08/27/2025
বিশেষ প্রতিবেদক | Published: 2025-08-27 14:25:38
রাঘববোয়ালদের দুর্নীতি ও অর্থপাচারের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান চালানোর কারনে বিশেষ একটি গ্রুপের রোষানলে পড়েছেন বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর ও ৬ ডেপুটি গভর্নরের ব্যাংক হিসাব তলব করায় তাদের অনুসারী কর্মকর্তাদেরও রোষানলে পড়েন শাহীনুল। এছাড়া বর্তমান গভর্নরের কিছু কাজের প্রতিবাদ করা ও একাধিক ডেপুটি গভর্নর বিএফআইইউ প্রধানের বিপক্ষে অবস্থান নেন। ফলে তার বিরুদ্ধে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৮ আগস্ট পদত্যাগে বাধ্য হন বিএফআইইউর তৎকালীন প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস। এরপর দীর্ঘদিন বিএফআইইউ প্রধানের পদটি খালি থাকে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে নিয়োগ পান শাহীনুল ইসলাম। তিনি দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর ও ছয় ডেপুটি গভর্নরের ব্যাংক হিসাব তলব করেছেন। সব ব্যাংকে চিঠি দিয়ে তাদের ব্যাংক হিসাবে অর্থ লেনদেন, হিসাব খোলার ফরমসহ যাবতীয় তথ্য চান।
তিনি যে তিন গভর্নরের তথ্য চান তারা হলেন ড. আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার তিন দিন পর ৯ আগস্ট ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন আব্দুর রউফ তালুকদার। পদত্যাগের পরপরই আত্মগোপনে আছেন আব্দুর রউফ তালুকদার। সাবেক দুই গভর্নর আতিউর রহমান ও ফজলে কবিরকেও গত এক বছরে প্রকাশ্যে কোনো অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। এই তিন সাবেক গভর্নর গত আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে দেড় দশকে গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। সাবেক যেসব ডেপুটি গভর্নরদের ব্যাংক হিসাব তলব করেন তারা হলেন, দুদকের মামলায় জেলে থাকা এস কে সুর চৌধুরী এবং বিএফআইইউর প্রধান থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া মো. মাসুদ বিশ্বাস। বিএফআইইউর সাবেক প্রধান আবু হেনা মো. রাজী হাসান, সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামান, কাজী ছাইদুর রহমান ও আবু ফরাহ মো. নাছের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিএফআইইউ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক যেসব পদস্থ কর্মকর্তাদের ব্যাংক হিসাব ও বিভিন্ন নথি তলব করা হয়েছে তারা সবাই অত্যন্ত প্রভাবশালী। তাদের অনুগত ও সুবিধাভোগী অনেক কর্মকর্তা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। ওই সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ শাহীনুল ইসলামের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে কর্মরত একাধিক ডেপুটি গভর্নরের সঙ্গে নানা বিষয়ে শাহীনুল ইসলামের মতবিরোধ দেখা দেয়। ফলে তাদেরও রোষানলে পড়েন শাহীনুল ইসলাম।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বড় একটি অংশ সরাসরি শাহীনুল ইসলামের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বরাবর তারা একটি স্মারকলিপি দেন। এতে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এএফএম শাহীনুল ইসলামের একাধিক ভিডিও রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে।
স্মারকলিপিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘বিএফআইইউ প্রধান শাহীনুল ইসলাম বিতর্কিত এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহর স্থগিত করা একটি ব্যাংক হিসাব থেকে অবৈধভাবে ১৯ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছেন।’
এই বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহীনুল ইসলাম একক সিদ্ধান্তে কারও অর্থ ছাড় করার ক্ষমতা রাখেন না। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগটি উদ্দেশ্য প্রনোদিত।
এদিকে একটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ ইস্যু নিয়ে শাহীনুল ইসলামের সঙ্গে গভর্নরের মতপার্থক্য দেখা দেয় বলে জানা গেছে। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী মহলে নানান কানাঘুষা চলছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার জেরে বিএফআইইউ প্রধান এএফএম শাহীনুল ইসলামকে প্রথমে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয় এবং পরে তার বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর ও দুজন নির্বাহী পরিচালকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে সহায়তা করবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
শাহীনুর ইসলামের ঘনিষ্ঠরা জানান, শাহীনুল ইসলামের একটি ব্যক্তিগত ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা। ওই ভুয়া ভিডিও তৈরি করা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া গভীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের অংশ।
তারা আরও বলেন, ভিডিওটি সম্পুর্ণ ভূয়া। দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্র শাহীনুল ইসলামের বিরুদ্ধে সক্রিয়।তার কর্মকাণ্ডে বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ এবং প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তির স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। সে কারণেই তার অফিস ও মিটিং-সংক্রান্ত বিভিন্ন ভিডিওর সঙ্গে শাহীনুলের মুখাবয়বজুড়ে অসামাজিক ও কুরুচিপূর্ণ কনটেন্ট তৈরি করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর পর শাহীনুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের পরে দেশের পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে। এই কাজ করতে গিয়ে আমাকে অনেকের শত্রুতে পরিণত হতে হয়েছে। আমি অনেকের কোটি কোটি টাকা ফ্রিজ করেছি, মামলা করেছি। এতে প্রভাবশালীদের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এখন তারা এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাকে হেয় করার চেষ্টা করছে। আমার বিরুদ্ধে এই ধরনের ষড়যন্ত্র চালিয়ে সুবিধা নিতে চায় একটি চক্র। আমি এসবে ভয় পাই না। দেশের মানুষের অর্থ ফেরাতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাটি খতিয়ে দেখছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি আবেগের কথা জানিয়ে বিএফআইইউ প্রধান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক আমার প্রাণের প্রতিষ্ঠান। এর সুনাম রক্ষায় সবার সতর্ক থাকা উচিত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখালে প্রকৃত অপরাধী আড়ালে চলে যাবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডেপুটি গভর্নর বলেন, এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি ভুয়া ভিডিও নিয়ে বিতর্ক বিষয়টিকে পুরোটাই ষড়যন্ত্র। যারা এখন আন্দোলন করছে তারাও বিশেষ গোষ্ঠীর আজ্ঞাবহলেই মনে হচ্ছে। যেহেতু ঘটনার তদন্ত হচ্ছে তাই তদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত এবিষয়ে সবপক্ষকে অপেক্ষা করা জরুরী। একজন দক্ষ কর্মকর্তাকে এভাবে অপবাদ দেওয়া হলে ভবিষ্যতে কেউ ভালো কাজে উৎসাহী হবে না বলেও দাবী করেন ওই কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম বিএফআইইউর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর আগে তিনি সংস্থার উপপ্রধান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তিনি দেশের আর্থিক খাতে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন, যা ইতিমধ্যেই প্রভাবশালী মহলের স্বার্থে আঘাত করেছে।
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81