02/25/2025
সৈয়দ মূসা রেজা | Published: 2021-11-18 08:08:57
‘দারোয়ান’-কে নিয়ে নাকি বেশ চিন্তায় পড়ে গেছেন পরিবেশবাদীরা! তো এই ‘দারোয়ান’ কোন দারোয়ান তা একবার দেখে নেয়া দরকার। তারপর বোঝা যাবে দুশ্চিন্তার স্বরূপ।
ভিনদেশি প্রবাদে বলা হয়েছে, “ঘর রক্ষার জন্য বাগান বানালাম। বাগান রক্ষায় দিলাম বেড়া। বেড়া বাঁচাতে রাখলাম দারোয়ান। এখন এই দারোয়ানকে নিয়েই যত দুশ্চিন্তা!”
বিদ্যুৎ-গাড়ির ব্যাটারি, বায়ুকল, সৌর-তক্তা বা সোলার প্যানেলসহ পরিবেশবান্ধব হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন প্রযুক্তির জন্য চাই অধিক হারে খনিজ পদার্থ। মাটি খুঁড়ে প্রয়োজনীয় পদার্থবের করে আনা বা খনি থেকে পদার্থ আহরণের প্রক্রিয়া কী কখনো পরিবেশবান্ধব হয়ে উঠতে পারবে? এমন প্রশ্নই তুলছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
কেঁচো খুঁড়তে সাপ: খনি খুঁড়তে দূষণ!
কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হয়ে আসার কথা আমাদের কাছে অপরিচিত নয়। তারই সূত্র ধরে বলা যায়, পরিবেশ রক্ষার উপকরণ তুলে আনতে খনি খুঁড়তে যেয়ে দূষণের সাপের ক্ষতির মুখে পড়বে সেই পরিবেশই! অর্থাৎ খনি প্রযুক্তিই এখন পরিবেশ বাদীদের কাছে প্রবাদের সেই 'দুশ্চিন্তার' দারোয়ান’হয়ে দেখা দিয়েছে।
বহুল আলোচিত জলবায়ুর দুষণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে হলে দুনিয়ার দরকার পড়বে আরো নতুন নতুন খনি। এটা অস্বীকার করার জো নেই। ‘ক্লিন এনার্জিস ডারটি সিক্রেট’ শীর্ষক প্রচ্ছদ কাহিনিতে ব্রিটিশ সাপ্তাহিক নিউ সায়েন্টিস্টয়ের ১৩ নভেম্বরের সংখ্যায় বিষয়টি তুলে ধরেছেন গ্রাহামলটন।
অবশ্য, একই সমস্যাকে গত বছর তুলে ধরেন ফরাসি পুরষ্কার-জয়ী সাংবাদিক এবং ফরাসি শীর্ষস্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য তথ্যচিত্র নির্মাতা গিঁয়োপিট্রোন।
নিজের লেখা বই রেয়ারমেটালস ওয়ার- ডার্ক সাইড অব দ্যা এনার্জি অ্যান্ড ডিজিটাল ট্রানজিশন –এ বিষয়টির ওপর আলোকপাত করেন তিনি।
বইয়ের সূচনাই বলা হয়েছে, চার হাজার বছর ধরে মানুষ দুর্গ বানাতে এবং জমিতে কাজ করতে নির্ভর করছে আগুন, অস্থির প্রকৃতির বায়ু ও জলস্রোত, জন এবং অশ্বশক্তির ওপর। সে সময়ে জ্বালানি ছিল দুষ্প্রাপ্য এবং দামি।মানুষের চলাচল ছিল ধীর গতির। সে সময়ে প্রবৃদ্ধিকে চলতে হতো জিরিয়ে জিরিয়ে।
১৮ শতকে এসে এই চালচিত্র বদলে গেল। তাঁত বুনতে, রেলগাড়ি চালাতে এবং সাগরে আধিপত্য বিস্তারে যুদ্ধ জাহাজ ভাসাতে মানুষ বাষ্প ব্যবহারের সূচনা করল। মানুষের প্রথম শিল্প বিপ্লবের শক্তি যোগাল বাষ্প। এভাবেই ঘটল বিশ্বের প্রথম জ্বালানি পরিবর্তন। অপরিহার্য জ্বালানি হয়ে দেখা দিল মাটির তল থেকে আহরিত কৃষ্ণপ্রস্তর। যাকে ডাকা হলো কয়লা নামে। ২০ শতকে জ্বালানি হয়ে ভুবন জয় করল তেল। জীবাশ্ম থেকে কয়লার জন্ম। জন্ম তেলেরও।
কিন্তু জলবায়ুর ওপর জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষতি বন্ধ করতে পরিবেশবান্ধব এবং সবুজ প্রযুক্তি হিসেবে দেখা দিল বায়ু কল, সৌর-তক্তা এবং বিদ্যুৎ-ব্যাটারি। কম কার্বন নির্গমনকারী পরিচ্ছন্ন জ্বালানির নবায়নযোগ্য এই নতুন উৎসের জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হয়ে উঠল বিরল সব খনিজ সম্পদ বা রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস (আরইই)। আরইই-র সংখ্যা মাত্র ১৭ টি।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা বা আইইএ-র বরাত দিয়ে নিউ সায়েন্টিস্ট জানায়, লিথিয়াম, তামা, কোবাল্ট, নিকেল এবং আরইই হলো পরিচ্ছন্ন জ্বালানির জন্য অত্যাবশ্যকীয় খনিজ। ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য নির্গমন বা নেট-জিরো লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এসব খনিজ সম্পদের চাহিদা কতোটা বাড়বে? এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে, বর্তমান এসব খনিজের যে চাহিদা আছে তার চেয়ে ছয় গুণ বেশি বাড়বে। আর জাপানের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব এনভায়রমেন্টাল স্টাডিজ (এনআইইএস) এর হিসাব বলছে, এসবের চাহিদা বাড়বে সাতগুণ।
দ্য নিউ সায়েন্টিস্টের ১৩ নভেম্বর সংখ্যার প্রচ্ছদ
সুখের কথা হলো, দুনিয়ায় এসব খনিজের কোনো ঘাটতি নেই। তারপর ও বড় ‘সমস্যা’থেকেই যাচ্ছে। প্রথমত, মানবজাতির পরিচ্ছন্ন জ্বালানির স্বপ্ন বাস্তবায়নে এসব খনিজকে সময়মত মাটি খুঁড়ে তুলতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে খনিজ সম্পদের যোগান অব্যাহত রাখতে হবে। আর এ কাজটি করতে হবে আরেকদফা পরিবেশনাশী দূষণের দৈত্য-দানোব সৃষ্টি না করেই। সমস্যার সাগর রয়েছে এখানেই।
ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় খনিজ প্রযুক্তির অপরিমেয় উন্নতি ঘটিয়েছে মানুষ। এসত্ত্বেও প্রায় সব খনিজ ধাতুর ক্ষেত্রেই প্রথমেই খনি থেকে নিরেট আকরিক তুলে আনতে হয়। আকরিককে প্রক্রিয়াকরণ মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এতে জন্ম নেয় বিপুল বর্জ্য। খনিজখাত থেকে বছরে ১০০ বিলিয়ন টন বর্জ্য সৃষ্টি হয়। এতো ব্যাপক পরিমাণে বর্জ্য অন্য কোনো খাতে তৈরি করে না মানুষ।
আকরিক আহরণ এবং প্রক্রিয়াকরণেও ব্যয় করতে হয় জ্বালানি। বিশ্বের গ্রিন হাউজ গ্যাসরাজি উৎপাদনের অন্যতম একক বৃহৎ খাত হলো খনিজ শিল্প। ২০১৮ সালে খনিজখাত থেকে ৩.৬ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমন ঘটেছে। অর্থাৎ মানব সৃষ্ট গ্রিনহাউজ গ্যাসের ১০ শতাংশের যোগান দিয়েছে একাই এইখাত!
পরিবেশ এবং সামাজিক খাতে খনির প্রভাব সুনিপুণভাবেই তুলে ধরা হয়েছে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় জানা গেছে, ব্রাজিলের অ্যামাজন অঞ্চলের একটি খনির প্রভাব পড়ছে চার পাশের ৭০কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। খনি থেকে যে বিষাক্ত বর্জ্য উৎপাদিত হয়- এখানে তার কথা বলা হচ্ছে না। বরং খনি থেকে তোলা আকরিক নিয়ে যাওয়ার রাস্তাগুলো, অর্থাৎ খনি প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত অবকাঠামোগুলোর কথাই বলা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনের কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লরাসোন তার একথা জানান।
চাহিদা বাড়ছে, পিছিয়ে পড়ছে যোগান
আইইএ-র হিসাব থেকে আরো জানতে পারি, পেট্রোল গাড়ির তুলনায় বিদ্যুৎ-গাড়ির ছয়গুণ বেশি খনিজ উপাদানের দরকার পড়ে। এই হিসাব থেকে গাড়ি তৈরিতে ব্যবহৃত ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়ামকে বাদ দেওয়া হয়েছে। গ্যাসের একটি বিদ্যুৎ-কেন্দ্রে যে পরিমাণ খনিজ উপাদান লাগে তার চেয়ে ১৩ গুণ বেশি লাগে সমমানের উপকূলীয় একটি বায়ুকলে। নবায়ানযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বেড়েছে। ২০১০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে পরিমাণ খনিজ উপকরণ লেগেছে এখন একারণে তার থেকে ৫০ শতাংশ বেশি লাগছে। কোনো কোনো খনিজের বেলায় চাহিদা বাড়বে কয়েকগুণ। চাহিদার আঙ্গুল রাতারাতি ফুলে কলা এমন কি বটগাছও হতে পারে!
গুরুত্বপূর্ণ এসব ধাতু নিয়ে আইইএ-র উদ্বেগের শেষনেই। চাহিদা ও সরবরাহের বড় ধরণের অমিলের কারণে সামনে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হতেপারে। জীবাশ্ম থেকে সবুজ জ্বালানিতে যাওয়ার জন্য অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে পরিচিত কোনো কোনো খনিজের চাহিদা আকাশছোঁয়া হতে পারে। পরিণামে, জীবাশ্ম জ্বালানি ছেড়ে সবুজ জ্বালানিমুখী দিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুত কর্মকাণ্ডের কোনো গতি থাকবেনা। কিংবা এসব তৎপরতায় ‘বিষফোড়’ হয়ে দেখা দেবে ব্যাপক ব্যয়।
নিউ সায়েন্টিস্ট বলছে, তাদের প্রতিবেদন লেখার সময় লিথিয়ামের দাম মোটামুটি বেড়েছে তিনগুণ। কোবাল্টের বেড়েছে ৬০ শতাংশ। তামার বেড়েছে ২৫ শতাংশ। সববিদ্যুৎ-প্রযুক্তির কাজে তামাকে ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে উল্লেখ করেছে আইএইএ। বিদ্যুৎ বিতরণের তার, ব্যাটারি, সৌর-তক্তাসহ সবধরণের প্রযুক্তিতেই তামাকে পাবো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। উচ্চমানের তামা মজুদের ঘাটতি রয়েছে পৃথিবীতে। এদিকে, ব্যাটারিতে ব্যবহারের উপযুক্ত মানসম্পন্ন নিকেল সরবরাহেও ঘাটতি রয়েছে। পাশাপাশি, রেয়ার আর্থ নিয়েও উদ্বেগকমছেনা। বরংবাড়ছে।
তাহলে বিশ্বে এসবের পর্যাপ্ত মজুদনেই? দাম বাড়ার উপসর্গ কি সে কথাই বলছেনা? না তা ও নয়। ভূত্বকে এসব খনিজের খামতি নেই। বহু বছর থেকে শত শত বছর যোগানের মতো পর্যাপ্ত খনিজ রয়েছে ধরিত্রীতে।
কিন্তু খনি কোম্পানিগুলো ভাবছে অন্য কিছু। তারা আশংকা করছে, জীবাশ্ম জ্বালানি বাদ দিয়ে সবুজ জ্বালানির দিকে মোড় নেওয়ার বা দিক পরিবর্তনের প্রবণতা কতোটা খাটি।
এই উচ্চাভিলাষী কর্ম সূচি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে তো! এর কম সাত পাঁচ ভাবনাই খনিজ মজুদ উত্তোলনে মোটা অর্থ বিনিয়োগের পথআটকে দিচ্ছে।
আর তাই খনি কোম্পানিগুলোকে ভবিষ্যতের বাজারের বিষয় নিশ্চয়তার আভাস দিতে দুনিয়ার সরকার গুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে যে জ্বালানি পরিবর্তনের কার্যক্রম বজায় থাকবে। তাহলেই খনি কোম্পানি গুলো নিজ নিজ তহবিল নিয়ে নামতে ইতস্তত করবেনা।
‘উঠ ছেড়ি তোর বিয়া’ বলে হয়ত বাংলা প্রবাদের বালিকার বিয়ের কাজ সেরে ফেলা যায়। তবে এমন বেদম কর্মসূচি নিয়ে নামলেও নিশ্চিত মজুদের খনির কাজ সেরে ফেলা যায়না।
আইএইএ-র হিসাবে বলা হয়েছে, নিশ্চিত মজুদের খনিজ থেকে সফলভাবে আকরিক তুলতে গেলে সময় লাগবে সাড়ে ১৬ বছর। প্রথম দশক বা তার কাছাকাছি সময় খরচ হবে পরিকল্পনা এবং সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে। এরপর আরো চার থেকে পাঁচ বছর ব্যয় হবে খনি খুঁড়তে এবং অবকাঠামো বানাতে।
তবে পরিকল্পনা প্রণয়নের বা নীল নকশা আঁকার সময় খানিকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। তারপরও আগামী দশকগুলোতে এসব খনিজ উপাদান সরবরাহব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়বে।
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81