02/23/2025
মোঃ মাহবুবুর রহমান | Published: 2025-01-04 08:06:03
কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেট পদস্থ সাব ইন্সপেক্টর আবুল খায়ের ভুইয়া। মূলত সিপাই থেকে কাষ্টমস ও ভ্যাট এর সাব ইন্সপেক্টর হয়েছেন। ছোট পদে চাকরি করেও ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তিনি। হয়েছেন অঢেল সম্পদের মালিক। শুধু নিজের নামে ধন-সম্পদ করেই ক্ষ্যান্ত হননি। স্ত্রীর নামেও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। আত্মীয়স্বজনের নামেও সম্পদের কমতি রাখেননি।
আবুল খায়ের ভূইয়া চাকরি হওয়ার পরে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে তদবির করে ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস হাউস আইসিটিতে প্রেষণে পদস্থ হন। তারপর আবার ঢাকা দক্ষিণে আসেন। সামান্য একজন কাষ্টমস কর্মচারী হয়ে শত কোটি টাকার মালিক কিভাবে হলেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে খোদ কাষ্টমস ডিভিশনে।
আবুল খায়েরের সম্পদের উৎস কি তা নিয়েও শুরু হয়েছে নানা জল্পনা কল্পনা। রীতিমতো হতবাক হয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তবে পতিত সরকারের আমলে আবুল খায়ের এই আলাদীনের চেরাগ হাতে পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
এক অনুসন্ধানে জানা যায়, কাষ্টমস ও ভ্যাট এর সাব-ইন্সপেক্টর আবুল খায়ের ভূইয়ার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার থানেশ্বর গ্রামে। তার পিতা অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক মরহুম ইয়াকুব ভূইয়া এলাকায় একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। ইটনায় বাড়ি হবার সুবাধে সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ খানের প্রভাব খাটাতেন। তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সহ সাধারণ কর্মচারীরাও থাকতেন খায়েরের ভয়ে তটস্থ। প্রকাশ্যে ঘুষ বাণিজ্য ছিলো আবুল খায়েরের নেশা।
রাষ্ট্রপতির দরবার মহলের তদবিরে চাকরি জীবনে পোস্টিং নিয়েছেন সেগুনবাগিচা, লালবাগের ইমামগঞ্জ ও মতিঝিলে। পতিত সরকারের দোসর আবুল খায়েরকে মতিঝিল জোন থেকে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে বদলি করা হয়েছে। একইসাথে তার অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। সূত্রমতে, আবুল খায়ের বড় বড় ব্যবসায়ীদের ফাইল ধামাচাপা দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের নিজ এলাকা ইটনাতে। খায়ের বিভিন্ন সময়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতির আত্মীয় বলে পরিচয় দিতেন। প্রতি সপ্তাহের শেষে রাষ্ট্রপতির বাসভবনে অবাধে প্রবেশ করতেন। সেখানে কোন কাজ না থাকলেও তার যাতায়াতের কারণে স্যারদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন ক্ষমতাধর এক আবুল খায়ের।
অভিযোগ রয়েছে, রাষ্ট্রপতির সুপারিশেই বিনা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে "সোনার হরিণ" নামক চাকরিটি পেয়েছেন আবুল খায়ের ভূঁইয়া। সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী বিনা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সরকারী চাকরি হওয়ার কোন সুযোগ না থাকলেও আবুল খায়ের ভূইয়ার বিষয়টি ছিলো ব্যতিক্রম। নিয়ম বা বিধিবহির্ভূতভাবে আবুল খায়েরের চাকরি পাওয়া নিয়ে সম্প্রতি কথা উঠলেও তিনি এসব কিছুই থোড়াই কেয়ার করছেন। তবে আবুল খায়েরের নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানের আওতায় আসতে পারে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন এক কাষ্টমস ও ভ্যাট কমিশনার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাষ্টমস ও ভ্যাট কার্যালয়ে সিপাহী পদে চাকুরী পাওয়ার পর আবুল খায়ের ভূঁইয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের জীবন-মান পাল্টে যায়। কর্মকালীন সময়ে রাজস্ব আদায়ের গুরুত্বপূর্ন বিভাগ গুলোতে তিনি কর্মরত ছিলেন। কাষ্টমস ও ভ্যাট এর রাজস্ব আদায়ের অক্সিজেনখ্যাত ইমামগঞ্জ, মতিঝিল ও সেগুনবাগিচা। গুরুত্বপূর্ন এসব জায়গায় কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে আবুল খায়ের ভূঁইয়ার। এই বিভাগে কর্মকালীন সময়েই বদলে গেছে তার ভাগ্যের চাকা।
তিনি শুধু তার নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাননি বরং বদলে গেছে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যেরও ভাগ্যের চাবিকাঠি। নিজ উপজেলা ইটনার থানেশ্বর গ্রামে করেছেন অঢেল সম্পদ। অবৈধ টাকার জোরে হাজার টাকার জমি কিনেছেন লাখ টাকায়। এভাবে তিনি কোটি কোটি টাকার সম্পদ কিনেছেন। এলাকায় আবুল খায়ের থেকে বনে গেছেন খায়ের সাহেব।
পতিত সরকার ক্ষমতায় থাকলে ভবিষ্যতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন আবুল খায়ের। কিন্তু বিধি বাম। এখন সম্পদ রক্ষার জন্য দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন বিএনপি নেতাদের দ্বারে দ্বারে। আবুল খায়ের ভূঁইয়ার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে আল-মোকাদ্দীম, ছোট ছেলে মফী ও মেয়ে আফরা। তাদের চলনবলন রাজকীয়।
আবুল খায়ের ভূইয়া ২০০৯ সালে সিপাহী হিসেবে পদে যোগদান করেন। ২০০৯ থেকে ২০২৪; এই ১৫ বছরের চাকরি জীবনে হয়েছেন শত কোটি টাকার মালিক। পিতা ইয়াকুব মাস্টার মৃত্যুর আগে ছেলের ঘুষের টাকায় অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ায় এলাকার মানুষের কাছে বেশ সুনামক্ষুন্ন হয়েছিলেন। আবুল খায়ের বদলে দিয়েছেন তার স্ত্রী ফারজানা আক্তারের ভাগ্যের চাকাও। খায়ের ভূঁইয়ার স্ত্রীও এখন কোটিপতি।নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার ভূইগড় মৌজার (সি,এস,ও এস,এ-৭৯৩ আর,এস-৪০৯) দাগে ১১ তলা বিশিষ্ট তিলোত্তমা টাওয়ার নামে একটি বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ৯ কাঠা জমি কিনেছেন খায়েরের স্ত্রী। প্রায় ৫ কোটি টাকা দিয়ে ক্রয় করলেও শেয়ারে থাকা প্রতি সদস্যকে জমি ক্রয় বাবদ ফারজানা আক্তারকে দিতে হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টাকা। স্ত্রী ফারজানা আক্তার এত টাকা কোথায় পেলেন তা নিয়ে গুঞ্জন উঠলেও এসব টাকার মালিক স্বামী আবুল খায়ের। এই এলাকায় প্রশাসনের কাছে এক সময় বিশাল দাপট খাটিয়ে চলতেন আবুল খায়ের। জমি ক্রয় করার সময় সব ধরনের ক্ষমতা দেখিয়েছেন।
এলাকাবাসীর তথ্যমতে, ফারজানা আক্তার একজন গৃহিণী। ফারজানা আক্তারের পৈত্রিক সূত্রে আর্থিক অবস্থাও সচ্ছল নয়। মেয়েকে ৫০ লাখ টাকা মূল্যের জমির শেয়ার কিনে দেয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। উক্ত বহুতল ভবন নির্মানে ন্যূনতম ব্যয় হবে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার অধিক। সে হিসেবে ফারজানা আক্তারকে শেয়ার বাবদ আরও ১ থেকে সোয়া কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে তিলোতমা টাওয়ার নির্মাণে।
একজন সিপাহী হিসেবে (১৭তম গ্রেডের কর্মচারী) আবুল খায়েরের সর্বসাকুল্যে বেতন ছিলো ২৫,০০০ টাকা। ২০০৯ সালে সিপাহী পদে যোগদান করে ২০২০ সাল পর্যন্ত সিপাহী পদে কর্মরত ছিলেন। ১১ বছরে সিপাহী পদে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৩৬ লাখ টাকা বেতন ভোগ করেছেন। বেতনের টাকায় সম্ভব না হলেও অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকায় তুষারধারায় নির্মাণ করেছেন ১০তলা বিশিষ্ট বহুতল ভবন। ওই ভবনেই তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। যার প্রতিটি ফ্লাটের ন্যুনতম মুল্য ৫০ লাখ টাকা। ২০২০ সালে সিপাহী থেকে পদোন্নতি পেয়ে সাব-ইন্সপেক্টর হয়ে (১৬ গ্রেড) সর্বমোট ৩৫ হাজার টাকা বেতন পান বলে তথ্য সূত্রে জানা গেছে। এছাড়াও তুষারধারায় কোটি টাকা মূল্যের হার্ডওয়ার দোকান রয়েছে আবুল খায়েরের।
সিপাহী থেকে সাব-ইন্সপেক্টর হয়ে আবুল খায়ের তার গ্রামের বাড়ীতে মার্কেটের জন্য জমি ক্রয় করেছেন। চাষাবাদের জন্যও জমি ক্রয় করেছেন। ঢাকাতে স্ত্রীর নামে তিলোতমা টাওয়ার নির্মানে অংশীদার হয়েছেন। সেখানে বিনিয়োগ হবে সর্বমোট জমি ক্রয় সহ ১ কোটি ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। নিজে তুষারধারাতে করেছেন 'আমার বাড়ী' নামক বহুতল ভবন। এত সম্পদ ও অর্থবিত্তের উৎস কি তা জানতে চায় বিজ্ঞ মহল।
প্রশ্ন উঠেছে, আবুল খায়ের সামান্য একজন কাষ্টমস ও ভ্যাট কর্মচারী। তাহলে কাষ্টমস ও ভ্যাট অফিসের উধ্বর্তন কর্মকর্তাদের কি পরিমান অবৈধ সম্পদ রয়েছে? সূত্রমতে, কাষ্টমস ও ভ্যাট অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ সবাই রাজকীয় জীবন যাপন করেন। প্রত্যেকের রয়েছে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বাড়ি ও ফ্ল্যাট। তাদের সন্তানরা পড়াশোনা করে দেশের বাইরে কিংবা নামি দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তাদের কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয়না বলেই ঘুষ বাণিজ্যে এতো মগ্ন থাকেন।
ইতোপূর্বে ছাগল কান্ডের মতিউর ও আরজিনা সহ অসংখ্য কর্মকর্তাদের ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়ায় থামছেননা কাষ্টমস ও ভ্যাট কর্মকর্তা কর্মচারীরা।
অনুসন্ধানে প্রায় এক ডজন সাব ইন্সপেক্টর ও রাজস্ব কর্মকর্তার তথ্য উঠে এসেছে। যারা প্রত্যেকেই কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক। কাষ্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের দুর্নীতি রোধ করতে স্পেশাল কমিশন গঠন করা জরুরী বলে মনে করেন সৎ মেধাবী, নিষ্ঠাবান ও দক্ষ কর্মকর্তাগণ ।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) বেশ কিছু অভিযোগ ও মামলা ঝুলে আছে বলে জানা গেছে। তবে রাঘববোয়ালদের ফাইল গুলো ধামাচাপা পড়ে আছে। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর ফাইল গুলো নিয়ে কাজ শুরু করে দুদক।
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81