02/25/2025
আবদুর রহমান আবির | Published: 2022-08-11 07:31:32
ডলারের বাজার উর্ধ্বমুখী হওয়ায় প্রভাব পড়েছে দেশের বীমা খাতে। বিশেষ করে নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছে। এরইমধ্যে কোম্পানিগুলোর নৌ বীমা ব্যবসা অর্ধেকে নেমে এসেছে। অন্যদিকে দেশের বাইরে পুনর্বীমার প্রিমিয়াম ডলারে পরিশোধ করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে কোম্পানিগুলো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি, বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা, মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন এবং ডলারের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কম থাকায় বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং ডলারের দামে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে দেশের খোলাবাজারে ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১১০ টাকা। আর ব্যাংকগুলোতে এর বিনিময় হার প্রায় ৯৫ টাকা।
সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শফিক শামিম বলেন, মেরিন হাল ও এভিয়েশন হাল এর বীমা কভারেজ সাধারণত বড় অংকের হয়, যা বিদেশে পুনর্বীমা করার প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে কিছু কিছু ব্যবসা কিস্তিতে করা যায়। পুনর্বীমা কোম্পানি যদি রাজি হয় তাহলে ৪ বা ৬ কিস্তিতে এমনকি অনেক সময় ৮ কিস্তিতেও পুরো বছরের প্রিমিয়াম পরিশোধ করা যায়। সাধারণত আমরা ৪টা বা ৬টা কিস্তিতে প্রিমিয়াম পরিশোধ করে থাকি।
এক্ষেত্রে পুনর্বীমা কোম্পানির কোট (উদ্ধৃতি)-এ নির্ধারিত ডলারে প্রিমিয়াম পরিশোধ করতে হয়। আবার এই প্রিমিয়াম যখন আমরা পরিশোধ করি তখনকার ডলারের রেট ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে ৩ মাস পর পর প্রিমিয়ামের ইনস্টলমেন্ট দিলে ডলারের দাম বৃদ্ধিতে আমাদের খরচও বেড়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা গ্রাহককে মানি রিসিপ্ট যখন দেই তখনকার রেটই থেকে যায়। এক্ষেত্রে আমরা ক্ষতির শিকার হচ্ছি।
এদিকে ডলার সংকট বা মূল্য বৃদ্ধিতে এলসি খোলার পরিমাণ অনেক কমে গেছে। ফলে কোম্পানিগুলোর মেরিন ব্যবসাও কম হচ্ছে। ডলারের বাজার উর্ধ্বমুখী হওয়ায় এ বছর আমাদের এক থেকে দেড় কোটি টাকার লোকসান গুণতে হতে পারে। যদিও আমরা আমাদের বড় গ্রাহকদের সাথে বসে এই লোকসানের মাত্রা কিছুটা কমানোর চেষ্টা করছি।
এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ইমাম শাহীন বলেন, ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে দু’টো প্রভাব পড়েছে বীমা খাতে। এরমধ্যে একটি প্রভাব হলো- নৌ বীমা ব্যবসা আকষ্মিকভাবে কমে গেছে। এটা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) বা ঋণপত্র খোলা কমে যাওয়া এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। যখন থেকে বাজারে ডলার সংকট বা মূল্য বৃদ্ধি শুরু হয়েছে তখন থেকেই এ সমস্যা দেখা দিয়েছে।
এ ছাড়াও ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বিদেশে পুনর্বীমা প্রিমিয়াম পাঠাতে গিয়েও লোকসান গুণতে হচ্ছে বীমা কোম্পানিগুলোকে। বিশেষ করে যেসব পলিসির আন্ডাররাইটিং আরো আগেই হয়েছে, সেসব পলিসিতে এই লোকসানের মাত্রা বেশি। তবে ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে বীমার মূল্যও কিছুটা বেড়েছে। যদিও এর যোগ-বিয়োগ করলে দেখা যাবে কোম্পানিগুলোর লোকসানই বেশি।
রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা খালেদ মামুন বলেন, ডলারের বাজার উর্ধ্বমুখী হওয়ায় সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের বীমা খাতে। নৌ বীমা ব্যবসা এরইমধ্যে অর্ধেকে নেমে এসেছে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি ও বিলাসী পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করায় অনেকটাই বন্ধ রয়েছে এলসি খোলা। যার প্রভাব পড়েছে বীমা ব্যবসায়।
তাছাড়া বিদেশে পুনর্বীমা করতেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বীমা কোম্পানিগুলো। বিশেষ করে যেসব বীমা পলিসির আন্ডাররাইটিং করা হয়েছে আগে এবং প্রিমিয়াম পরিশোধ করা হচ্ছে এখন। এক্ষেত্রে পুনর্বীমার প্রিমিয়াম বিদেশে পাঠাতে বেশি দরে ডলার কিনতে হচ্ছে। অথচ প্রিমিয়াম হার আগেরটাই রয়েছে। কান্ট্রি লিমিট ওভার হওয়া বীমার ক্ষেত্রে এ সমস্যা হচ্ছে।
তবে দেশের বাইরে থেকেও তো আমাদের টাকা আসছে। অর্থাৎ ক্লেইম রিকভারীর ক্ষেত্রে যে ডলার আসে সেখানে আবার আমরা কিছুটা সুবিধা পাই। আগের সিদ্ধান্ত অনুসারেই তো পুনর্বীমা কোম্পানিগুলো ক্লেইম রিকভারির টাকা পাঠাচ্ছে। আমাদের দেশে প্রিমিয়ামের চেয়ে ক্লেইম রিকভারি আসে অনেক বেশি। তাই অনেক পুনর্বীমা কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করতে চায় না।
কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান তারেক বলেন, ডলার সংকট ও বিধিনিষেধের কারণে এলসি খোলা কমে গেছে। যার কারণে আমাদের নৌ বীমার ব্যবসাও অনেক কম হচ্ছে। এক-তৃতীয়াংশ বা দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত এই ব্যবসা কমেছে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে আমদানি-রপ্তানী কমলেও এর ভেলূ বাড়ছে। তবে এতে তেমন কোন প্রভাব পড়ছে না বীমা ব্যবসায়। ক্ষতির অংকটাই বেড়েছে বীমা খাতে।
হাসান তারেক আরো বলেন, ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমাদের সব পলিসির পুনর্বীমা এখন দেশেই করছি। দেশের টাকা দেশেই রাখার চেষ্টা করছি। এর ফলে বিদেশে পুনর্বীমা করতে গিয়ে ডলারের কারণে যে লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা সেটা আমাদের নেই। তাছাড়া খুব বেশি বড় অংকের বীমা পলিসি আমাদের নেই। যার কারণে আমাদের দেশের বাইরে পুনর্বীমা করার প্রয়োজন হচ্ছে না।
ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জামিরুল ইসলাম বলেন, ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে এলসি খোলা কমে গেছে। আগে যেখানে ৫০ জন এলসি খুলতো এখন সেখানে ১০ জনে নেমে এসেছে। এলসি না খুললে তো ইন্স্যুরেন্স হবে না। মেরিন ব্যবসাটাই আসে এখান থেকে, সেটাই প্রায় বন্ধ। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি বীমা ব্যবসায় বড় আঘাত হেনেছে।
জামিরুল ইসলাম আরো বলেন, যেকোন বড় বীমা পলিসির ক্ষেত্রেই আমাদের পুনর্বীমা করতে হয়। এক্ষেত্রে বিদেশে পুনর্বীমার প্রিমিয়াম পাঠাতেও আমাদের খরচ বেড়েছে। আগে যে ডলারের দাম ছিল ৮৭/৮৮ টাকা সেটা এখন হয়েছে প্রায় ৯৫ টাকা। এই বাড়তি মূল্য আমাদের বহন করতে হচ্ছে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি সব ক্ষেত্রেই আমাদের প্রভাবিত করেছে।
জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এস এম নুরুজ্জামান বলেন, ডলারের ঊর্ধ্বগতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে দেশের বীমা বাজারে।নন-লাইফ বীমা ব্যবসার পাশাপাশি লাইফ বীমা ব্যবসাও কিছুটা কমেছে। দৈনন্দিন জীবনের বাড়তি খরচ মেটাতে গিয়ে অনেকেই লাইফ বীমার প্রিমিয়াম ঠিকমতো দিতে পারছে না। তবে সরকার এরইমধ্যে ডলারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলো সফল হলে এই পরিস্থিতি পরিবর্তন আসবে বলে আমরা আশাবাদি।
ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন বলেন, ডলারের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব প্রায় সব ক্ষেত্রেই পড়েছে। বীমা খাতেও এর প্রভাব রয়েছে। নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা কমে গেছে। জীবনযাত্রায় বর্ধিত খরচের যোগান দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। চলমান বীমা পলিসির প্রিমিয়ামও তারা ঠিকমতো দিতে পারছে না। ডলারের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81