02/25/2025
বিশেষ প্রতিবেদক | Published: 2022-01-11 08:33:53
যে কোন দেশের টেকসই অর্থনীতির জন্য সে দেশের বীমা খাতের অবদান অনস্বীকার্য। অর্থনীতির মূল মেরুদন্ড ধরা হয় এই খাতটিকে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের বড় একটি অংশই নির্ভর করে যে কোন দেশের বীমাখাতের স্থিতিশীল পরিস্থিতির উপর।
ব্যাংকিং, আমদানী রপ্তানী, শেয়ারবাজার বা শিল্প বিকাশের পাশাপাশি বিনিয়োগ পুনঃ বিনিয়োগের আর্থিক সার্কেলটি মূলত বীমা নির্ভর। আর এ সব কাজের জন্য বীমা প্রতিষ্ঠানের উপর মানুষের আস্থা ও সূচকের স্থিতিশীলতাকে বিবেচনায় নেয়া হয়।
বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নয়ন অগ্রযাত্রার এই মুহুর্তে বীমা খাতটি একেবারেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়ে গেছে। বলা চলে বীমাখাতটি অদক্ষ, অযোগ্য আর দূর্নীতিবাজদের দখলে চলে গেছে। এখানে দুর্নীতির এক মহা উৎসব চলছে।
সাধারণ বীমার নানা দূর্নীতি, অব্যবস্থাপনাকে পেছনে ফেলে জীবন বীমার শত কাহিনী অর্থখাতের বোদ্ধাদের পাশাপাশি দেশের সাধারণ মানুষকে পর্যন্ত হতবাক করে দিচ্ছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরী করতে যেয়ে আঁতকে ওঠার মতো তথ্য আসতে শুরু করেছে আমাদের হাতে। বীমা খাতের চরম অব্যবস্থাপনা, নৈরাজ্য ও দূর্নীতির পেছনে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ'র আইনী দূর্বলতা, স্বজনপ্রীতি, অনিয়মকে দূষছেন এই খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তা ব্যক্তির অতিলোভ ও আইন ভাঙার প্রবণতার পাশাপাশি দূর্নীতির কারণে সেই সুযোগে অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানীগুলো নির্লজ প্রতারণায় নেমে পড়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কারণেই সকল নিয়ম ভেঙ্গে চলছে জীবন বীমার প্রতিষ্ঠানগুলো। এখানে অর্থনীতির সুশাসনের প্রয়োজনটাই ভুলতে বসেছে সংশ্লিষ্টরা।
কেস স্ট্যাডি- ০১ঃ ফারইস্ট লাইফে লুটপাট
ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লি. এর অনিয়ম, দূর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ইতোমধ্যে পরিচালনা বোর্ড ভেঙ্গে দিয়ে নতুন বোর্ড গঠন করেছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এখানে প্রমাণিত সত্য হিসেবে পরিচালকগণ কোম্পানী থেকে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।
প্রচারিত তথ্যমতে, এই আত্মসাৎ প্রক্রিয়ার সাথে বোর্ডের শীর্ষ ব্যক্তিরা জড়িত। অনুসন্ধ্যানে ফারইস্ট লাইফের অর্থ আত্মসাতের সাথে যাদের নাম উঠে এসেছে তাদের মধ্যে কোম্পানীর সাবেক চেয়ারম্যানদ্বয় এ. এ. খালেক এবং নজরুল ইসলাম ও সেই সময়ে কোম্পানীর অডিট কমিটির চেয়ারম্যান ড. মোশাররফ হোসেন অন্যতম।
ড. মোশাররফ হোসেন বর্তমানে আইডিআরএ'র চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। জানা যায়, ড. মোশাররফ হোসেন ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ফারইস্ট লাইফের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়েই মোটা দাগের দূর্নীতির ঘটনা গুলো ঘটেছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই সমস্ত দূর্নীতির অধিকাংশ দায় একজন ব্যক্তির ঘাড়ে চাপানোর ব্যর্থ এক চেষ্টা করে চলেছেন আইডিআরএ'র চেয়ারম্যান।
নিজের দূর্নীতি যাতে আলোর মুখ না দেখে সেই কারণে তিনি নানাভাবে কোম্পানীটিকেই ধ্বংস করে দেয়ার শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছেন মর্মে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সেই সাথে আত্মসাৎকৃত অর্থের কে কতভাগ শেয়ার নিয়েছেন, কি প্রক্রিয়ায় নিয়েছেনে আর সে অর্থ কে কোথায় বিনিয়োগ করে কি কি সম্পদ নিজেদের বা নিজেদের পরিবারের নামে গড়ে তুলেছেন তার বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে 'দ্যা ইনভেষ্টর' এর অনুসন্ধানে।
আইডিআরএ'র চেয়ারম্যানের নিয়ম ভাঙার কাহিনী বা দূর্নীতি শুধু ফারইস্ট লাইফের বিষয়ে সীমাবদ্ধ নেই। আইন ভেঙ্গে তিনি পুরো বীমা খাতেই এক ধরণের দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর বিনিময়ে তিনি ব্যাপক পরিমাণ অনৈতিক সুযোগ গ্রহণ করে চলেছেন।
এর মধ্যে একটি হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত সিইও দিয়ে চলছে বেশ কিছু বীমা কোম্পানী। বীমা আইন অনুসারে কোন একটি বীমা কোম্পানী তাদের সিইওকে সর্বোচ্চ ৩ মাসের জন্য ভারপ্রাপ্ত রাখতে পারবেন। এরপরও যদি প্রয়োজন হয় তাহলে পরিচালনা বোর্ডের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে ভারপ্রাপ্তের মেয়াদকাল আরো তিনমাস বাড়াতে পারেন। কোন ক্রমেই এর বেশী হতে পারবে না।
কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু বীমা কোম্পানী বছরের পর বছর চলছে ভারপ্রাপ্ত সিইও দিয়ে। এদের অনেকেই আবার বছরের পর বছর ভারপ্রাপ্ত হয়েই চালিয়ে যাচ্ছেন। একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোনো একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সার্বিক দায় নিতে পারেনা। কারণ সে জানে তার আইনগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই সে চেষ্টা করে তার মেয়াদকালে যতটুকু বা যতবেশী সুযোগ নিয়ে বের হয়ে যেতে। আর প্রধান নির্বাহীর এমন মানসিকতা তার অধীনস্ত সবার মাঝেই ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দূর্নীতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পেয়ে যায়।
তথ্য বলছে, এই বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব আইডিআরএ'র চেয়ারম্যানের হলেও তিনি তা না করে প্রতিটি কোম্পানীর সিইওদের কাছে থেকে মাসিক মোটা অংকের আর্থিক সুযোগ নিয়ে বছরের পর বছর কোম্পানীতে সিইওদের ভারপ্রাপ্ত হিসেবে টিকিয়ে রেখেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নিয়মিত মোটা অংকের মাসোহারার লোভে ড. মোশাররফ অবৈধ সিইওদের বৈধতা বজায় রেখে চলেছেন। এতে করে বীমা খাতে সুশাসনের বদলে দূর্নীতির রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
ফারইস্ট লাইফের ১০৬ কোটি টাকা যেভাবে লোপাট হলো
ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদের ২৩৪তম সভায় ফারইস্ট ইসলামী প্রপার্টিজ লি. এর লিয়েনকৃত ঋণ হিসাবভূক্ত করণ করা হয়। এ সভায় বলা হয় ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখের ১৮৬তম বোর্ড সভায় সিদ্ধান্তক্রমে ফারইস্ট ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কো. লি. এর 'এমটিডিআর' লিয়েন রেখে ফারইস্ট ইসলামী প্রপার্টিজ লিমিটেডকে ১০৬,১৯,০০,০০০/ টাকা ঋণ প্রদান এবং ঋণকৃত অর্থ বোর্ডের সিদ্ধান্ত ক্রমে নগদ এবং পে অর্ডারের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে প্রপার্টিজের বিভিন্ন উন্নয়নপ্রকল্পের কাজের নিমিত্তে অগ্রিম প্রদান করা হয়েছিল।
১. এম. এ খালেক ১৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ২. মাহবুব এসোসিয়েটস ৫০ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ৩. ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং ক্পোানী লি. ৩০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, ৪. কেডিসি কনস্ট্রাকসন লি. ৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। মোট ১০৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
কিন্তু টাকা চলে গেলেও সে প্রপার্টিজের কার্যক্রম আর আলোর মুখ দেখেনি। আর প্রদানকৃত টাকা ফেরত দিতে এবং এ কাজের জন্য ব্যাংক মুনাফার টাকা আনুপাতিক হারে সর্বমোট ১১৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা পরিশোধে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু তাও কার্যকর হয়নি। এভাবেই দূর্নীতি চলে। যা অডিট কমিটি জেনেও বিশেষ সুবিধা নিয়ে চেপে যায়।
এ দিকে বীমার বিদ্যমান আইন ভেঙ্গে চলাতেই বর্তমান আইডিআইএ'র চেয়ারম্যানের পছন্দ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে এর মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হচ্ছেন ঠিকই, তাতে বীমা খাতের বারোটা বেজে যাচ্ছে।
যেমন বীমা আইনের ২০১০ এর ৮০(৪) উপধারায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে বীমা কোম্পানীর মুখ্য নির্বাহীর পদটি একাধারে ৩ মাসের বেশী শুন্য থাকার বিধান নেই। যদি বিশেষ কোন কারণে মুখ্য নির্বাহী পদের জন্য সমস্যা দেখা দেয় তাহলে পরিচালণা পর্ষদ সর্বোচ্চ আরো তিন মাসের জন্য মুখ্য নির্বাহী পদটি ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে চালিয়ে নিতে পারেন। এর বাইরে কোন কিছু করার সুযোগ নেই। অথচ সূত্র মতে, এ সময় পর্যন্ত মুখ্য নির্বাহী হিসেবে ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলছে কমপক্ষে ২০টির অধিক কোম্পানী। যাদের অনেকেরই ভারপ্রাপ্তের মেয়াদ বছরও পেরিয়ে গেছে।
আইন অনুয়ায়ী এসব প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগ দেয়ার কথা। কিন্তু প্রশাসক বসলে আইডিআরএ'র চেয়ারম্যানের সুবিধা নেয়ায় সমস্যা হবে তাই নানা কৌশলে তিনি ভারপ্রাপ্তদের রক্ষায় সদা ব্যস্ত থাকেন। সব মিলে কালো বিড়ালের প্রকাশ্য উপস্থিতিতে বীমা খাতের অবস্থা এখন অনেকটাই টলটলায়মান।
(চলবে)
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81