গাজীপুর ফ্যাক্টরির রাস্তা দিয়ে হাঁটার পথে শহরতলীর একটা চায়ের দোকানে কিছু বয়ষ্ক লোককে দেখে চোখ আটকাল। একটু কাছে যাওয়ার, কথা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। ঢাকা শহরে প্রবীণ লোকদের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠে না। যেই ভাবা সেই কাজ। কাছে গিয়ে কথা শুরু করলাম। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে উনাদেরকে বিনীতভাবে চা খাওয়ার অনুরোধ করলাম। একটা ছবি তুললাম উনাদের অনুমতি নিয়ে। উনাদের সবার বয়স প্রায় পঁচাত্তরের উপরে । প্রবীণ মাত্রই গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বের উৎস।
উনাদের সবাই এখনো কৃষিকাজের সাথে জড়িত। এই পৃথিবীতে মানুষমাত্রই কোনো না কোনো দক্ষতার ওপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করে। লক্ষ লক্ষ বিভিন্ন ধরনের দক্ষতার মধ্যে আদিম অথচ এখনো গুরুত্বের দিক দিয়ে প্রথমদিকের গুটিকয়েক দক্ষতার অন্যতম হলো কৃষিকাজ। সহজ কথায় চাষাবাদ। আমাদের সার্বিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় এই দক্ষতা এখন পর্যন্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। আমি যে বিশ্বাস ও বোধ নিয়ে চলি তার জন্য আমার কাছে উনারা খুবই সম্মানিত এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া শতশত বছরের পূর্বসূরীদের অভিজ্ঞতার সাথে আধুনিক কৃষি জ্ঞানের মিশেলে উনারা অনেক মূল্যবান দক্ষতার অধিকারী। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক সময়েও এ দক্ষতা অতুলনীয়। ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের দেশে এই দক্ষতা প্রজন্ম পরম্পরায় বহমান। কথায় কথায় জানতে চাইলাম, আপনাদের এই দক্ষতা আপনাদের ছেলেমেয়েরা কেমন শিখতেছে?
উনারা উত্তর দিলেন আমাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতাছে, ওরা আর কৃষিকাজে আগ্রহী না। এই মহামূল্যবান দক্ষতা - জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য দক্ষতা এই প্রজন্মেই হারিয়ে যাচ্ছে দেখে, আমি এই জাতি-রাষ্ট্রের অন্ধকার ভবিষ্যৎ ভাবনায় একপ্রকার শংকিত ও যারপরনাই অবাক হলাম।
উনাদের সন্তানরা কোন দক্ষতার উপরে জীবিকা নির্বাহ করবে এই ব্যাপারে উনাদের কিছুটা ধারণা নিলাম। এই প্রবীণ সহজ সরল গুণি প্রজন্ম বিশ্বাসই করে না যে সন্তানেরা যেই মানের লেখাপড়া করছে তা দিয়ে এই পৃথিবীতে জীবিকা নির্বাহ করা খুবই কঠিন হবে।
আমার ভাবনায় যা আছে তা হলো- যেকোনো ধরনের দক্ষতায় বিশেষায়িত শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতা প্রয়োজন হয়। কখনো শারীরিক সক্ষমতা; আবার কখনো মানসিক সক্ষমতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমাদের দেশের কৃষি সংস্কৃতিতে শারীরিক সক্ষমতা ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজে সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে ধীরে ধীরে পূর্ণতা পেয়ে থাকে। কোনো একাডেমিক ডিগ্রিতে কেউ এক বছর, দুই বছর, তিন বছর মেয়াদেও এসকল সক্ষমতা অর্জনে সক্ষম হবে না বলেই আমি মনে করি।
কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যারাত অবধি গ্রীষ্মের প্রখর উত্তাপে যেমন কাজ করতে হয়, তেমনি বর্ষায় অঝরধারার বৃষ্টির মধ্যেও কাজ করতে হয়।
শারীরিক সক্ষমতার পাশাপাশি আধুনিক কৃষি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত
জ্ঞানের কার্যকর প্রয়োগেই কেবল একজন সফল কৃষক হয়ে ওঠে।
জমি তৈরি, বীজ নির্বাচন, ফসল উৎপাদন, ফসল উত্তোলন, ফসল সংরক্ষণ, সর্বোপরি বিক্রির ব্যবস্থা করা পর্যন্ত অনেক ধরনের জ্ঞানের কার্যকর প্রয়োগের মধ্য দিয়ে একজন কৃষককে যেতে হয়। খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, দেশে কৃষকের দক্ষতাকে আমরা বিভিন্ন কারখানাগুলোর শ্রমিকের দক্ষতার সাথেই তুলনা করে অভ্যস্ত।
দক্ষতা পরিমাপ করার বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে। আমি বিশ্বাস করি যদি কেউ সত্যিকার অর্থে কৃষকের শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতার প্রয়োজনীয়তাটা সঠিকভাবে উপলব্ধি করে, তার বহুমাত্রিক ফসল উৎপাদনের সক্ষমতাকে নিরূপণ করে দক্ষতার সূচক তৈরি করা হলে অবাক হওয়ার মতো একটা সূচক পাওয়া যাবে বলেই আমার বিশ্বাস।
নানা ধরনের কারখানায় উৎপাদনের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, প্রচলিত সূচকে মাপা দক্ষতার থেকে বহু বহু গুণ বেশি কৃষকের দক্ষতার সূচক পাওয়া যাবে। এত দক্ষতাসম্পন্ন একটা মানুষকে আমরা যেভাবে অবিচার করে চলছি তার জীবনমান আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে তার প্রতিফল আমরা জাতি হিসেবে শীঘ্রই পেতে যাচ্ছি । শিক্ষিত ভূমিহীন অনুৎপাদনশীল, বন্ধ্যা একটা প্রজন্মের আগমনের মাধ্যমে।
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81