঁর পদচারণা ছিল না!
জিয়ার হাতে গড়া দল বিএনপি রাজনীতিতে ইতিবাচক ও গঠনমূলক ধারায় আসলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা কেউ ঠেকাতে পারবে না। আর দলটি অসৎ, সুবিধাবাদী ও সিজনাল রাজনীতিবিদদের কাছে হেরে গেলে বাংলাদেশের আশার জায়গাও অনেক কমে আসবে।
ত্রয়োদশ নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত অদৃশ্য শক্তি এবং বাধা । বহুপক্ষীয় এবং সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে একের পর এক ঘটনায় দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল, বৈরী ও অনিশ্চিত করে তোলা হচ্ছে। করিডর, বন্দর, জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপন, সামরিক মহড়া, আন্তর্জাতিক তৎপরতা ও কথিত জাতীয় ঐক্যের ফাঁদ- সব কিছু মিলিয়ে নির্বাচনের স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত করার কৌশল প্রকট হয়ে উঠছে। কিছু অদৃশ্য শক্তি দেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে নিতে মরিয়া। তাদের লক্ষ্য একটি 'নিয়ন্ত্রিত', 'নির্বাচনবিহীন' শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া। যারা রাজনৈতিক পরিবেশকে ঘোলা করে 'নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে' পুনরায় একটি তথাকথিত অন্তবর্তী সময় তৈরি করার পরিকল্পনায় এগোচ্ছে। জাতীয় নিরাপত্তার নতুন ন্যারেটিভ এবং বিদেশি স্বার্থ জড়িত একটি চক্র সক্রিয়ভাবে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত। উদ্দেশ্য স্পষ্ট- নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া, জনগণের রায়কে পাশ কাটানো এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে রুদ্ধ করা। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ যখন নিজের ভাগ্য নিজে গড়তে চায়, তখন তা পরাশক্তির জন্য হয়ে ওঠে এক অস্বস্তিকর বার্তা। স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। একটি আত্মমর্যাদাশীল, স্বাধীনচেতা, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে উঠলে, তা শুধু এ অঞ্চলের নয়, তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের জন্যে অনুপ্রেরনা হয়ে উঠতে পারে- যা পরাশক্তির আধিপত্যবাদে বড় আঘাত। এ দেশে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বকে বারবার নির্মূল করার চক্রান্ত হয়েছে। রাষ্ট্রনায়কদের হত্যা, অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক সংকট ও অস্থিরতা সবকিছুর পেছনে রয়েছে বিদেশি স্বার্থ আর দেশীয় দালালদের চক্রান্ত। যখন বাংলাদেশ আজ্ঞাবহ থাকে, তখন তেমন বাধা আসে না। কিন্তু যখন কেউ সত্যিকারের স্বাধীনতার কথা বলে, গণতন্ত্র ও স্বাধীন সার্বভৌম পররাষ্ট্রনীতির কথা বলে তখন শুরু হয়, তাকে থামিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র, চরিত্রহনন, অর্থনৈতিক চাপ, কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থ শিক্ষার্থী, শ্রমিক, পেশাজীবী, মধ্যবিত্ত- সব শ্রেণির মানুষের মিলিত চেতনার ফসল। বিএনপি, জামায়াতসহ কিছু দল গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় থাকলেও বেশিরভাগ প্যাডসর্বস্ব রাজনৈতিক দল ছিল নিষ্ক্রিয়। এখন এই দলগুলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশ নিচ্ছে, কিন্তু তাদের প্রতিনিধিরা অপরিচিত, সাংগঠনিক ভিত্তিও দুর্বল।
গণঅভ্যুথানে যারা রক্ত দিয়েছেন, নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তাদের জন্য কোনো সুবিচার হয়নি। আহতদের সুচিকিৎসা হয়নি, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ক্ষতিপূরণ পায়নি। বরং বিচারহীনতার সংস্কৃতি আগের চেয়েও গভীর হয়েছে। গুম-খুনের ধরন পাল্টেছে, কিন্তু নির্মমতা পাল্টায়নি। প্রশাসনে রদবদল হয়েছে, পোশাক বদলেছে, কিন্তু চরিত্র বদলায়নি। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন গুলোতে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রে একটি ভয়-ভীতির সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়। ভোট দিতে না পারা, প্রার্থী হতে না পারা, স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে না পারার যে ভয়, সেই ভয় আবার ফিরছে। মানুষের মুখ বন্ধ, চোখ নিভে গেছে, প্রতিবাদ লোপ পেয়েছে। এই অন্ধকারে আবারও ফিরে যেতে চায় না কেউ। গণতন্ত্রের প্রাণ হলো- জনগণের ভোটাধিকার। জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রকৃত মালিক। বৈধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া কোনো সরকার জনগণের আস্থা পায় না। ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সরকার ও সংসদ জনগণের কাছে জবাবদিহি করে। নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু সরকার নির্বাচন হয় না, বরং দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য ন্যায়বিচার, অধিকার ও উন্নয়নের পথও পরিষ্কার হয়। নির্বাচন পেছানো মানে জনগণের সঙ্গে আরেক দফা প্রতারণা।
গণঅভ্যুথানের রক্ত, আত্মত্যাগ ও চেতনাকে অবমূল্যায়ন করা। জনগণ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করেছিল, কিন্তু সেই আশা আজ অনিশ্চয়তায় বুঝুলে আছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্পষ্টভাবে বলেছেন, নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচনই একমাত্র বিকল্প।' তিনি বিশ্বাস করেন, একটি নির্বাচিত সরকারই পারে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু সরকার এখন আগে নির্বাচন না আগে সংস্কার'- এই অজুহাতে ভোট পেছানোর ফাঁদে ফেলতে চাইছে। গণমানুষ চায় ভোটাধিকার ফিরুক, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। তারা চায় নির্বাচনের মাধ্যমে এমন একটি সরকার আসুক, যাদের প্রতি তাদের আস্থা থাকবে। কিন্তু এক বছর পার হলেও অন্তর্বর্তী সরকার এসব বিষয়ে কার্যকর কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। চব্বিশের গণঅভ্যুথানের মূল অর্জন হতে পারত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বচন ও গণভিত্তিক সরকার। তার বদলে এসেছে প্রতিনিধিত্বহীন সরকার ও অস্পষ্ট ভবিষ্যৎ। এখন নির্বাচন পেছানো মানে হবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু। এটি সেই স্বৈরাচারী ধারার ধারাবাহিকতা, যেখান থেকে জনগণ মুক্তি চেয়েছিল। তাই নির্বাচন পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। জনগণ প্রস্তুত, তারা আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। অবিলম্বে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে- এটাই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। তা না হলে গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য জনগণের দীর্ঘ সংগ্রাম ব্যর্থ হয়ে যাবে। এখনই সময়, নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের, জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সংলাপের মাধ্যমে প্রকৃত ঐকমত্য নয়, বরং কোনো একটি মহলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য থাকলেও 'সংস্কারের পর নির্বাচন' দাবিকে ঘিরে বিভক্তি সৃষ্টি হয়। বিশ্লেষকরা বলেন, এই সংলাপ দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ এবং সেই দলের দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই। কমিশনের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সবসময় একটি দলের প্রস্তাবই থাকে। এর বাইরে যেতে চায় না তারা। মূল উদ্দেশ্য হলো, ধাপে ধাপে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের দাবিতে রাজি করানো। ছাত্র-জনতার অভ্যুথানের পর জনগণ আশা করেছিল, এবার একটি স্বচ্ছ, বৈষম্যহীন ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সেই আশার প্রতিফলন ছিল ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন, যার লক্ষ্য ছিল সত্যিকারের গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। তবে শুরু থেকেই এই সরকার একপাক্ষিকতার কারণে আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। সরকারি সহযোগিতায় আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এনসিপি দেশের সাধারণ মানুষের চাওয়া, জীবনযাপন ও সংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেনি। দলাদলি, সিদ্ধান্তহীনতা ও তৃণমূল থেকে বিচ্ছিন্নতা তাদের জনপ্রিয়তা কমিয়েছে। তারা 'ব্র্যান্ডিং পলিটিকসে' আটকে গেছে ভাবনা আছে, কিন্তু শক্তি নেই। বক্তব্য আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। একাধিক ইস্যুতে বাংলাদেশ জটিল ভূরাজনৈতিক চাপ মোকাবিলা করছে।
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81