29910

10/28/2025

ফ্যাসিবাদের রাহুল কবলে পূবালী ব্যাংক

বিশেষ প্রতিবেদক | Published: 2025-10-27 18:57:04

ফ্যাসিবাদের রাহুমুক্ত হয়নি দেশের অন্যতম বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পূবালী ব্যাংক। এক সময় সরকারের মালিকানায় থাকা এই ব্যাংকটির শাখা উপশাখা সারাদেশে বিস্তৃত। চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের পর আর্থিক বিভিন্ন খাতসহ অনেক জায়গায় সংস্কার হলেও পূবালী ব্যাংক রয়ে গেছে একেবারেই ব্যাতিক্রম। ব্যাংকটি রয়ে গেছে ফ্যাসিবাদীদের রাহুর কবলে।

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি হাফিজ আহমেদ মজুমদার, আওয়ামী দোসর ও সাবেক স্বতন্ত্র এমপি একে আজাদ, আওয়ামী লীগের আরেক দোসর মঞ্জুরুর রহমানের নিয়ন্ত্রণেই রয়ে গেছে ব্যাংকটি। তারা পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাবশালী উপদেষ্টা এইচটি ইমামের ভাগ্নি জামাতা মোহাম্মদ আলীকে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও হিসেবে জুলাই বিপ্লবের আগে থেকেই দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে। আর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন মঞ্জুরুর রহমান।

জুলাই বিপ্লবের পরও বিএনপিপন্থী পরিচালক ও অংশীদাররা ব্যাংকে ঢুকতে পারেন নি। তারা নানামুখী চেষ্টার পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের আওয়ামীপন্থী একাধিক গভর্নরের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় নিরপেক্ষ ও বিএনপিপন্থী অংশীদাররা ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদে বসতে পারছেন না। মোহাম্মদ আলী ও মঞ্জুর গংরা ব্যাংকটিতে লুটপাটের রাম রাজত্ব কায়েক করেছে। ডলার কারসাজি, খেলাপী ঋণকে নিয়মিত হিসেবে দেখানো, শেখ হাসিনার লকার থাকার তথ্য গোপন, বিতর্কিত বিভিন্ন গ্রুপকে পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া মোটা অংকের ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এসব ঋণের বেশ কিছু ইতোমধ্যে খেলাপি হয়ে পড়লেও কৌশলে সেগুলোকে রেগুলার দেখানো হচ্ছে। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও এই জাতীয় তথ্য উঠে এসেছে।

ব্যাংকটির শেয়ার হোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পূবালী ব্যাংকের মালিকদের পক্ষ থেকে সাবেক এমপি শফি এ চৌধুরী বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে প্রমাণাদিসহ লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। সেই অভিযোগ তদন্তের জন্য গভর্নর নিজে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. কবির আহম্মদকে দায়িত্ব দেন। কিন্তু কবির আহম্মদ রহস্যজনক কারনে পূবালী ব্যাংকের বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেননি। বরং তিনি প্রত্যক্ষভাবে ফ্যাসিবাদের দোসরদের সহযোগিতা করছেন।

বিষয়টি নিয়ে পূবালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদেরও মধ্যেও ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। কবির আহেম্মদ পূবালী ব্যাংক ইস্যুতে মঞ্জুরুর রহমান ও মোহাম্মদ আলীর কাছ থেকে মোটা অংকের সুবিধা নিয়েছেন বলেও চাউর রয়েছে।

সম্প্রতি ব্যাংকটির পরিচালদের পাশ কাটিয়ে চেয়ারম্যান মঞ্জুর, অংশীদারদের একজন একে আজাদ ও সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের এমপি হাফিজ আহমেদ মজুমদারের মেয়ে পূবালী ব্যাংকের পরিচালক রানা লায়লা হাফিজ মিলে মোহাম্মদ আলীকে পুনরায় এমডি ও সিইও পদে বসানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে সুপারিশ করেন। নিয়ম বহির্ভূতভাবে তার বেতন ধরা হয়েছে মাসে ২৭ লাখ টাকা। এছাড়া ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক শাহদীন মালিক পরপর ৫ বার স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী কোন ব্যক্তি দুই বারের বেশি স্বতন্ত্র পরিচালক থাকতে পারবেন না। অথচ এক্ষেত্রে পূবালী ব্যাংক কোন নিয়মনীতিই অনুসরণ করেনি।

পূবালী ব্যাংকের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতিতে সহযোগিতা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর। ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বিএফআইইউ ব্যাংকটির নানামুখী দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে। কিন্তু ব্যাংকের সুচতুর চেয়ারম্যান ও এমডিসহ সুবিধাভোগী মহল বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পূবালী ব্যাংকের লকারে পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লকারের তথ্য গোপন রাখায় ব্যাংকটির এমডিসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কবীর হোসেন বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পূবালী ব্যাংকের ঋণ খেলাপী পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কার্যত কোন ব্যবস্থা নেননি। বরং তিনি ব্যাংকের দুর্নীতিবাজদের পক্ষে কাজ করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গভর্নর নিজেই কবীর আহমেদ খানের কাছ থেকে আশানূরূপ সহযোগিতা পাচ্ছেন না।

দুদকের অনুসন্ধান

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের ঘনিষ্ঠদের নিয়ে সিন্ডিকেট গঠন করে বেসরকারি পূবালী ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্ড সিইও মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে কমপক্ষে পাঁচ পরিচালকের একটি দুষ্ট চক্র দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটিতে লুটপাট অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দুদক ডলার পাচারসহ বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। দুদক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদারকে।

বিএফআইইউ'র অনুসন্ধান

এদিকে পূবালী ব্যাংকের দুষ্ট চক্রের বিরুদ্ধে পৃথক তদন্ত করেছে বিএফআইইউ। সংস্থাটির একজন যুগ্ম-পরিচালকের নেতৃত্বে ঋণ বিতরণে অনিয়ম, ডলার কারসাজি, অর্থপাচার, নিয়োগে অনিয়ম, বিভিন্ন বন্ধকি সম্পত্তি স্বল্প দামে বিক্রিসহ বিভিন্ন অভিযোগ খতিয়ে দেখছে। এসব তদন্ত ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে বলে এরই মধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ আলী নিজেও বিভিন্ন স্থানে বলে বেড়াচ্ছেন দুদক বা অন্য কোন সংস্থা আমাদের কিছুই করতে পারবে না। আমরা সব ম্যানেজ করে ফেলেছি। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ গ্রাহক ও অংশীদারদের মধ্যেও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

দুদক সূত্র জানায়, ব্যাংকটির সাত শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি। বর্তমান চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান চক্র ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ২৫ লাখ গ্রাহকের আমানতের ১ হাজার ১৪১ কোটি টাকাসহ মোট ৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রতিবেশী একটি দেশের কিছু নাগরিককে উচ্চ পদে মোটা বেতনে চাকরি দেওয়া হয়েছে। যারা ইসকনের লোক হিসেবে পরিচিত। এই সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। অন্যদিকে, মঞ্জুরুর রহমান নিজে, স্ত্রী সুরাইয়া রহমান, মেয়ে আদিবা রহমান, ছেলে জিয়াদ রহমান, অপর মেয়ে সাইকা রহমান ও অনিকা রহমানকে পরিচালক পদে বসিয়েছেন। মঞ্জুরের কন্যা আদিবা রহমানকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদ দিয়েছেন।

তাদের দুর্নীতির বিষয়ে ডেল্টা লাইফের অপর অংশীদার ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের পক্ষে রতন চাকমা বাদী হয়ে রাজধানীর বনানি থানায় মামলা করেছেন। মামলায় আসামীদের বিরুদ্ধে ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্সে নানা কারসাজির মাধ্যমে ৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে।

গত ২৮ নভেম্বর দায়ের করা এই মামলাটির নম্বর ৩৩। আসামীরা নানামুখী প্রভাব খাটিয়ে মামলাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে তাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগও জমা হয়েছে। পাশাপাশি সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও অর্থমন্ত্রণালয় থেকেও তাদের দুর্নীতি অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে অদ্যাবধি তাদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্সের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে মঞ্জুরুর রহমান আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে পূবালী ব্যাংকেও লুটপাট অব্যাহত রাখেন। ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স পূবালী ব্যাংকের শেয়ারধারী হিসেবে পরিচালক হয়েছিলেন মঞ্জুর রহমান। ডেল্টা লাইফের ৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা আত্মসাতের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ডেটাবেজ সার্ভারের গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য মুছে ফেলার অভিযোগ রয়েছে মঞ্জুরুর রহমানে বিরুদ্ধে।

এছাড়া পূবালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদারের বিরুদ্ধেও বিশদ অভিযোগ রয়েছে। তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালে অনিয়ম-জালিয়াতির দায়ে ১০ পরিচালককে সরানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকিং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মঞ্জুরুর রহমানের আগে প্রায় এক যুগ পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ আঁকড়ে ছিলেন। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার জোরে ব্যাংক কোম্পানি আইন আর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন নির্দেশনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কয়েকজন পরিচালক দীর্ঘদিন পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত। ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি হাফিজ আহমেদ মজুমদার বর্তমানে আত্মগোপনে আছেন। এছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান, পরিচালক ফাহিম আহমেদ ফারুক চৌধুরী ও এম কবিরুজ্জামান ইয়াকুবসহ কয়েকজন এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা বলে দুদকে জমা হওয়া নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া খাবিরুজ্জামান ইয়াকুব চান্দ্রা স্পিনিং মিলের নামে শতকোটি আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে।

অভিযোগে আরও বলা হয়, সাবেক এমপি হাফিজ আহমেদ মজুমদার ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্সের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার আগে চেয়ারম্যান ছিলেন মঞ্জুরুর রহমান। তারা দুজনই প্রায় দেড়যুগ ধরে পূবালী ব্যাংক ও ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্সের চেয়ারম্যানের পদ দখল করে লুটপাট ও অর্থ আত্মসাৎ করছেন।

ঋণ বিতরণে অনিয়মসহ নানা বিষয়ে ব্যাংকের অংশীদারদের পক্ষ থেকে একাধিক অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে দেওয়া হয়। গভর্নর ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ কবীর হোসেনকে বিষয়গুলোতে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু কবীর হোসেন কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং পূবালী ব্যাংকের দুর্নতিবাজদের পক্ষ নিয়ে কাজ করছেন। ফলে ব্যাংকির অংশীদার অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক মো. আখতার হোসেন বলেন, অভিযোগ জমা হওয়ার পর আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তিনি মামলার সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করবেন।

পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, একটি পক্ষ ব্যাংকটিকে নানামুখী ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার করছে। দুদকে একটি তদন্ত চলছে। তারা কিছু তথ্য চেয়েছে। আমরা সেগুলো দিচ্ছি।


Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman

Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81