02/24/2025
বিশেষ প্রতিবেদক | Published: 2020-12-18 06:42:44
ডিসেম্বর মাসে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন আমরা এক প্রকার নিশ্চিত ছিলাম যে যুদ্ধে আমরা জয়ী হবোই। যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে একটা ঘটনার উল্লেখ করছি।
অক্টোবর মাসে সারওয়ার মুর্শেদ খানের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানের পক্ষ থেকে চিঠি আসে। এতে ছিল বিমান বাহিনী গঠন করার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র এবং ভারী কামান-গোলার একটা বিশদ বিবরণ কিন্তু এই বিবরণ বা প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের তালিকা খুবই উদ্ভট ছিলো যেহেতু এই সব সংগ্রহ করা ছিলো অসম্ভব এবং এর জন্য যে অর্থের প্রয়োজন হতো তাও আমাদের ছিলো না।
অবশ্য যুদ্ধে ভারত যে আমাদের সাহায্য করবে তা আমরা সহজেই অনুমান করেছিলাম। জুন মাসে বোষ্টনের ফিরোজের উদ্যোগে বেশকিছু কম্যুনিকেশন যন্ত্রপাতি আমরা মুজিব নগরে পাঠাই। বোধ হয় এতেই তাদের ধারণা হয়েছিল যে ভারী অস্ত্রশন্ত্র পাঠাতেও আমরা সক্ষম হব।
নভেম্বরের শেষেই মনে হয়েছিলো যে পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী কিন্তু পাকিস্তান যে সেই যুদ্ধ শুরু করবে এমন নির্বুদ্ধিতার আশংকা আমরা মোটেই করিনি।
যুদ্ধকালীন অবস্থায় কিছু পাকিস্তানী আমাদের মুজিব নগর সরকারের সাথে একটি সমঝোতায় আসতে চেষ্টা করে। তাদের কয়েকজন জানায় যে, এই প্রস্তাব ভুট্টোর মস্তিষ্কপ্রসূত।
তারা বলে, মুজিবকে ছেড়ে দেয়া হবে যদি শেখ মুজিব সরাসরি জাতিসংঘে এসে পূর্ব পাকিস্তানের ভূ-খণ্ড থেকে সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানান এবং তার আহ্বানের ভারত সাড়া দেয়। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় এসে বাঙালিদের সব দাবি মেনে নেবে।
প্রস্তাবটি অত্যন্ত চতুর বলে আমাদের মনে হয়েছিল। আমরা উত্তরে জানাই যে সর্বশক্তি বলতে আমরা ভারত এবং পাকিস্তান উভয়কে বুঝি। ছেড়ে যেতে হলে উভয়কেই যেতে হবে একসাথে। কিন্তু এই আলোচনা সরকারি পর্যায়ে পৌঁছুবার আগেই বন্ধ হয়ে যায়।
১১ই ডিসেম্বর আরেকটি প্রস্তাব নিয়ে পাকিস্তানীরা উপস্থিত হয় এবং সমঝোতার জন্য চাপ দেয়। তারা এই প্রস্তাব পেশ করার জন্য বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি পাকিস্তানীদের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দেন।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে একটি ভীতিপূর্ণ ঘটনা ছিল চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের যাত্রা। আমার বিশ্বাস, যদি কংগ্রেসে ব্যাপারটা ফাঁস না হয়ে যেত তাহলে হয়তো বা সত্যি সত্যি মার্কিন নৌবহর চট্টগ্রামের নিকট এসে যেত।
এ সময় আমরা সবাই ঢাকার অবস্থা নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত ছিলাম। কংগ্রেস সদস্য কোরম্যান কর্তৃক আয়োজিত একটি ভোজসভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। সেখানে এশিয়ার ব্যাপারে নিয়ে গবেষণারত মার্কিন বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশ হয়। সেদিন আমাদের প্রধান চিন্তা ছিল নতুন বাংলাদেশ কেমন হবে, যুদ্ধবিধ্বস্ত ও অত্যাচারে নিপীড়িত জাতিকে কি অবস্থায় আমরা পাব আর কি করে এর পুনর্বাসন করা যাবে।
১৬ তারিখ দেশ স্বাধীন হল এবং ১৮ তারিখে জানতে পারলাম বাংলাদেশের বহু বুদ্ধিজীবীকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। সেদিন আমি ইয়েলে গিয়েছিলাম অধ্যাপক নূরুল ইসলামকে ঢাকার পথে বিদায় দিতে।
বোষ্টনে একদল বাঙালি মার্কিন বন্ধুদের সহায়তায় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক রূপরেখা প্রণয়নে মনোনিবেশ করেন অক্টোবরের দিকে। মহিউদ্দিন খান আলমগীর, হারুনুর রশিদ ভূঁইয়া, মতিলাল পাল এরা এই কাজে অগ্রণী ভূমিকা নেন। অধ্যাপক ডর্ফম্যান ও হার্ভার্ড পপুলেশন সেন্টার এবং অধ্যাপক নূরুল ইসলাম এই উদ্যোগের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিশ্ব ব্যাংকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রতিবেদন এ কাজে আমাদের সাহায্য আসে।
মার্চ মাসেই বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্বন্ধে আমি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম। ইষ্ট পাকিস্তান পরিকল্পনা বিভাগের তৈরি পুনর্গঠন পরিকল্পনাও আমাদের হাতে আসে। এই সবের ওপর ভিত্তি করে আমরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন পরিকল্পনার খসড়া তৈরি করি। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম এই খসড়া নিয়ে বাংলাদেশের পথে পাড়ি দেন স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরেই।
মুজিব নগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব তওফিক ইমামের কাছ থেকে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ পরিকল্পনা বোর্ড স্থাপনের খবর পাই। বোর্ডে যোগদানের জন্য অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, আনিসুর রহমান ও হারুনুর রশীদের প্রতি আহ্বানও আসে। এই প্রসঙ্গে খাদ্য ও দুর্ভিক্ষের ওপর সিনেটের রিফিউজী সাব কমিটির জন্য আমাকে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হয়। এই সাব কমিটির জন্য পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমস্যা সম্বন্ধেও আরেকটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করি ডিসেম্বরে। ঐ মাসে বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠোমো সম্বন্ধেও একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করার সুযোগ আমার হয়।
এসব কাজে বিশ্ব ব্যাংক এবং ইউএস এইডের কর্মকর্তাদের সাহায্য ও হারুনুর রশীদের সার্বক্ষণিক সহযোগীতা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি।
মোটামুটিভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য নানা ধরনের প্রস্তুতির প্রয়োজন আমরা বিদেশে থেকেও অনুভব করি এবং তার জন্য কর্যকরী ব্যবস্থা নেই।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, পঞ্চদশ খন্ড (এ এম এ মুহিতের সাক্ষাৎকার)
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81