29801

10/17/2025

মহাত্মা লালন বনাম মহাত্মা গান্ধী: উপাধির উৎস ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

নেহাল আহমেদ, কবি ও সাংবাদিক | Published: 2025-10-16 12:44:10

ভারত উপমহাদেশে “মহাত্মা” শব্দটি কেবল একটি উপাধি নয়—এটি মানবতার এক চূড়ান্ত স্বীকৃতি, এক নৈতিক জ্যোতিস্বরূপ নাম। কিন্তু ইতিহাসে এই উপাধির প্রথম প্রাপক কে—তা নিয়ে আজও গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়ে গেছে।

ইতিহাসের আলোকেই দেখা যায়, “মহাত্মা” উপাধি প্রথম প্রয়োগিত হয়েছিল বাংলার আধ্যাত্মিক সাধক লালন ফকিরের ক্ষেত্রে—গান্ধীর প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে।

লালন শাহ, মহাত্মা লালন, বাউল সম্রাট, মরমি সাধক, লালন ফকির, গুরুজি -এমন অনেক নামে পরিচিত তিনি। তবে শিষ্যদের কাছে তিনি কেবলই ‘সাঁইজি’। লালন জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ, গোত্রের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানুষ ও মানবতাকে বড় করে দেখেছেন। শুধু জাত-পাতের বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিলেন না, সামাজিক অনাচার, বিভেদ বৈষম্য এবং সামন্ত শোষণের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এমনই এক বিস্ময়কর ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ছিলেন লালন সাঁই।

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য যখন অস্তমিত, ইংরেজদের শাসনে দিশেহারা উপমহাদেশের জনগণ, গ্রামীণ সমাজ ধর্ম জাত-পাত ইত্যাদি নানা সমস্যায় জর্জরিত- বাঙালির জীবনের ওই ক্রান্তিকালে ১৭৭৪ সালের এই দিন লালন ফকিরের আর্বিভাব ঘটে। তিনি চেয়েছিলেন একটি জাত ধর্ম বর্ণ গোত্রহীন সমাজ গড়ে তুলতে। সবকিছুর ওপরে তিনি স্থান দিয়েছিলেন মানবতাবাদকে।

ঊনবিংশ শতকের বাংলায় লালন ছিলেন মানুষের ধর্মের সাধক। তাঁর গানে বারবার ফিরে আসে—

“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”

বাঙালিদের ঐতিহ্য ও গৌরবের বিষয় হচ্ছে- বাংলা ভাষা, বাংলাসংস্কৃতি, বাউল সম্প্রদায়, বাউল গান সবই। আর বাঙালির এই গৌরবের ইতিহাসের গোড়াপত্তন করেন লালন সাঁই। গান্ধীরও ২৫ বছর আগে ভারত উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ‘মহাত্মা’ উপাধি পাওয়া লালনের গান ও দর্শনের দ্বারা অনেক বিশ্বখ্যাত কবি, সাহিত্যিকরাও প্রভাবিত হয়েছেন।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের দর্শনে প্রভাবিত হয়ে ১৫০টি গান রচনা করেন। রবি ঠাকুরই লালনকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। লালনের দর্শনে প্রভাবিত হয়েছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আমেরিকান কবি এলেন গিন্সবার্গের রচনাবলীতেও লালনের দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে।

লালন সংগীত ও দর্শন নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা গবেষণা হয়েছে এবং এই ধারা এখনও চলছে। দেশ-বিদেশের বহু ভক্ত গবেষণা করছেন, কীভাবে সাধারণ এক ব্যক্তি এমন কালজয়ী গান লিখে গেছেন? স্বশিক্ষিত লালন তাইতো গবেষকদের কাছে এক বিস্ময়ের নাম।

ভক্ত ও অনুসারীরা তখন থেকেই তাঁকে “মহাত্মা লালন শাহ” বা “মহাত্মা লালন ফকির” বলে সম্বোধন করতেন। এই নামটি পরে ছড়িয়ে পড়ে বাউল সমাজ, গবেষণা গ্রন্থ এবং সাহিত্যিক পরিসর জুড়ে। কিছু গবেষণা ও বই (যেমন Mahātmā Lālana Phakira শিরোনামের কাজ) এই ঐতিহাসিক উপাধির প্রয়োগকে নথিভুক্ত করেছে।

বাংলাদেশসহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে লালনের গান বেশ জনপ্রিয়। শ্রোতার পছন্দ অনুসারে বিবিসির করা সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় লালনের "খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়" গানটিও রয়েছে।

অন্যদিকে, মহাত্মা গান্ধীর ক্ষেত্রে “মহাত্মা” উপাধিটি জনপ্রিয় হয় বিশ শতকের গোড়ার দিকে। অনেকে মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম তাঁকে এই নামে অভিহিত করেন ১৯১৫ সালের দিকে। আবার কেউ কেউ বলেন, গুজরাটের সাংবাদিক নাওটমলাল মীঠা-ই প্রথম “মহাত্মা” শব্দটি গান্ধীর জন্য ব্যবহার করেন। যেভাবেই হোক, গান্ধীর অহিংস আন্দোলন ও বিশ্বমঞ্চে তাঁর নৈতিক নেতৃত্বের কারণে “মহাত্মা” উপাধিটি আন্তর্জাতিক মর্যাদা পায়।

লালন ছিলেন আত্মার মুক্তির সাধক, গান্ধী ছিলেন সমাজের মুক্তির পথিক। একজন মানুষকে ঈশ্বররূপে দেখেছেন, অন্যজন মানুষকেই স্বাধীনতার দেবালয়ে দাঁড় করিয়েছেন। দু’জনের দর্শন ভিন্ন হলেও তাঁদের লক্ষ্য এক—মানবতার মুক্তি, আত্মার জাগরণ।

ইতিহাসের নিরিখে বলা যায়, “মহাত্মা” উপাধির প্রথম ব্যবহার দেখা যায় বাংলার লালন ফকিরের ক্ষেত্রে; কিন্তু বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পায় গান্ধীর মাধ্যমে।

একজন আধ্যাত্মিক আলোকবর্তিকা, অন্যজন রাজনৈতিক নৈতিকতার দিশারি— তবু দু’জনেরই মূল সুর এক, মানুষের মধ্যে ঈশ্বর খোঁজা।


Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman

Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81