02/25/2025
সিরাজুল আরিফিন | Published: 2022-07-24 23:51:37
মুদ্রাস্ফীতি বা Inflation যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিমাপের এক অন্যতম মাত্রা। কোভিড-১৯ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পর যখন পুরো পৃথিবী জুড়েই নেমে আসে স্থবিরতা, সেই ধাক্কা লাগে অর্থনীতিতেও। সমগ্র বিশ্বেই মুদ্রাস্ফীতির আঘাত কম বেশি দেখা যেতে থাকে।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে আগে একই দামে যে পরিমাণ পণ্য পাওয়া যেতো, যদি পরবর্তীতে তার চেয়ে পরিমাণে কম পাওয়া যায় - সে অবস্থাকে বলা হয় মুদ্রাস্ফীতি।
অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য মুদ্রাস্ফীতি কতোটা প্রয়োজন সেটা নিয়ে বিস্তর আলাপ করা যেতেই পারে। কিন্তু এই মুদ্রাস্ফীতির জন্য ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে যেসব দেশের অর্থনীতিতে ভয়াবহ রকম ধস নেমেছিল, সেগুলো তুলে ধরা হলো এখানে।
গ্রিস, ১৯৪৪
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪৩ সালে, জার্মানরা গ্রিসের দখল নেয়ার সময় থেকেই সেখানে মুদ্রাস্ফীতি দেখা যেতে থাকে। ১৯৪৪ এর অক্টোবরে সেটি বাড়তে বাড়তে দাঁড়ায় মাসিক ১৩,৮০০% এ। মূলত গ্রিসের বাইরে থেকে তাদের সরকার ক্ষমতায় এসে দেশ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার সময়েই এই দুরবস্থার সৃষ্টি হয়। অবস্থা এতোটাই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায় যে প্রতি ৪.৩ দিনে প্রতিটি পণ্যের মূল্য দ্বিগুণ হয়ে যেতো। পরবর্তীতে নভেম্বরে এই মুদ্রাস্ফীতি হয় ১,৬০০%।
তৎকালীন ব্যাংক অব গ্রিসের গভর্নর কাইরিয়াকোস ভারভারেসস এর মতো খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদরাও মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানতে ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে ১৯৪৫ এর যুদ্ধের পর থেকে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ১৯৪৭ এর শুরুতে এসে গ্রিসের অর্থনীতি আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসতে সক্ষম হয়।
জার্মানি, ১৯২৩
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি চলে ওয়েইমার প্রজাতন্ত্রের শাসনাধীনে। ওয়েইমার প্রজাতন্ত্রের শেষের দিকে এসে দেখা দেয় উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি যা প্রতি মাসে ২৯, ৫০০ শতাংশে পোঁছায়। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে প্রতি ৩.৭ দিনে।
প্রচলিত মুদ্রা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে রেন্টেনমার্ক নামক নতুন মুদ্রার প্রচলন করে সেসময় মুদ্রাস্ফীতি থেকে মুক্তি পায় জার্মানি। নতুন মুদ্রার প্রচলন যাতে বাড়তে পারে, এজন্যে আগের প্রচলিত পেপারমার্ক টনে হিসাব করে ময়লা ব্যবস্থাপকদের কাছে পাঠানো হয়েছিল যাতে সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করে আবার কাগজ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এইসব অভিনব প্রচেষ্টাতেই জার্মানির অর্থনীতির চাকা আবার ঘুরে দাঁড়ায়।
যুগোস্লাভিয়া, ১৯৯৪
অধুনা বিলুপ্ত যুগোস্লাভিয়ায় নব্বই এর দশকে দেখা দিয়েছিল অরাজকতা। একদিকে যুদ্ধের প্রভাব, অন্যদিকে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে ভেঙে আলাদা হয়ে যাচ্ছিল স্লাভিক দেশগুলো। সব মিলিয়ে সমাজতান্ত্রিক দেশটিতে ভয়াবহ রকম উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় যা দৈনিক ৬৪.৬ % এবং প্রতি মাসে প্রায় ৩১৩ মিলিয়ন % এ দাঁড়ায়।
যুগোস্লাভিয়ার মুদ্রাস্ফীতির কারণে প্রচলিত মুদ্রা দিনার ব্যবহারে আপত্তি জানাতে থাকেন ব্যবসায়ীরা। জার্মান মার্ক মুদ্রা বেসরকারিভাবে প্রচলিত মুদ্রা হিসেবে চলতে থাকে। গড়ে প্রতি ৩৪ ঘণ্টায় বাজারে থাকা পণ্যের মূল্য দ্বিগুণ হতে থাকে। সরকার নিউ দিনার নামে নতুন মুদ্রা আনার চেষ্টা করে যেখানে ১ নিউ দিনার = ১ মিলিয়ন দিনার, তবুও মুদ্রাস্ফীতি কমানো সম্ভব হচ্ছিল না। পরবর্তীতে নিউ দিনারের পরিবর্তে নিউ নিউ দিনার, সুপার দিনার ইত্যাদি বিভিন্ন ধাপ পেরোয় যুগোস্লাভিয়ার অর্থনীতি।
জিম্বাবুয়ে, ২০০৮
প্রতিদিন বাজারে গিয়েই দেখা যাবে জিনিসের দাম অন্তত দুইগুণ বেড়েছে। এমনটাই হয়েছিল ২০০৮ এ জিম্বাবুয়ের মুদ্রাস্ফীতিতে। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় বাজারের সবকিছুর মূল্য দ্বিগুণ হয়েছিল। মাসিক মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৭.৯৬ ১০১০ % বা ৭৯ বিলিয়ন শতাংশে। অবস্থা এতোটাই বাজে হয়ে যায় যে জিম্বাবুয়ের সরকার সরকারিভাবে এই হাইপারইনফ্লেশন বা উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয়।
১৯৮০ তে স্বাধীন হওয়া জিম্বাবুয়ের অর্থনীতির বেহাল দশার মূল কারণ ছিল তাদের সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। ৯০ এর দশকে ফসলী জমি কৃষককে বাদ দিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণের যে কর্মসূচী হাতে নিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, সেটিই এই অরাজকতার সূচনা করে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা।
২০০৮ এ এসে ৫০ মিলিয়ন জিম্বাবুইয়ান ডলারের মূল্য ছিল মাত্র ১.২০ মার্কিন ডলার। পরবর্তীতে সরকার নতুন মুদ্রা আর না ছাপিয়ে অর্থব্যবস্থায় বিদেশী মুদ্রার মিশেল ঘটিয়ে অবস্থার উত্তরণ ঘটায়।
হাঙ্গেরি, ১৯৪৬
স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি মুদ্রাস্ফীতির দেখা পায় হাঙ্গেরি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই হাঙ্গেরির অর্থনীতি বড় ধরণের ধাক্কা খায়। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৬ সালে দেশটির কৃষিখাত একেবারেই ভেঙে পড়ে। দেখা যায় খাদ্যের অভাব।
একই সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকায় লাগামহীনভাবে রাষ্ট্র ছাপিয়েছে বড় বড় নোট। ১৯৪৬ এ হাঙ্গেরির সবচেয়ে বড় নোট ছিল ১০০ কুইন্টিলিয়ন ( ১০১৮) পেঙ্গোর যা ১৯৪৪ এ ছিল মাত্র ১০০০ পেঙ্গোর।
প্রতি মাসের মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪.১৯১০১৬ শতাংশে, মাত্র ১৫.৬ ঘণ্টায় দ্রব্যমূল্য বেড়ে হয়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ। এতো ভয়ংকর মুদ্রাস্ফীতি সামাল দেয়াটা একরকম অসম্ভব হয়ে যায় হাঙ্গেরির জন্য। অগত্যা হাঙ্গেরিয়ান ফরিন্ট নামে নতুন মুদ্রার প্রচলন ঘটায় সরকার যা সরাসরি সোনা এবং অন্যান্য বিদেশী মুদ্রার সাথে বিনিময়যোগ্য।
সিরাজুল আরিফিন বর্তমানে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81