02/26/2025
বিশেষ প্রতিবেদক | Published: 2023-08-28 04:30:54
দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর নিয়োগ বাণিজ্যে রীতিমতো আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছেন মাগুরা সদরের ভারপ্রাপ্ত পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দারুল আলম। নামে-বেনামে সম্পত্তিসহ কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া দারুলের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ দেওয়া হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ কর্ম কমিশনসহ বিভিন্ন দপ্তরে। তবু স্বপদে বহাল আছেন তিনি।
চাকরিতে যোগদানের পর থেকেই তিনি নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে টাকার পাহাড় গড়তে থাকেন। সেই টাকার প্রতাপে পদোন্নতি পেয়ে মাগুরার ভারপ্রাপ্ত পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দায়িত্বে নিযুক্ত হন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান দারুল অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকার মিরপুরে কিনেছেন ফ্ল্যাট। স্ত্রী ও মায়ের নামে ব্যাংক ও পোস্ট অফিসে ফিক্সড ডিপোজিটের মাধ্যমে গচ্ছিত রেখেছেন মোটা অংকের টাকা।
বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, একাধিক বিভাগীয় মামলা মাথায় নিয়েই সমানতালে চলছে দারুলের নিয়োগ বাণিজ্য। অভিযোগ উঠেছে, টাকার জোরে পদোন্নতি পেয়ে এখন তিনি অনেক ক্ষমতাবান। অধিদপ্তরের নিয়োগ বাণিজ্য চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, নড়াইল, সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলার চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে চাকরি পাইয়ে দেন।
দারুল আলম উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা সহকারী (টিএফপিএ) থাকাকালে তাঁর লাগামহীন দুর্নীতি ঠেকাতে মাগুরা সদরের মাঠ কর্মচারীরা তাকে বদলি করার জন্য আবেদন করেন। দুদকেও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। এর পর তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। তবে চাকরিতে ফিরে তিনি ফের দুর্নীতি চালিয়ে যান। সে সময় ভুয়া বিল-ভাউচার ও ভ্রমণভাতা তোলাসহ নানা অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে।
তবে, মাগুরা জেলার পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে কর্মরত থাকাকালীন তিনি এমন কিছু অবৈধ ও অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটিয়েছেন যা রীতিমতো হতবাক করেছে সবাইকে।
মাগুরায় একই পরিবারের পাঁচজন এবং অন্য এক পরিবারের দু'জনসহ ১৫ জনকে চাকরি দেন দারুল আলম। একই পরিবারের পাঁচ নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মী হলেন- সুরাইয়া আহমেদ, ঝুনা পারভীন, মাহফুজা খানম দিনা, কামরুল ইসলাম ও নূরজাহান বেগম। তাঁদের মধ্যে প্রথম তিনজন বোন। তাঁদের বয়স ৪০ বছরের ওপরে।
দ্যা ফিন্যান্স টুডের বিশেষ অনুসন্ধানী টীম দারুল আলমের বিরুদ্ধে উল্লেখিত তিন বোনের নিয়োগের বিষয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে এমন কিছু তথ্য প্রমানাদি সংগ্রহ করেছে যা দেখে হতবাক টীমের সবাই।
এই নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়স গোপনসহ আরও অনেক বেআইনি কাজ করেছেন দারুল। অষ্টম শ্রেণি পাসের ভুয়া সার্টিফিকেট, দাই/নার্স/আয়া/অফিস সহায়কের ভুয়া সনদ তৈরিসহ ১৮-২০ বছর আগে তোলা ছবি ব্যবহার করেছেন। এ বিষয়ে দুই বছর ধরে তদন্ত হলেও তেমন অগ্রগতি নেই। ওই তিন বোন এখনও চাকরি করে যাচ্ছেন।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, দারুল আলম এই তিন বোনের কাছ থেকে জনপ্রতি ৬ লক্ষ টাকা করে নিয়ে ভুয়া বিদ্যালয়ের নামে শিক্ষা সনদ, ভুয়া শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স কম দেখানো, ভুয়া অভিজ্ঞতা এবং ভুয়া জন্ম সনদ দেখিয়ে সরকারি চাকুরী পাইয়ে দেন।
মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে কর্মরত অফিস সহকারী মোছাঃ সুরাইয়া আহমেদের প্রকৃত বয়স ৪৪ বছর হলেও নিয়োগের সময় তার বয়স ২৬ বছর দেখানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সুরাইয়া আহমেদের জন্ম ১৯৬৮ সালে। কিন্তু ভোটার তালিকায় তার জন্ম সাল পরিবর্তন করে দেখানো হয় ১৯৭৪ সাল। পরবর্তীতে চাকুরী দেয়ার সময় দ্বিতীয়বার তার জন্ম সাল পরিবর্তন করে দেখানো হয় ১৯৮৫ সাল।
এমনকি জগদল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাগুরা সদর, মাগুরা নামক বাস্তবে অস্তিত্বহীন একটি বিদ্যালয়ের নামে ৮ম শ্রেনী পাশের ভুয়া শিক্ষা সনদ ব্যবহার করে চাকুরী পাইয়ে দিয়েছেন দারুল আলম। এমনকি বয়স যাতে বুঝা না যায় সেজন্য নিয়োগপত্রে সুরাইয়ার ১৮-২০ বছর বয়সের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।
একইভাবে, মাগুরা সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে কর্মরত অফিস সহকারী ঝুনা পারভীনের প্রকৃত বয়স ৪১ বছর হলেও নিয়োগের সময় তার বয়স ২৬ বছর ৬ মাস দেখানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ঝুনা পারভীনের জন্ম ১৯৭১ সালে। কিন্তু ভোটার তালিকায় তার জন্ম সাল পরিবর্তন করে দেখানো হয় ১৯৭৯ সাল। পরবর্তীতে চাকুরী দেয়ার সময় দ্বিতীয়বার তার জন্ম সাল পরিবর্তন করে দেখানো হয় ১৯৮৫ সাল।
অনুরূপ, মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে কর্মরত দাই নার্স মাহফুজা খানম দিনার প্রকৃত বয়স ৩৯ বছর হলেও নিয়োগের সময় তার বয়স ২৯ বছর দেখানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মাহফুজা খানম দিনার জন্ম ১৯৭৪ সালে হলেও ভোটার তালিকায় তার জন্ম সাল পরিবর্তন করে দেখানো হয় ১৯৮২ সাল। পরবর্তীতে চাকুরী দেয়ার সময় দ্বিতীয়বার তার জন্ম সাল পরিবর্তন করে দেখানো হয় ১৯৮৪ সাল।
প্রকৃতপক্ষে, জন্ম সাল ভুল হলে যে কোন এক বোনের হতে পারে। ৩ বোনেরই জন্ম তারিখ ভুল হওয়াটা ছিল অবাক করার মত বিষয়। আর ৩ বোনেরই জন্ম তারিখ দুই দুইবার পরিবর্তন করাটা ছিল একটি ভয়ংকর জালিয়াতি। এ থেকেই প্রতীয়মান হয় এই ৩ বোনের নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন পর্যায়ের প্রতারনা ও অসদুপায় অবলম্বন করা হয়েছে।
আরেকটি বিষয় লক্ষনীয় যে, চাকুরী নেয়ার সময় বড় বোন সুরাইয়া জন্ম তারিখ দেখিয়েছে ২১/০৯/১৯৮৫ইং এবং মেঝ বোন ঝুনা জন্ম তারিখ দেখিয়েছে ১৪/০৩/১৯৮৫ইং সাল। অর্থাৎ, একই মায়ের গর্ভ হতে ৬ মাসের ব্যবধানে দুই বোনের জন্ম হয়েছে। তারচেয়েও লোমহর্ষক তথ্য হচ্ছে, বড় বোনের আগে মেঝ বোনের জন্ম হয়েছে।
অন্যদিকে, চাকুরী নেয়ার সময় সেঝ বোন মাহফুজা খানম দিনা জন্ম তারিখ দেখিয়েছে ১৫/০১/১৯৮৪ইং সাল। অর্থাৎ, দিনা বড় ও মেঝ বোনের আগেই জন্ম নিয়েছে যা কিনা জালিয়াতির সকল মাধ্যমকে হার মানিয়েছে।
অন্যদিকে, দারুল আলম ৩ বোনকে জগদল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাগুরা সদর, মাগুরা এর নামে যে শিক্ষা সনদ ব্যবহার করে চাকুরী পাইয়ে দিয়েছেন বাস্তবে মাগুরা সদর উপজেলায় এই নামে কোন বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব নেই। মাগুরা জেলা শিক্ষা অফিসার এই বিষয়টি 'দ্যা ফিন্যান্স টুডে'কে নিশ্চিত করেছেন।
এই ভুয়া শিক্ষা সনদের বিষয়টি জানাজানি হলে ভুয়া বিদ্যালয়কে বৈধ করার জন্য পুনরায় জগদল সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাগুরা সদর, মাগুরা এর নামে ভুয়া শিক্ষা সনদ বের করে। এই ভুয়া শিক্ষা সনদে জগদল সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ আব্দুর রাজ্জাকের স্বাক্ষর জাল করা হয়।
এরপর মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা দিয়ে অফিসকে ম্যানেজ করে রেকর্ড রুম থেকে ৩ বোনের জগদল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভুয়া সনদ সরিয়ে সেখানে জগদল সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নামে পুনঃতৈরীকৃত ভুয়া শিক্ষা সনদ রেখে দেয়া হয়। পরবর্তীতে উক্ত ভুয়া শিক্ষা সনদ দিয়ে দারুল আলম ৩ বোনের পুলিশ ভেরিফিকেশন ও চাকুরী স্থায়ী করে দেন।
এই ঘটনাও জানাজানি হলে, দারুল আলম ৩ বোনের চাকরি রক্ষার্থে আবারও জগদল সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা কাজী জিন্নাত আরা আন্নাকে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা দিয়ে এই মর্মে প্রত্যায়ন লিখে নেন যে, ঐ ৩ বোন জগদল সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল।
এখানেই শেষ নয়, কোনরকম পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা সত্বেও মাগুরাস্থ আবেদ উদ্দিন মেমোরিয়াল ট্রাস্ট (মাগুরা পলি ক্লিনিক) এর নামে প্যাড তৈরী করে উক্ত প্যাডে দাইনার্স হিসেবে ৩ বছর কাজের অভিজ্ঞতা আছে মর্মে প্রত্যায়ন লিখে মাগুরা সদর হাসপাতালের প্রাক্তন আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ মোঃ মোক্তাদুর রহমানের স্বাক্ষর জাল করে এবং সেই প্রত্যায়ন পত্র ব্যবহার করে সরকারি চাকরিতে যোগদান করে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতা ও অনৈতিক সুবিধা নিয়ে তিনি দিনের পর দিন এ ধরনের অপরাধ করে যাচ্ছেন।
দারুল আলমের বিরুদ্ধে ওই তিন বোনকে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি পাইয়ে দেওয়াসহ দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ ওঠায় তদন্ত শেষে ২০২০ সালে তাঁকে মাগুরা থেকে পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলায় বদলি করা হয়।
এর পর আদেশটি পরিবর্তন করে পিরোজপুর নেছারাবাদের স্থলে যশোরের শার্শায় বদলি করা হয়। কিন্তু তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগ না দিয়ে ওই আদেশের বিরুদ্ধে ঢাকার প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল-১-এ মামলা করেন এবং এখনও কর্মস্থলে বহাল আছেন। দুই বছরেও দারুল আলমের মামলার বিষয়ে কোনো জবাব দিতে পারেনি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। মূলত কালক্ষেপণের মাধ্যমে তারা আসলে দারুল আলমকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
দারুল আলম তার নিয়োগ বাণিজ্যের অর্থ লেনদেন করেন তার বড় ভাই নুহু দারুল হুদার ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মাগুরা শাখার একটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। তার বেনামে অনেক সম্পত্তি থাকলেও প্রকাশিত সম্পত্তির মধ্যে মাগুরা পিটিআইর সামনে গ্যাডো ক্লিনিকের ৭ শতক জমির আনুমানিক মূল্য ৫০ লাখ টাকা। পারনান্দুয়ালীর ১১ শতক জমির আনুমানিক মূল্য ৪০ লাখ টাকা। দলিলে তিনি এসব জমির দাম দেখিয়েছেন অনেক কম।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে দারুল আলমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া দেননি।
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81