02/26/2025
অনামিকা নাহারিন | Published: 2023-11-02 07:43:25
বহুকাল আগে থেকেই কূটনীতির অংশ হিসেবে এক দেশের কূটনীকিতরা আরেক দেশে অবস্থান করে আসছেন। বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এটি। এক দেশের সাথে আরেক দেশের কূটনীতিক সুসম্পর্ক বজায় রাখতে একেক দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে একেক দেশের রাষ্ট্রদূত।
এই ভিন্ন দেশে অবস্থানের ক্ষেত্রে তারা যেমন খুবই শক্ত প্রোটোকল এবং ইমিউনিটি পান, তেমনি তাদের কিছু বিধিনিষেধও মেনে চলতে হয়। আর তাদের এই সুরক্ষা ও আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্যই তৈরি হয় ভিয়েনা কনভেনশন।
কোনো দেশে অন্য দেশের একজন কূটনীতিক কী ধরণের সুবিধা পাবেন বা তার সাথে কেমন আচরণ করা হবে সে বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে অভিন্ন কোন চুক্তি বা নিয়ম নীতি আগে ছিল না।
এই প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবার পরই ১৯৬১ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘের উদ্যোগে ভিয়েনায় এক কনফারেন্সের পর অংশগ্রহণকারী দেশগুলো নিয়ে একটি চুক্তি করা হয় যা ‘ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপলোম্যাটিক রিলেশন’ হিসেবে পরিচিত।
ভিয়েনা কনভেনশনে যেসব নিয়ম-নীতি উল্লেখ করা আছে সে অনুযায়ী কোন দেশে অন্য কোন দেশের কুটনীতিক মিশন বা প্রতিনিধিরা অবস্থান করে থাকে। এই চুক্তির মাধ্যমে অন্য দেশে কূটনীতিকদের বিভিন্ন ধরণের সুবিধা, নিরাপত্তা, বাসস্থান, আইন প্রয়োগসহ নানা বিষয় নিশ্চিত করে থাকে গ্রাহক দেশ।
তাহলে প্রশ্ন আসে ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী একজন কূটনীতিক এবং গ্রাহক দেশের সম্পর্ক কেমন হবে? তারা একে অপরের সাথে কেমন আচরণ করবে? কারণ একজন কূটনীতিক কি করতে পারবেন আর কি করতে পারবেন না, সে সবকিছুই নির্ধারিত হয় এই ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী। যার কারণে এই চুক্তি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
একজন কূটনীতিক যা করতে পারেন এবং পারেন না:
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কূটনীতিকদের কাজ হলো- ১। গ্রহীতা রাষ্ট্রে প্রেরক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করা; ২। আইন মোতাবেক গ্রহীতা রাষ্ট্রে প্রেরক রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষা করা; ৩। গ্রহীতা রাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা; ৪। গ্রহীতা রাষ্ট্রে বিদ্যমান যেকোনও অবস্থা সম্পর্কে আইন অনুমোদিতভাবে তথ্য সংগ্রহ করা এবং তা নিজ রাষ্ট্রের সরকারকে অবহিত করা; এবং ৫। প্রেরক রাষ্ট্র ও গ্রহীতা রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন ও তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক সম্পর্কের প্রসার ঘটানো।
কূটনীতিকদের অফিস কোথায় হবে সে বিষয়ে চুক্তির ১২নং ধারায় বলা হয়েছে যে, কূটনীতিক মিশন প্রেরণকারী দেশ মিশনের জন্য বরাদ্দকৃত অফিস সীমার বাইরে অন্য কোন জায়গায় কোন অফিস স্থাপন করতে পারবে না।।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রদূতদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যম হবে সরকার। অর্থাৎ, কোনোভাবেই কোনও রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ নেই। এখন প্রশ্ন হতে পারে, কোনো রাষ্ট্রের রাজনীতি, রাজনৈতিক দল কিংবা নির্বাচনে কূটনীতিকরা নাক গলাতে পারবেন না এটি কোথায় বলা আছে?
ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১(১) ধারায় বলা হয়েছে, যেসব ব্যক্তি অন্য কোনো দেশে কূটনীতিকের মর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করেন, তারা ওই দেশের আইন ও নীতি মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন। পাশাপাশি কূটনৈতিক কার্যাবলি ছাড়া তারা ওই দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না।
৪১(২) ধারায় বলা হয়েছে, কূটনীতিকদের সব ধরনের দাফতরিক কাজ, যা প্রেরক রাষ্ট্র কূটনীতিক মিশনের ওপর ন্যস্ত করবে, তা গ্রাহক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা এ সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হতে হবে।
আর ৪১(৩) ধারায় বলা হয়েছে, কূটনীতিকরা তাদের মিশন অফিসের প্রাঙ্গণ ভিয়েনা কনভেনশন কিংবা অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইনের বিধান কিংবা প্রেরক ও গ্রহীতা রাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান কোনও চুক্তি অনুযায়ী কূটনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন কোনও উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবেন না।
অর্থাৎ, কোনো দেশের রাজনীতি, রাজনৈতিক দল কিংবা নির্বাচনে কোনো কূটনীতিকরা নাক গলাতে পারবেন না। যদি তাদের কোনো বক্তব্যও থেকে থাকে সেটি গ্রাহক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা এ সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হতে হবে।
চাইলেই কি একজন রাষ্ট্রদূতকে গ্রহীতা রাষ্ট্র থেকে বের করে দেয়া যায়?
ভিয়েনা কনভেনশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা বা আর্টিকেল ৯ এ বলা হয়েছে যে, যেকোন দেশ ওই দেশে নিযুক্ত অন্য দেশের কূটনীতিককে কোন কারণ দর্শানো ছাড়াই ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ বা অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করতে পারে। ওই কূটনীতিক সংশ্লিষ্ট দেশে পৌঁছানোর আগেই তাকে অগ্রহণযোগ্য বা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা যায়। যদি প্রেরক রাষ্ট্র যথাযথ সময়ে তাদের কূটনীতিককে ফিরিয়ে না নিতে পারে তবে গ্রহীতা রাষ্ট্র ওই কূটনীতিকের বিশেষ মর্যাদা ও নিরাপত্তা নাকচ করে দিতে পারে।
অর্থাৎ, গ্রহীতা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, এটি কোনও প্রথা বা সৌজন্যতার বিধি নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যতামূলক বিধান। হস্তক্ষেপের অভিযোগে গ্রহীতা রাষ্ট্র কূটনীতিকদের সতর্কতা, বহিষ্কার এবং এমনকি কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে এমন অনেক ঘটনা রয়েছে।
বিভিন্ন কূটনীতিক বহিষ্কার:
একটি দেশের কূটনীতিক মিশনের প্রধানসহ ওই মিশনে কর্মরত যেকোন ব্যক্তিকে গ্রহীতা রাষ্ট্র যেকোনো সময় তার কাজকর্ম পছন্দ না হলে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করতে পারে।
এক্ষেত্রে নিযুক্ত ওই কূটনীতিককে প্রেরক দেশ হয় বরখাস্ত করবে অথবা ফিরিয়ে নেবে। যদি যথাযথ সময়ে ওই দেশ তাদের কূটনীতিককে ফিরিয়ে নিতে না পারে তাহলে গ্রাহক দেশ ওই কূটনীতিককে তার বিশেষ মর্যাদা ও নিরাপত্তা নাকোচ করতে পারে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ ধরণের ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। দুই দেশই তাদের কূটনীতিককে ‘অগ্রহণযোগ্য’ উল্লেখ করে সাত দিনের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার নোটিশ দেয় প্রায়ই। ২০১৯ সালেও কাশ্মির ইস্যুতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে বরখাস্ত করেছিল পাকিস্তান।
এর আগে ব্রিটেনে এক প্রাক্তন গুপ্তচর ও তাঁর কন্যার উপর হামলাকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও পশ্চিমা জগতের মধ্যে কূটনৈতিক সংঘাত চরমে উঠে৷ রাশিয়া এ ঘটনায় ৬০ জন মার্কিন কূটনীতিককে বহিষ্কারের ঘোষণা করে। মূলত, ব্রিটেনের প্রতি সংহতি দেখিয়ে অ্যামেরিকাসহ ইউরোপের একাধিক দেশ বেশ কিছু রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কারের পর রাশিয়াও পালটা এ বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়।
এছাড়া সম্প্রতি সম্প্রতি ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে কয়েক ডজন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে। এর পাল্টা জবাব হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৮ জন কূটনীতিককে বহিষ্কার করে রাশিয়া। মূলত, ২০২২ সালের দিকে গুপ্তচরবৃত্তি সন্দেহে ৪৩ জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে ইউরোপের চার দেশ। তারই জবাব ছিল এই ঘটনা।
এই কিছুদিন আগে, বেইজিংয়ের সমালোচক কানাডার এক আইনপ্রণেতাকে ভয় দেখানোর পরিকল্পনায় এক চীনা কূটনীতিক জড়িত থাকায় টরেন্টোয় নিযুক্ত একজন চীনা কূটনীতিককে বহিষ্কার করে কানাডা। এ বিষয়ে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলি নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো ধরনের বিদেশি হস্তক্ষেপ বরদাশত করবেন না বলেই এ পদক্ষেপ নেন বলে জানান।
এছাড়া, সম্প্রতি ভারত-কানাডা দ্বন্দ্বে শিখ নেতা হরদীপ সিং হত্যাকাণ্ডের জেরে ভারতের নির্দেশে কানাডার ৪১ কূটনীতিককে ফিরিয়ে নিয়েছে দেশটি।
বাংলাদেশেও এমন কূটনীতিক বহিষ্কারের ঘটনা রয়েছে। ২০১৫ সালের দিকে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় পাকিস্তানি কূটনীতিক ফারিনা আরশাদকে বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
অর্থাৎ, কোনো দেশই নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে অন্য কোনো দেশের হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না। এর জেরে পাল্টাপাল্টি এসব কূটনীতিক বহিষ্কারের ঘটনা যেকোনো দেশের জন্যই একটি সাধারণ ঘটনা।
ভিয়েনা কনভেনশনের নিয়মনীতি অনুসারে ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বিষয়’ সকল কূটনীতিকদের আসলে মনে থাকাটা দরকার। ১৯৬১ সালের কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক ভিয়েনা কনভেশনের ৪১ ধারার অনুচ্ছেদ ১ মূলত কূটনীতিবিদদের গ্রহণকারী দেশের আইন ও বিধি-বিধানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়, যা তাদের মেনে চলা কর্তব্য।
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81