02/25/2025
বিশেষ প্রতিবেদক | Published: 2023-05-09 00:48:19
সরকারী বার্ষিক কর্মসম্পাদনের তালিকায় সবার শেষে অবস্থান গণপূর্ত অধিদপ্তরের। কারণ হিসেবে দেখা যায় জিকে শামীম, গোল্ডেন মনির এই সেক্টর থেকে বিদায় নিলেও কিছু প্রকৌশলী নিজেরাই ছোট ছোট সিন্ডিকেট করে সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন। নিজেরা নামে-বেনামে ভাই বা শ্যালকদের দিয়ে কাজ করিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। এটা এখন গনপূর্ত অধিদপ্তরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
সম্প্রতি গণপূর্ত বিভাগের ই/এম সার্কেল-৩ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম ও তার শ্যালক সাইফুল করিম খানের বিরুদ্ধে যোগসাজশের মাধ্যমে নিয়মবহির্ভূতভাবে কোটি কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, বোনজামাই প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম ও শ্যালক সাইফুল পরস্পর যোগসাজশে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। আবুল কালাম এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি প্লট, একাধিক ফ্ল্যাট, প্রায় অর্ধশত একর জমিসহ বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছেন। এদিকে শ্যালক সাইফুলের রয়েছে বহুতল ভবন, বিলাসবহুল গাড়ি ও বেশ কয়েকটি প্লট।
অভিযোগ রয়েছে, প্রকৌশলী আবুল কালাম একসময় গণপূর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (ইএম) ডিভিশন-১ এ তিন বছরেরও বেশি সময় দায়িত্বে ছিলেন। তখন থেকেই নিজ শ্যালক সাইফুল করিম খানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেসের নামে ঠিকাদারি কাজ শুরু করেন। পরস্পর যোগসাজশে শ্যালকের প্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকার কাজ দেন। এরপর তিনি পদোন্নতি পেয়ে আরও বড় দায়িত্বে অর্থাৎ সার্কেল (ইএম-৩) বসার পর আরও বেপরোয়া হয়ে যান। একের পর এক কাজ শ্যালকের প্রতিষ্ঠান দিয়ে করাতে থাকেন। এক পর্যায়ে তারই অধীনস্থ নির্বাহী প্রকৌশলী শ্যালকের প্রতিষ্ঠানে কাজ না দিলেই বাধে বিবাদ। প্রভাবশালী আবুল কালামের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ এনে সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ ইস্কান্দর আলী কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। এরপর তদন্ত শুরু হয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কালামের বিরুদ্ধে।
গণপূর্ত বিভাগের ই/এম সার্কেল-৩ এর অধীনের সকল টেন্ডার বা কাজ নিয়মবহির্ভূতভাবে শ্যালক সাইফুল খানকে পাইয়ে দেন প্রকৌশলী আবুল কালাম। এতে সরকারি কাজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অন্যান্য ঠিকাদাররা। এছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে সাইফুলকে কাজ দিতে অন্যান্য নির্বাহী প্রকৌশলীদের বাধ্য করেন আবুল কালাম। তার অনৈতিক নির্দেশ অমান্য করলে অধীনস্থ প্রকৌশলীদের বদলি করা হয়।
সূত্র বলছে, প্রকৌশলী বোনজামাই ও শ্যালকের বিরুদ্ধে ঠিকাদারির সিন্ডিকেট তৈরি ও অনিয়মের অভিযোগ করেছেন ই/এম শাখার অপর একজন নির্বাহী প্রকৌশলী। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বরাবরে পাঠানো চিঠিতে তিনি এসব অভিযোগ করেন। এছাড়া প্রকৌশলী মো. আবুল কালামের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও শ্যালককে দিয়ে ঠিকাদারি ব্যবসার বিষয়ে উল্লেখ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদকে) অভিযোগ করেছেন একজন ঠিকাদার।
গণপূর্ত সূত্র বলছে, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম বিদেশে পলাতক গনপূর্তের আরেক তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রোকন উদ্দিনের বিশ্বস্ত সহযোগী। রোকন উদ্দিনের সাথে তার গোপনে যোগাযোগ রয়েছে। প্রকৌশলী মো. আবুল কালামও অবৈধভাবে উপার্জিত কোটি কোটি টাকা রোকন উদ্দিনের সহায়তায় হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম এবং তার শ্যালক মিলে অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়ে শ্যালক সাইফুলের নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন তিনি। আর প্রতিষ্ঠানটির নাম দিয়েছেন ‘ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস’। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে সিসিটিভি, নেটওয়ার্কিং, সাউন্ড সিসটেমস ও পিএবিএক্স’র কাজ দিতে অন্যান্য সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলীদের চাপ দেন আবুল কালাম। কোনো নির্বাহী প্রকৌশলী তার কথা না শুনলেই হয়রানির লক্ষ্যে বদলি করাচ্ছেন। এমনকি চাকরি নিয়ে বেকায়দায় ফেলার হুমকি দেন।
সূত্র আরো বলছে, নিয়মবহির্ভূতভাবে শ্যালক সাইফুলকে কাজ দিতে অস্বীকার করায় নির্বাহী প্রকৌশলী শরীফ মো. আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে ইএম/৮ বিভাগ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন আবুল কালাম।
এদিকে পিপিআর’র শর্তাবলী ভঙ্গ করে নিজ শ্যালকের ঠিকাদারি ‘ফার্ম ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস’র নামে কাজ দিয়ে টেন্ডার অনুমোদন করেছেন আবুল কালাম। এছাড়া বেশ কিছু টেন্ডার মূল্যায়নে পর্যালোচক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
নিয়ম অনুযায়ী, রাজস্ব বাজেটে ১২ লাখ টাকার প্রাক্কলন ব্যয় পাস করার বিধান রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কালামের। কিন্তু তিনি ১২ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে ২ কোটি টাকার প্রাক্কলন ব্যয় উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে না পাঠিয়ে নিজেই পাস করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম তার অধীনস্থ কাঠের কারখানা বিভাগে ৮ কোটি, মেকানিক্যাল কারখানা বিভাগে ৪ কোটি, ইএম বিভাগ ৭-এ ১২ কোটি, ইএম বিভাগ ৮ ও ইএম বিভাগ এ- ৬ কোটিসহ মোট ৩০ কোটি টাকার অধিক কাজ প্রদান করেছেন শ্যালককে। এছাড়া ঘুষ পেলে নিজের মতোই এস্টিমেট (প্রাক্কলন) তৈরি করেন আবুল কালাম।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালামের সম্পত্তি
আবুল কালাম নিজের শ্যালককে কাছে আনার পর তার আর্থিক অবস্থা ম্যাজিকের মতো পরিবর্তন হয়। এরই মধ্যে তিনি অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।
প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী, প্রকৌশলী আবুল কালাম রাজধানীর রামপুরা বনশ্রীর ব্লক নং- ৫ জি, রোড নং-৫, বাড়ি নং ০১ হোল্ডিং-এ বহুতল বাড়ি নির্মাণ করেছেন। যার বর্তমান বাজার মূল্য কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা।
এছাড়াও আবুল কালামের গুলশান নিকেতনে ৩ হাজার বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট, আফতাব নগরে ৫ কাঠার পাঁচটি প্লট, বনশ্রীতে ৫ হাজার বর্গফুটের আলিশান ফ্ল্যাট রয়েছে। ঢাকার বাইরে কুমিল্লার নবীনগরে ৪৫ একর জমি, এলিয়ন ব্রান্ডের নতুন গাড়ি, নামে-বেনামে ব্যাংক ব্যালেন্স রয়েছে বলেও বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
ঠিকাদার শ্যালক সাইফুল করিম খানের সম্পত্তি
বোন জামাই থেকে পিছিয়ে নেই শ্যালক সাইফুলও। আবুল কালামের আশীর্বাদে সাইফুল এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী, সাইফুলের রয়েছে ব্রান্ড নিউ হ্যারিয়ার লেক্সাস গাড়ি, বাড্ডায় ছয়তলা ভবন, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি ব্লকে তিনটি ৫ কাঠার প্লট; যার বর্তমান মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা।
যোগসাজশ, নিয়মবহির্ভূতভাবে কাজ হাতিয়ে নেয়া, অন্যান্য ঠিকাদারদের হুমকি, নির্বাহী প্রকৌশলীদের হুমকিসহ নানা অভিযোগের ব্যাপারে কথা বলতে ‘ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস’র ঠিকাদার সাইফুলকে একাধিবার ফোন দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
অভিযোগের বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগের ই/এম সার্কেল-৩ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালামকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।
গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার বলেন, গণপূর্ত বিভাগের ই/এম সার্কেল-৩ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম বিরুদ্ধে আমাদের কাছে একাধিক অভিযোগ এসেছে। এসব অভিযোগগুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এসেছিল।
বোনজামাই ও শ্যালকের যোগসাজশের ব্যাপারে তিনি বলেন, শুনেছি, তার (আবুল কালাম) শ্যালকের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরই মধ্যে প্রকৌশলী মো. আবুল কালামের বিভিন্ন কাজের অনিয়মের বিষয়ে একজন কর্মকর্তাও লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগটি তদন্ত করা হচ্ছে। অভিযোগটির প্রমাণ মিললে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালামের বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ না দেখায় হতাশ অধিদপ্তরের অন্যান্য অনেক প্রকৌশলীরা।
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81