12/02/2025
ড. ফয়েজ উদ্দিন এমবিই | Published: 2025-12-02 19:24:32
বাংলাদেশের স্বাধীনতা–পরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাসে যে কয়টি নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত, সময়ের পরীক্ষায় যারা সবচেয়ে প্রভাবশালী, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি শুধু বাংলাদেশ নয়—সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার নারী নেতৃত্বের ইতিহাসেও এক উজ্জ্বল নাম।
গৃহবধূ জীবন থেকে রাষ্ট্রনেতায় উত্তরণ, দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই, তিনবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন, কারাবাস এবং কারামুক্তির পর তার বর্তমান বাস্তবতা—সবকিছু মিলিয়ে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অমর অধ্যায়।
আজকের প্রতিবেদনে তার গৃহবধূ জীবন থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উত্থান, কারাবরণ, কারামুক্তির পরবর্তী পরিস্থিতি এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট—সব কিছুকে সমন্বিতভাবে তুলে ধরা হলো।
জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবে বেগম জিয়ার জীবন ছিল নীরব গৃহজীবনমুখী। সংসার, সন্তান এবং পারিবারিক পরিমণ্ডলই ছিল তাঁর প্রধান জগৎ। তিনি কোনোভাবেই প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক চরিত্র ছিলেন না। কিন্তু ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড তার সমগ্র জীবনধারা পরিবর্তন করে দেয়। ব্যক্তিগত শোকের গভীরতা, রাষ্ট্রিক বিপর্যয় এবং রাজনৈতিক সংকট—সবকিছু একত্রে তাকে জাতীয় রাজনীতির সামনে এগিয়ে আসতে বাধ্য করে।
এই সময়ে বিএনপি নেতৃত্বের সংকটে পড়ে। দলের প্রতি আবেগ, স্বামীর রাজনৈতিক আদর্শ এবং দলের নেতাকর্মীদের অনুরোধ—সব মিলিয়ে তিনি রাজনীতির মঞ্চে নীরব গৃহবধূর চরিত্র থেকে ধীরে ধীরে পরিণত হন এক দৃঢ়চেতা নেত্রীতে। তার এই উত্তরণ শুধু রাজনৈতিক ইতিহাসেই গুরুত্ব বহন করে না—এটি দক্ষিণ এশিয়ার নারী নেতৃত্বে এক অসাধারণ পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির বিজয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার প্রথম শাসনকাল। পরবর্তীতে ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে তিনি আরও দু’বার সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পান। তার নেতৃত্বে—
• বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার
• অর্থনৈতিক সংস্কার
• আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং
• আঞ্চলিক সহযোগিতার নানা উদ্যোগ
উল্লেখযোগ্যভাবে অগ্রসর হয়।
তার নেতৃত্বের সাহসী দিক ছিল রাজনৈতিক সংগঠন শক্তিশালী রাখা, বিরূপ পরিস্থিতিতেও দলকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক মহলে নিজের অবস্থান দৃঢ়ভাবে জানানো। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার নাম উচ্চারিত হয় নারী নেতৃত্বের প্রধান উদাহরণ হিসেবে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেগম জিয়া: কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে এক স্বতন্ত্র অবস্থান
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা, বিশেষ করে সার্ক–এর কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, প্রতিবেশী দেশসমূহ এবং বৈশ্বিক কূটনীতিক মহলে তার পরিচিতি দ্রুত প্রসার পায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে—
• আন্তর্জাতিক সংলাপে তার অবস্থান ছিল দৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী
• বহুপাক্ষিক সম্পর্ক স্থাপনে তিনি সাফল্য দেখান,
• উন্নয়ন সহযোগিতা অর্জনে তার কূটনৈতিক দক্ষতা প্রশংসিত হয়।
তিনি কেবল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; তিনি দক্ষিণ এশিয়ার নারী নেতৃত্বের একটি শক্তিশালী প্রতীক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হন।
২০১৮ সালে আদালতের রায়ে দণ্ডিত হয়ে বেগম জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়। এটি ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় এবং কঠিন অধ্যায়। বিরোধী রাজনীতি, রাজনৈতিক উত্তেজনা, বিতর্ক ও আইনগত প্রক্রিয়া—সব মিলিয়ে তাঁর কারাবাস জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
কারাগারে তার শারীরিক অবস্থা অবনতি লাভ করতে থাকে। দীর্ঘ চিকিৎসার প্রয়োজন, বয়সজনিত জটিলতা এবং স্বাস্থ্যগত দুর্বলতা তার জীবনে নতুন বাস্তবতা তৈরি করে। মানবিক বিবেচনায় সরকার পরবর্তীতে তাঁর সাজার কার্যকারিতা স্থগিত করে তাকে গৃহে চিকিৎসার সুযোগ দেয়।
কারাবাসের সময়টি ছিল তাঁর জন্য—
• মানসিক চাপের সময়
• কঠোর শারীরিক কষ্টের সময়
• রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও স্থিরতা বজায় রাখার সময়
এই অধ্যায়টি তাঁকে রাজনৈতিকভাবেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে, তবে তাঁর নেতৃত্বের প্রতীকী শক্তি দল ও অনুসারীদের মধ্যে অটুট থাকে।
কারামুক্তির পর তিনি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হতে পারেননি। শারীরিক অবস্থার অবনতি তাঁকে চিকিৎসা ও বিশ্রামেই সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। তবু তিনি আজও বিএনপির নৈতিক ও প্রতীকী নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দু।
পর্যবেক্ষকগণ মনে করেন—
• তিনি সক্রিয় না থাকলেও দল তার নামকে ঘিরে শক্তি পায়,
• তার দীর্ঘ আন্দোলন–সংগ্রাম বিএনপির জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস
• তার নেতৃত্বের স্মৃতি সংগঠনকে প্রভাবিত করে
• তার নীরবতায়ও রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি হয়।
S – Strength (শক্তি)
1. তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিজ্ঞতা
2. দলীয় নেতৃত্বে দীর্ঘস্থায়ী গ্রহণযোগ্যতা
3. জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে তাঁর অবস্থান
W – Weakness (দুর্বলতা)
1. শারীরিক অসুস্থতা রাজনৈতিক কাজে বাধা সৃষ্টি করেছে
2. দীর্ঘদিন সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকা
3. দলীয় সিদ্ধান্তে সরাসরি অংশগ্রহণের সীমাবদ্ধতা
O – Opportunity (সুযোগ)
1. আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মহলে তার অবস্থান বিএনপিকে শক্তিশালী করতে পারে
2. নতুন নেতৃত্ব গঠনের জন্য তার নাম একটি অনুপ্রেরণা
3. রাজনৈতিক পুনর্গঠনে তার উত্তরাধিকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে
T – Threat (হুমকি)
1. স্বাস্থ্যগত জটিলতা তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা
2. দলীয় অভ্যন্তরে নেতৃত্ব পরিবর্তনের চাপ
3. রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অব্যাহত চাপ ও চ্যালেঞ্জ
আজ বেগম খালেদা জিয়া শারীরিক অসুস্থতার কারণে সক্রিয় রাজনীতি থেকে প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তিনি হাসপাতাল এবং গৃহ–চিকিৎসা নির্ভর জীবন কাটাচ্ছেন। তবু তিনি এখনও দেশ রাজনীতির আলোচনার একটি কেন্দ্র। তার নাম উচ্চারিত হলে এখনও রাজনৈতিক উত্তাপ সৃষ্টি হয়।
তিনি আজ দলীয় ঐক্য, জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বিশাল অধ্যায়ের এক নীরব প্রতীক।
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক যাত্রা শুধুই একটি ব্যক্তিগত কাহিনি নয়—এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অমূল্য অংশ। গৃহবধূ থেকে জাতীয় নেত্রী, জাতীয় নেত্রী থেকে আন্তর্জাতিক কূটনীতির অংশগ্রহণকারী, এবং কঠিন কারাবাস থেকে বর্তমানে নীরব কিন্তু প্রতীকী নেতৃত্ব—এই প্রতিটি অধ্যায়ই একেকটি সংগ্রামের গল্প।
আজ শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও রাজনৈতিকভাবে তিনি এখনও একটি শক্তি—একটি ইতিহাস, একটি প্রতীক, একটি অধ্যায় যা আগামী প্রজন্মের রাজনীতির মানচিত্রেও প্রভাব ফেলবে।
লেখক একজন বিশিষ্ট কলামিস্ট, মানবাধিকার সংগঠক, আন্তর্জাতিক গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে অবস্থিত নিউ হোপ গ্লোবালের চেয়ারম্যান।
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81