02/24/2025
Siyam Hoque | Published: 2020-03-22 15:59:36
'কী দুর্ভাগ্য, বাবার দাফনেও অংশ নিতে পারলাম না। শেষ সময় বাবার জন্য একটু দোয়া করতে পারলাম না। জীবনে এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনও হইনি। এমন অবস্থার কথা কল্পনাও করিনি।' ফোনের ওপাশ থেকে আতঙ্কমিশ্রিত কণ্ঠে এভাবেই নিজের কথাগুলো প্রকাশ করলেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে গতকাল শনিবার মিরপুরের একটি হাসপাতালে মারা যাওয়া এক ব্যক্তির ছেলে। গতকাল সন্ধ্যায় সমকালের সঙ্গে তিনি তার জীবনের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। বৈরী সময় কখনও কখনও মানুষকে কতটা নিষ্ঠুর ও অসহায় পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিতে পারে, তার করুণ চিত্রটিই চোখের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে ওই ভাগ্যাহত সন্তানের কথায়।
ফোন ধরেই তিনি বললেন, 'একটি নম্বর থেকে অনেকবার ফোন আসছে। ট্রু কলারে নিশ্চিত হই, এটি সমকালের একজন সংবাদকর্মীর। কয়েকবার ভেবেছি, এমন পরিস্থিতিতে ফোন রিসিভ করব না। আমিসহ পরিবারের সবাই কোয়ারেন্টাইনে রয়েছি। বাবার জন্য তীব্র কষ্ট হচ্ছে। নিজেদের জন্য ভাবছি। দেশের জন্যও চিন্তা হচ্ছে। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, ফোন করে অন্তত কিছু কথা জানাই, যাতে অন্যদের মধ্যে বিভ্রান্তি না ছড়ায়। সচেতন নাগরিক হিসেবে এটুকু বলা প্রয়োজন।' এসব কথা যিনি বলছেন, তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া সেই ৭৩ বছর বয়সী বাবার সন্তান, যার কাছে প্রিয়জন হারানোর শোক ভালো করে বুঝে ওঠারও সময় মেলেনি। তার আগেই পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে নেমে যেতে হয় করোনা সংক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার যুদ্ধে।
কোয়ারেন্টাইন থেকে শোকাহত সন্তান সমকালকে আরও বললেন, 'প্রথমেই সবাইকে এটা নিশ্চিত করতে চাই- আমার বাবা বিদেশফেরত কারও সংস্পর্শে ছিলেন না। ছোট বোনজামাই জাপানে থাকেন। দেড় বছর ধরে সেখানেই রয়েছেন তিনি। বড় দুলাভাই চট্টগ্রামে থাকেন। আমি চাকরি করি মতিঝিলে। আমার ছোট ভাইও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। গত কয়েক মাসে বিদেশফেরত কেউ আমার বাবার সংস্পর্শে আসেননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ বলছেন, 'মিরপুরের যে ব্যক্তি করোনায় মারা গেছেন, তিনি বিদেশফেরতদের সংস্পর্শের হিস্ট্রি গোপন করেছেন। মিরপুরের ওই হাসপাতাল থেকে আমরা পালিয়ে এসেছি।' এটা আমি সবাইকে শতভাগ নিশ্চিত করছি, এ ধরনের কোনো কিছু গোপন করা হয়নি। আমরা হাসপাতাল থেকে পালিয়েও চলে আসিনি। বাবাকে যাতে মিরপুরের ওই হাসপাতাল থেকে স্থানান্তর করে করোনার চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে এমন হাসপাতালে নেওয়া যায়, সে ব্যাপারে বাধ্য হয়ে পুলিশের সহায়তাও চেয়েছি। আমি জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) কর্তৃপক্ষকে সব বিষয়ে বলেছি।'
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ওই ব্যক্তির ছেলে বলেন, 'শুক্রবার দুপুরে আইইডিসিআর থেকে ফোন এলো। তারা জানালেন- আমার বাবার করোনা পরীক্ষার রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে। করোনা শনাক্ত হওয়ার পরপরই আমি, আমার ছোট ভাই এবং পরিবারের অন্যরা স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টাইনে চলে যাই। আমরা সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই কোয়ারেন্টাইনে গিয়েছি। বাবার চিকিৎসার শেষ সময়ে আমি ও আমার ছোট ভাই তার খুব কাছাকাছি ছিলাম। তাই আমরাই বেশি সতর্ক রয়েছি। অন্য কেউ যাতে আমাদের মাধ্যমে সংক্রমিত না হয়, এ ব্যাপারে শুরু থেকেই সতর্ক ছিলাম।
করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হওয়ার পর কেন মিরপুরের ওই হাসপাতাল থেকে বাবাকে অন্যত্র সরানো হয়নি, যেখানে করোনার চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ বলে আসছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বাবাকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরের জন্য আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা বলেছে, এই রোগী আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন। এমন কন্ডিশনে তাকে স্থানান্তর করা ঝুঁকিপূর্ণ।
পুলিশের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, যে প্রাইভেটকারের চালক মিরপুরের করোনা আক্রান্ত ওই ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনা-নেওয়া করেন, তিনি মিরপুরেরই বাসিন্দা। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর পর ওই প্রাইভেটকারের চালককে তার ভাড়া বাসায় উঠতে বাধা দেয় সেখানকার লোকজন। ঢাকার অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা না থাকায় নিজ বাসারই একটি কক্ষে তাকে 'হোম কোয়ারেন্টাইনে' রাখা হয়েছে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তাকে কোয়ারেন্টাইনে থাকার সময় খাবার সরবরাহের আশ্বাস দিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মিরপুরের ওই হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, গত মঙ্গলবার কল্যাণপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান ওই রোগী। সেখান থেকে ১৭ মার্চ বিকেলে তাকে মিরপুরের হাসপাতালটিতে আনা হয়। তার শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা ধরা পড়ে। এরপর তাকে বক্ষব্যাধি চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তিনিই প্রথম আশঙ্কা করেন ওই ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। এ পরিস্থিতিতে মিরপুরের ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিটের স্বল্পতা রয়েছে- এ কথা জানিয়ে প্রথমে আইইসিডিআর নমুনা সংগ্রহ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তা ছাড়া এই রোগী বিদেশফেরত নন, এমনকি বিদেশফেরত কারও সংস্পর্শেও আসেননি। তাই নমুনা সংগ্রহের প্রয়োজন নেই বলে জানান তারা। একপর্যায়ে ওই রোগীর ব্যাপারে সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা খোঁজ নিতে শুরু করেন। তাদের নির্দেশনার পরই তার করোনা পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। এভাবেই মিরপুরের ওই হাসপাতাল নিশ্চিত হয়, তাদের কাছে থাকা রোগী করোনায় আক্রান্ত। আর এটা নিশ্চিত হওয়ার পর ওই রোগীকে নিয়ে দেখা দেয় আরেক সংকট। আইইডিসিআর ছাড়াও একাধিক হাসপাতালের হটলাইনে রোগীর স্বজনরা ফোন করে তাকে স্থানান্তর করে চিকিৎসা দেওয়ার অনুরোধ করেন। তবে হটলাইন থেকে তারা কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাননি। তাই বাধ্য হয়ে রোগীকে মিরপুরের ওই হাসপাতালেই রাখতে হয়েছে। সেখানে করোনার জন্য আলাদা ইউনিট নেই। ঝুঁকিপূর্ণভাবে ওই হাসপাতালে থাকা অবস্থায় শনিবার ভোরের দিকে মারা যান করোনা আক্রান্ত ওই রোগী।
পুলিশসহ সংশ্নিষ্টরা বলছেন, মিরপুরের ওই রোগীই প্রথম ব্যক্তি, যিনি প্রবাসী কারও সংস্পর্শে না এসেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মোস্তাক আহমেদ সমকালকে বলেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তি রাজধানীর মিরপুরের টোলারবাগ এলাকার বাসিন্দা। মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের ওই বাসাতেই কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। ভবনের অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারাও সতর্কতার অংশ হিসেবে বের হচ্ছেন না। আইইডিসিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
এদিকে এ ঘটনার পর মিরপুরের ওই হাসপাতালটির আইসিইউ বন্ধ রাখা হয়েছে। কোয়ারেন্টাইনে আছেন আইসিইউর চিকিৎসক, নার্স ও ওয়ার্ডবয়রা।
মিরপুরের এক দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা জানান, টোলারবাগ ও আশপাশের এলাকায় অহেতুক বেশি লোককে তারা এক জায়গায় জড়ো হতে দিচ্ছেন না। একাধিক টিম এলাকার সড়কে টহল দিচ্ছে।
বিদেশফেরত কারও সংস্পর্শে না এসেও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা গতকাল সমকালকে বলেন, দেশে সর্বশেষ যে রোগী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, তার ব্যাপারে ইনভেস্টিগেশন চলছে। কীভাবে তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, ইনভেস্টিগেশন শেষে তা গণমাধ্যমকে জানাব।
পুলিশ সূত্র জানায়, মারা যাওয়া ব্যক্তি এক সময় একটি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন। তিনি নিয়মিত মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তেন। আশপাশের লোকজনের সঙ্গেও মিশতেন। কার কার সঙ্গে তিনি বেশি মিশতেন, এটা তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা চলছে।
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81