02/24/2025
অনলাইন ডেস্ক: | Published: 2024-10-08 13:31:16
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই জাতির উদ্দেশে ভাষণে নিজের কর্মপরিকল্পনার ধারণা দেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। কোনো বিদেশি ব্যবসা বা বিনিয়োগ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করতে চাই। আর এসব সংস্কার যেন টেকসই হয়, তা দীর্ঘমেয়াদে নিশ্চিত করতে এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রধান উপদেষ্টার নেওয়া সংস্কারের প্রভাব দেখা দিয়েছে ব্যাংকখাতে। অত্যন্ত নাজুক আর ভঙ্গুর ব্যাংকগুলো ঢেলে সাজাতে নেওয়া হয়েছে নানান উদ্যোগ। যেখানে গ্রাহকের আস্থার সংকট ছিল তা ফিরিয়ে আনতে তৎপর বাংলাদেশ ব্যাংক। সংকট কমিয়ে আনতে ইতোমধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, যেখানে গ্যারান্টার হিসেবে রয়েছে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংকখাতে ব্যাপক সংস্কারে হাত দেওয়া হয়েছে। ফলে ব্যাংক থেকে ইতিবাচক প্রভাব আসবে। মুদ্রানীতিতে সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে সংকোচনমূলক নীতি অবলম্বন করার ফলও পেতে শুরু করেছে তারা। বিনিময়হার স্থিতিশীল আর মূল্যস্ফীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট শপথ নেয় ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের দুই মাসে ব্যাংকখাতে যত উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার কিছু তুলে ধরা হলো:
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরই পালিয়ে যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। অন্যদিকে ব্যাংক লুটপাটের সহযোগী হিসেবে আখ্যা দিয়ে ডেপুটি গভর্নরদের পদত্যাগ চান বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এরপর সরিয়ে দেওয়া হয় দুই ডেপুটি গভর্নর, পলিসি উপদেষ্টা ও বিএফআইইউ প্রধানকে। ড. মো. জাকির হোসেন চৌধুরী ও ড. মো. কবির আহম্মদকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দেশের প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। এর পরই তার হাত দিয়ে শুরু হয় আর্থিক খাতে সংস্কার।
১০ ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন
দেশের ব্যাংকখাত পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে ১০টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পর্ষদ ভেঙে দেওয়া ব্যাংকগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), এক্সিম ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এছাড়া আরও পাঁচটি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
ব্যাংকখাত সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন
ব্যাংকখাত সংস্কারের লক্ষ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আর্থিক খাত বিষয়ে অভিজ্ঞ ছয়জনকে সদস্য করা হয়েছে। এতে সমন্বয়ক হিসেবে রয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। ব্যাংকখাত সংস্কারে নানান পদক্ষেপের পাশাপাশি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে এই টাস্কফোর্স।
গত ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, টাস্কফোর্সের ছয় সদস্য হলেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, সাবেক ডেপুটি গভর্নর মুহাম্মদ এ (রুমি) আলী, ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান মেহরিয়ার এম হাসান, বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, জেডএনআরএফ ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের উপাচার্য এম জুবায়দুর রহমান ও হিসাববিদ কোম্পানি হুদা ভাসি চৌধুরীর অংশীদার সাব্বির আহমেদ।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই টাস্কফোর্স প্রধানত আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে ব্যাংকখাতের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি, মন্দ সম্পদ, প্রধান ঝুঁকিগুলো নিরূপণ করবে। এছাড়া দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক পর্যালোচনা, ঋণের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি নিরূপণ, তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা, নিট মূলধন নির্ণয়, সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মন্দ সম্পদকে পৃথকীকরণ–সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, টাস্কফোর্সের মাধ্যমে সংকটকালীন প্রতিঘাত সক্ষমতা অর্জনে ব্যাংকের সুশাসন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার প্রক্রিয়ার আওতায় নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার উন্নয়ন, ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক ও করপোরেট প্রভাব সীমিত করা, ব্যাংকের মালিকানা সংস্কার সংক্রান্ত প্রস্তাব পেশ করবে। সমস্যায় থাকা ব্যাংকের অর্থ উদ্ধার এবং বিধিকাঠামো ও সংশ্লিষ্ট নীতিমালা প্রস্তুত করা, দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য বিভিন্ন নীতিগত ব্যবস্থা বা পদক্ষেপও গ্রহণ করবে এই টাস্কফোর্স।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, এই টাস্কফোর্স আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইন যেমন ব্যাংক কোম্পানি আইন, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ইত্যাদির সংস্কার এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি, ব্যাংক অধিগ্রহণ ও একীভূতকরণ–সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, সংস্কার ও যুগোপযোগীকরণের প্রস্তাব দেবে এবং ব্যাংকখাতের শ্বেতপত্র প্রকাশের পদক্ষেপ নেবে।
ব্যাংকখাত সংস্কারে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বাড়ানোর কাজেও এই ঋণ ব্যয় করা হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। পাশাপাশি আইএমএফ থেকেও সহায়তার আশ্বাস মিলেছে।
প্রাথমিকভাবে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে ৪৫ কোটি ডলার করা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে এডিবি ব্যাংকখাত সংস্কারে ১৩০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে।
বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তসংস্থা টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করেছে সরকার। প্রথমবারের মতো এ টাস্কফোর্সের সভাপতি করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
পুনর্গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য কমিয়ে সভাপতিসহ ৯ জন করা হয়েছে। এত দিন টাস্কফোর্সের জন্য আহ্বায়ক কমিটি ছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। আর কমিটি ছিল ১৪ সদস্যের।
পুনর্গঠিত টাস্কফোর্সে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ; আইন ও বিচার বিভাগ; দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক); পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি); অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়; জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে একজন করে উপযুক্ত প্রতিনিধি থাকবেন। উপযুক্ত প্রতিনিধি বলতে কী বোঝানো হয়েছে, অর্থাৎ কোনো সদস্য কোন পর্যায়ের কর্মকর্তার নিচে হবেন না, প্রজ্ঞাপনে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি।
‘ব্যাংকখাতে ব্যাপক সংস্কারে হাত দিয়েছি আমরা। ফলে ব্যাংক থেকে অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব আসবে। আমাদের বিনিময় হার স্থিতিশীল আছে। সেই সঙ্গে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে এসেছে। সব কিছু সঠিকভাবে চললে কয়েক মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় চলে আসবে।’-বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা
নতুন টাস্কফোর্স থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব, এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালককে (বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ)।
অভিযোগ রয়েছে ব্যাংকখাত থেকে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তার বেশির ভাগই পাচার করেছে এস আলম গ্রুপ। এতে শঙ্কায় পড়েন আমানতকারীরা। ব্যাংকে বন্ধক নেই, এমন সম্পত্তি বিক্রি করার চেষ্টা করে গ্রুপটি। এস আলমের সম্পদ কাউকে না কেনার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, এস আলম গ্রুপের সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। অন্যদের বিষয়েও খোঁজ নেওয়া হবে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যাংক লুটেরা কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানান তিনি।
অভিযোগ ওঠে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে আর্থিক খাতের মাফিয়ারা তাদের টাকা উত্তোলন করে নিচ্ছেন। তারা যাতে সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার কিংবা অন্য খাতে অর্থ সরিয়ে নিতে না পারে এজন্য রাঘববোয়ালদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। হিসাব জব্দের তালিকায় রয়েছেন ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এবং তার পরিবার, এস আলম ও তার পরিবার, সালমান এফ রহমান ও তার পরিবারের সদস্য, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চেয়ারম্যান রুখমিলা জামান চৌধুরী (সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের স্ত্রী) ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। আরও জব্দের তালিকায় রয়েছেন একাধিক ব্যক্তি ও তাদের একক প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ ব্যাংক ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতো টাকা ছাপিয়ে কোনো ব্যাংকে তারল্য সহায়তা দিচ্ছে না। বরং তারা গ্যারান্টার হয়ে তুলনামূলক সবল ব্যাংকের কাছ থেকে দুর্বল ব্যাংকে তারল্য সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এটাকে ইতিবাচক হিসেবে নিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে না, আবার ব্যাংকগুলোও তারল্য সংকটে ভুগবে না।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টির বিপরীতে সবল ব্যাংক থেকে ৯৪৫ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা পেয়েছে চারটি ব্যাংক। এর মধ্যে সিটি ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে দুর্বল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৩০০ কোটি টাকা ধার পেয়েছে। সিটি ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে আরেক দুর্বল সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকও ৩৫০ কোটি টাকা ধার পেয়েছে। অপরদিকে বেঙ্গল কমার্স ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ও সিটি ব্যাংক থেকে ২৭০ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা পেয়েছে আলোচিত দুর্বল ন্যাশনাল ব্যাংক। আর ইস্টার্ন ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক থেকে চাহিদা অনুযায়ী ২৫ কোটি তারল্য সহায়তা পেয়েছে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক।
দুই মাসে দুবার নীতি সুদ হার বৃদ্ধি
মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দুবার নীতি সুদ হার বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২৪ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। ফলে ওভারনাইট রেপো সুদহার ৯ দশমিক ৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং ঋণসহ সব ধরনের ব্যাংকিং পণ্যের ওপর সুদের হার বেড়েছে। মুদ্রানীতিতে সংকোচনমূলক পদক্ষেপ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর আগে গত ২৫ আগস্ট নীতি সুদহার বাড়ানো হয়। তখনো ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে নীতি সুদহার ৯ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, নীতি সুদহার বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করার লক্ষ্যে নীতি সুদহার করিডোরের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটির (এসএলএফ) ক্ষেত্রে বিদ্যমান সুদহার ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ১১ শতাংশে এবং নিচের সীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে।
সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, ২৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত মুদ্রানীতি কমিটির পঞ্চম সভায় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংকোচনমূলক নীতি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে কেন্দ্রীয় কোন সময়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কোন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে চায়, সে সম্পর্কে চিঠিতে কিছু বলা হয়নি।
নীতি সুদহার বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্য হলো বাজারে অর্থের সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে বাজারে অর্থের সরবরাহ বেশি এবং সে কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, তাহলে অর্থপ্রবাহ কমাতে নীতি সুদহার বৃদ্ধি করা হয়। নীতি সুদহার বৃদ্ধির অর্থ হলো, ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত সুদ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হবে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে ঋণ দেয়, তার সুদহারও বাড়ে। নীতি সুদহার বেশি হলে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে নিরুৎসাহিত হয়।
দেশে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে প্রবাসীরা বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে রেমিট্যান্সে ভাটা পড়ে। তবে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সবার সহযোগিতা চান। এর পরই বাড়তে থাকে রেমিট্যান্সের গতি। সদ্য বিদায়ী সেপ্টেম্বরের পুরো সময়ে ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ ডলার (২.৪০ বিলিয়ন) পাঠিয়েছেন বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসেবে ২৮ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকার বেশি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৩৩ কোটি ডলার। সেই হিসাবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় গত মাসে প্রবাসীরা ৮০ শতাংশ বেশি অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, আগস্ট মাসের পুরোসময়ে দেশে বৈধপথে রেমিট্যান্স এসেছে ২২২ কোটি ডলার, যা তার আগের বছরের একই সময়ের (আগস্ট) তুলনায় ৬২ কোটি ডলার বেশি। গত বছরের আগস্ট মাসে এসেছিল প্রায় ১৬০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে ১৯০ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স আসে।
যা বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক
গত দুই মাসে ব্যাংকখাতের পরিবর্তন নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যায়ন জানতে চেয়েছিল জাগো নিউজ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘বড় পরিবর্তনের ঢেউ ছিল, পরিবর্তনটা অনেক বড়। তার একটি অংশ ব্যাংকখাতেও পড়েছে। প্রথম দিকে ব্যাংকখাত নিয়ে সবাই নেতিবাচক দেখেছিল, সে তুলনায় এখন আমরা ভালো দেখতে পাচ্ছি। সাধারণ মানুষ দেখছিল যে গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে নিচ্ছে, আস্থার অভাব ছিল। তারা হয়তো অন্য ব্যাংকের কাছে গিয়ে এসব টাকা জমা দিয়েছে। এতে কিছু ব্যাংকের সঞ্চয় বেড়ে গেছে এবং কিছু ব্যাংকের সঞ্চয় কমেছে। যেসব ব্যাংকের সঞ্চয় কমেছে, তারা সাময়িকভাবে কিছু সমস্যায় পড়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এতে দাতা ব্যাংক তারল্য দিয়ে তাদের সাহায্য করছে। এর ইতিবাচক প্রভাব ব্যাংকখাতে পড়েছে, যার মাধ্যমে গ্রাহকের মধ্যে আস্থা ফেরাবে।’
মুখপাত্র বলেন, ‘এসবের বাইরেও ব্যাংকখাতে ব্যাপক সংস্কারে হাত দিয়েছি আমরা। ফলে ব্যাংক থেকে অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব আসবে। এর বাইরেও মুদ্রানীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেটা মূল কাজ, মুদ্রানীতিতে সুদের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে সংকোচনমূলক নীতি অবলম্বন করেছি। তার ফলাফলও কিন্তু আমরা পেতে শুরু করেছি। আমাদের বিনিময় হার স্থিতিশীল আছে, সেই সঙ্গে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। মূল্যস্ফীতিতে ইতিবাচক দিক দেখা দিয়েছে, ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে এসেছে। আমরা আশা করছি এভাবে যদি চলতে থাকি এবং সবকিছু ভালোভাবে চললে কয়েক মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় চলে আসবে।’
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81