May 15, 2024, 3:45 am


নিজস্ব প্রতিবেদক

Published:
2023-12-21 02:43:55 BdST

রেলে নাশকতা কেন বেড়েছে, ঠেকানোর উপায় কী? 


গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকেই বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে দেশজুড়ে শত শত যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। এসব যানবাহনের অধিকাংশই যাত্রীবাহী বাস আর ট্রাক। এসব ঘটনায় প্রাণহানি যেমন ঘটেছে, তেমনি অনেকে দগ্ধ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন।

এরমধ্যেই সম্প্রতি নাশকতার ধরন পাল্টিয়ে সহিংসতা চালাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। রাতের অন্ধকার ও ভোররাতকে বেছে নিয়ে রেল চলাচল বিঘ্নিত করাকে টার্গেট করা হচ্ছে। কেটে দেওয়া হচ্ছে রেললাইন, রেললাইনের ওপর স্লিপার ফেলে রেখে নাশকতার চেষ্টা চালানো হচ্ছে, আগুন দেওয়া হচ্ছে ট্রেনে।

গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ট্রেনে নাশকতায় পাঁচ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে অনেকে। এসব সহিংসতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী ব্যবস্থা নিয়েছে সেই প্রশ্ন উঠেছে।

রেলওয়ে পুলিশ বলছে, একেবারে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব না। এরপরও সীমিত সংখ্যক পুলিশ নিয়ে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। রেলওয়ের নিজস্ব সিকিউরিটি সঙ্গে সমন্বয় করে তারা কাজ করছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

গত দেড় মাসে রেলপথের ১২টি স্থানে এবং ৫টি ট্রেনে আগুন লাগানো হয়েছে। এছাড়া তিনটি স্থানে রেললাইন কাটা এবং ফিশপ্লেটের ক্লিপ খুলে নেওয়া হয়েছে। রেলওয়ে পুলিশের ছয়টি অঞ্চলের মধ্যে নাশকতার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঢাকা অঞ্চলে।

সর্বশেষ মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) ভোরে রাজধানীর তেজগাঁও স্টেশনে নেত্রকোনা থেকে ছেড়ে আসা ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ ট্রেনের তিনটি বগিতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে এক নারী ও তার শিশুসন্তানসহ ওই ট্রেনের চার যাত্রী দগ্ধ হয়ে মারা যান। এই ঘটনায় নাশকতা ও হত্যার অভিযোগে অজ্ঞাতদের আসামি করে কমলাপুর রেলওয়ে থানায় একটি মামলা হয়েছে।

ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, আমরা আহত একজনের কাছে যেটুকু জানতে পেরেছি, ভেতরে যারা ছিল তাদের মধ্য থেকেই সেখানে কেউ আগুন দিয়েছে। সে নিজেও সেখানে ছিল। সে দেখেছে সিটের ভেতরে প্রথম আগুন দিয়েছে এবং ওই আগুন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গেছে। যেহেতু ভোর ছিল, অনেকেই ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। আমরা দেখেছি একজন মা তার সন্তানকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন, হয়তো বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন।

নিহত নাদিরার ভাই ও প্রত্যক্ষদর্শী হাবিবুর রহমান জানান, রাত ১২টার দিকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে করে তারা ঢাকায় রওনা দেন। ভোরে তাদের ঢাকায় পৌঁছানোর কথা ছিল। তার সঙ্গে ছিলেন বোন নাদিরা ও নাদিরার দুই ছেলে ইয়াসিন (৩) ও ফাহিম (৮)। তেজগাঁও স্টেশনে এসে ট্রেনটি থামলে কয়েকজন যাত্রী সেখানে নেমে যান। সেসময় তাদের পেছনের সিটে থাকা দুই জনও নেমে যায়। পরে ট্রেন চলতে শুরু করা মাত্রই পেছনের সিট থেকে আগুন জ্বলে ওঠে। মুহূর্তেই আগুন পুরো বগিতে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে দৌড়ে তিনি ফাহিমকে নিয়ে ট্রেন থেকে নামতে পারলেও ভেতরে আটকা পড়েন নাদিরা ও তার ছোট ছেলে ইয়াসিন। হুড়োহুড়ির মধ্যে তাদের কোনোভাবেই সেখান থেকে বের করতে পারেননি তিনি।

মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে নাশকতার পর এদিন রাত ১১টার দিকে দিনাজপুরের বিরামপুরে রেললাইনের ওপর স্লিপার ফেলে রেখে নাশকতার চেষ্টা চালায় দুর্বৃত্তরা। এতে একটি ট্রেনের শতাধিক যাত্রী বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন। বিরামপুর রেল স্টেশনের আউটারে পার্বতীপুর থেকে খুলনাগামী আন্তনগর সীমান্ত এক্সপ্রেসের লোকোমটিভ মাস্টার ও সহকারী লোকোমটিভ মাস্টার রেললাইনের ওপর স্লিপার দেখে তাৎক্ষণিক ট্রেনটি ব্রেক করে থামান। পরে খবর পেয়ে রেলওয়ের কর্মকর্তারা স্লিপার সরিয়ে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করেন।

এর আগে গত ১৩ ডিসেম্বর রাতে নীলফামারীর ডোমার উপজেলায় রেলপথের ৭২টি ফিশপ্লেট ক্লিপ খুলে নেয় দুর্বৃত্তরা। তবে এলাকাবাসীর ধাওয়ায় দুর্বৃত্তরা চলে যায়। এতে অল্পের জন্য রক্ষা পায় সীমান্ত এক্সপ্রেস।

ওই দিনই ভোরের আগে গাজীপুরের শ্রীপুরে দুর্বৃত্তরা ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের কিছু অংশ কেটে রাখে। এতে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি লাইনচ্যুত হলে একজন নিহত এবং ১০ জন আহত হন।

এসব ঘটনায় জড়িত অনেককেই ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ১৬ ডিসেম্বর গাজীপুরে রেললাইন কেটে নাশকতা সৃষ্টির ঘটনায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের (গাসিক) এক কাউন্সিলরসহ সাত জনকে গ্রেফতার করেছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি)। বাকিদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিভাগের রেলওয়ে পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন বলেন, "রেলপথগুলো দুর্গম হওয়ায় খুব সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মুভ করা সম্ভব হচ্ছে না। গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ সদস্যদের রেলপথ ধরেই অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে যেতে হচ্ছে। দেখা গেছে, এসব জায়গায় কোনও একটা দুর্ঘটনা ঘটলে ঘটনাস্থলে যেতেও সময় লাগছে। এখানে আমাদের কিছু অসুবিধা আছে।"

তবে রেল কর্তৃপক্ষ লাইন ক্লিয়ার আছে কিনা তা চেক করার জন্য ট্রলির মতো গাড়ি ব্যবহার করে থাকে। যে গাড়িগুলো রেললাইন ধরে চলাচল করতে পারে। সেসব গাড়ি নিয়ে যারা কাজ করে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা রেলপথ নিরাপত্তায় কাজ করবো। এছাড়া সারা দেশে রেলপথের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য আনসার মোতায়েন করা হয়েছে। তারাও আমাদের রেলওয়ে পুলিশের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কাজ করবে। আমাদের লোকবল কম হলেও সীমিত সংখ্যক সদস্য দিয়ে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

চলন্ত ট্রেনে কীভাবে আগুন লাগাচ্ছে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার আরও বলেন, দুর্বৃত্তরা রেললাইনের ফাঁকা জায়গাগুলোকে বেছে নিচ্ছে। আর সেসব জায়গাতেই নাশকতা চালাচ্ছে। আবার যাত্রীবেশে ট্রেনে উঠেও আগুন দিচ্ছে। দেখা গেছে কোনও এক স্টেশনে নামার আগেই সিটের নিচে আগুন ধরিয়ে নেমে গেছে। আমাদের ধারণা ঘটনাগুলো এভাবেই ঘটছে।

রেলওয়ে পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. দিদার বলেন, আমরা এ ধরনের নাশকতা প্রতিরোধে কাজ করছি। রেলওয়ে পুলিশ, থানা-পুলিশ, আনসার, র‌্যাব, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী, বিজিবি ও জেলা পুলিশ সমন্বয় করে নিরাপত্তা দিচ্ছি। একটা যৌথ টিম করে রেলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি যারা নাশকতা করেছে, তাদের ধরতেও অভিযান চলছে।

এই বিষয়ে রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, রেলওয়ের নিরাপত্তা জোরদারে ২ হাজার ৭০০ আনসার সদস্য মোতায়েন করা হচ্ছে। রেলপথ মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। এতে ট্রেন চলাচল করে এমন এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা চাওয়া হয়েছে।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা