নুরুজ্জামান লাবু
Published:2024-02-26 04:36:48 BdST
সম্পত্তি নিয়ে বিরোধআইন অনুযায়ী ট্রান্সকমের মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চায় পুলিশ
এক-দুই কোটি নয়, ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেছেন ট্রান্সকমের প্রয়াত চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের মেয়ে শাযরেহ হক।
অভিযোগ অন্য কারও বিরুদ্ধে নয়, ‘জাল-জালিয়াতি করে এই টাকা আত্মসাৎ করেছেন’ নিজের বড় বোন ট্রান্সকম গ্রুপের বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সিমিন রহমান ও মা বর্তমান চেয়ারম্যান শাহনাজ রহমান।
ট্রান্সকমের এই হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জের ধরে কোম্পানির পাঁচ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
গ্রেফতারের একদিন পর তাদের আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু আদালত শুনানি শেষে গ্রেফতারকৃত পাঁচ কর্মকর্তার জামিন মঞ্জুর করে।
জামিনে শর্ত দেওয়া হয়েছিল— আদালতে তাদের পাসপোর্ট জমা দিতে হবে। কিন্তু রবিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) তারা আদালতে উপস্থিত হয়ে পাসপোর্ট জমা দেননি। এই কারণে আদালত তাদের জামিন বাতিল করে গ্রেফতারের জন্য ওয়ারেন্ট জারি করেছে।
এদিকে ট্রান্সকমের পাঁচ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হলেও মূল তিন আসামি এখনও পলাতক রয়েছেন। তারা হলেন— ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রয়াত লতিফুর রহমানের স্ত্রী শাহনাজ রহমান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও লতিফুর রহমানের বড় মেয়ে সিমিন রহমান ও সিমিন রহমানের ছেলে যারেফ আয়াত রহমান।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। মামলার তদন্ত ও আইন অনুযায়ী, ট্রান্সকমের মালিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনর প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘মামলা হয়েছে। আইন অনুযায়ী যা ব্যবস্থা নেওয়ার তা নেওয়া হবে। এখানে আসামি কে কিংবা আসামির পরিচয় কী, তা বিবেচ্য বিষয় নয়। আইন যা বলবে তাই করা হবে।’
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, আসামিদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। তাদের অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা চলছে। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা করছেন, আসামিরা এখনও দেশেই অবস্থান করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টার পর থেকে সিমিন রহমানের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরটি বন্ধ রয়েছে। আর মামলা দায়েরের পর গত ২২ ফেব্রুয়ারি বিকাল সাড়ে ৫টা থেকে ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহনাজ রহমানের মোবাইল ফোনটি বন্ধ রয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ওই সূত্র জানায়, আসামিরা বিদেশে পালিয়ে গিয়েছে কিনা, সেজন্য ইমিগ্রেশনের মাধ্যমে জানার চেষ্টা চলছে। দেশে অবস্থান করলে তারা যেন বিদেশে যেতে না পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দেশের সবকটি ইমিগ্রেশন পয়েন্টে চিঠি দেওয়া হবে।
গত বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) ট্রান্সকম গ্রুপের দুই পরিচালক (করপোরেট ফাইন্যান্স) কামরুল হাসান ও আব্দুল্লাহ আল মামুন, আইন উপদেষ্টা ফখরুজ্জামান ভূঁইয়া, ম্যানেজার আবু ইউসুফ মো. সিদ্দিক এবং সহ-কোম্পানি সেক্রেটারি মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে গ্রেফতার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
ওই দিনই দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীল গুলশান থানায় ট্রান্সকমের চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও পাঁচ কর্মকর্তাসহ আট জনের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেন ট্রান্সকমের একজন পরিচালক শাযরেহ হক। মামলার বাদী শাযরেহ হক প্রয়াত লতিফুর রহমানের ছোট মেয়ে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২০ সালের ১ জুলাই লতিফুর রহমান মারা যাওয়ার পর থেকেই ট্রান্সকমের হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। লতিফুর রহমান বেঁচে থাকতেই ট্রান্সকম গ্রুপে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসা বড় মেয়ে সিমিন রহমান বেশিরভাগ সম্পত্তি নিজের করায়ত্ত করে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
প্রথম মামলার অভিযোগে ছোট মেয়ে শাযরেহ হক বলেছেন, ‘আমার পিতা মৃত লতিফুর রহমান তার জীবদ্দশায় ট্রান্সকম লিমিটেডের ২৩ হাজার ৬০০টি শেয়ারের মালিক থাকা অবস্থায় গত ২০২০ সালের ১ জুলাই মারা যান। আমিসহ অন্যান্য উত্তরাধিকারী আমার পিতার ওই শেয়ারের মুসলিম শরিয়া আইন অনুযায়ী মালিক। আমার পিতা দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ থাকা অবস্থায় কুমিল্লাতে মৃত্যুবরণ করেন। মারা যাবার প্রায় এক বছর আগে থেকেই তিনি কুমিল্লাতে অবস্থান করছিলেন। আমার পিতার ২৩ হাজার ৬০০ শেয়ার থেকে এক নম্বর আসামি (সিমিন রহমান) আমাকে এবং আমার ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে বঞ্চিত করার জন্য অবৈধভাবে নিজের নামে বেশি শেয়ার ট্রান্সফার করে হস্তগত করার হীন অসৎ উদ্দেশ্যে এক নম্বর আসামি ২ থেকে ৫ নম্বর আসামিদের (ট্রান্সকম কর্মকর্তা) প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তিনটি ফর্ম ১১৭ (হস্তান্তর দলিল)সহ আরও গুরুত্বপূর্ণ শেয়ার ট্রান্সফারের বিভিন্ন কাগজপত্র আমার এবং আমার ভাইয়ের অজ্ঞাতসারে বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে তৈরি করেন। আমার পিতার মৃত্যুর পর জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা কাগজপত্র ৩ নম্বর আসামি (কামরুল হাসান) রেজিস্ট্রার অব জয়েন স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে জমা দেন। এক নম্বর আসামি (সিমিন রহমান) থেকে অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে ৪ ও ৫ নম্বর আসামি (মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ও আবু ইউসুফ মো. সিদ্দিক) জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা কাগজে সাক্ষী হিসেবে সই করেন।’
শাযরেহ হক মামলার এজাহারে বলেছেন, আসামিরা পরস্পর ষড়যন্ত্র করে আমার, আমার পিতার, এবং আমার ভাইয়ের সই জাল করে নিজেরাই ফর্ম ১১৭-তে সই করেন। শাযরেহ হক মামলায় বলেন, আমার পিতার মারা যাবার পর প্রথমে ২ নম্বর আসামি (আইন উপদেষ্টা ফখরুজ্জামান ভূঁইয়া) গত বছরের ২৩ মার্চ এবং পরবর্তীকালে ২ ও ৩ নম্বর আসামি (কামরুল হাসান) ১৪ মে আমাকে জানায় যে, ‘আপনার পিতা আপনিসহ আপনার ভাইবোনদের শেয়ার হস্তান্তর করে দিয়েছেন। পরে আমি জয়েন স্টক থেকে শেয়ার হস্তান্তরের নথিপত্র সংগ্রহ করি। অনলাইনের ওই দলিলাদি অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১৩ জুন আমার পিতা আমাকে চার হাজার ২৭০টি শেয়ার, আমার ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে চার হাজার ২৭০টি শেয়ার এবং এক নম্বর আসামিকে (সিমিন রহমান) ১৪ হাজার ১৬০টি শেয়ার হস্তান্তর করেছেন মর্মে ৩ নম্বর আসামি কামরুল শেয়ার হস্তান্তর সংক্রান্ত দলিল দাখিল করেছেন।’
শাযরেহ হক মামলার এজাহারে বলেন, কোনও সময়ই আমি কিংবা আমার ভাই ওই হস্তান্তর সংক্রান্ত ফর্ম-১১৭ দলিলে সই কিংবা টিপসই প্রদান করিনি। আমার পিতা তার জীবদ্দশায় কখনও হস্তান্তর সংক্রাক্ত দলিলে সই কিংবা টিপসই করেননি। আসামিরা জাল-জালিয়াতি করে শরিয়া অনুযায়ী উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টন না করে আমাদের সই জাল করে শেয়ার হস্তগত করেছেন।’
দ্বিতীয় মামলার এজাহারে শাযরেহ হক বলেন, আমিসহ অন্যান্য উত্তরাধিকারী আমার পিতার সব স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তির মুসলিম শরীয়া আইন অনুযায়ী ওয়ারিশ। এক নম্বর আসামি (সিমিন রহমান) ও দুই নম্বর আসামি (শাহনাজ রহমান) আমার পিতার প্রতিষ্ঠিত ট্রান্সকম গ্রুপের শেয়ার এবং পজিশন নিজেদের অনুকূলে হস্তগত করার অসৎ উদ্দেশ্যে ৩-৫ নম্বর আসামির (ফখরুজ্জআমান ভুইয়া ও যারাইফ আয়াত হোসেন) সহযোগিতায় জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ডিড অব সেটলমেন্ট তৈরি করেন। যেখানে আমার, আমার পিতার এবং আমার ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের সই জাল করে আসামিরা নিজেরাই সই করেন। আসামিরা আমার দুই ছেলে যোহেব আসরার হক এবং মিকাইল ইমান হকের সই জাল করে নিজেরাই ডিড অব সেটলমেন্টের সাক্ষীর কলামে সই করেন। আমাদের সঙ্গে আমাদের পিতা এবং এক নম্বর আসামি সিমিন রহমান ও ২ নম্বর আসামি শাহনাজ রহমানের সঙ্গে কখনও কোনোকালে ডিড অব সেটলমেন্ট সম্পদিত হয়নি। আমি, আমার পিতা, আমার ভাই ও আমার দুই ছেলে ডিড অব সেটলমেন্টে কখনও কোনও সই করিনি।
শাযরেহ হক মামলায় অভিযোগ করেন, আসামিরা অসৎ ও অসাধু উপায় অবলম্বন করে আমাকে এবং আমার ভাইকে আমার পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তি— যার মূল্য আনুমানিক ১০ হাজার কোটি টাকা বা তার বেশি, নিজেদের নামে কুক্ষিগত করার হীন উদ্দেশ্যে জাল ডিড অব সেটলমেন্ট সম্পাদন করেন।’
শাযরেহ হক বলেন, ‘কথিত ডিড অব সেটলমেন্টের অস্তিত্বের বিষয়ে আমি প্রথম জানতে পারি ৩ ও ৪ নম্বর আসামির (ফখরুল ভূইয়া ও কামরুল হাসান) কাছে, যখন গত বছরের ১৪ মে তাদের কাছে আমার পিতার রেখে যাওয়া শেয়ারের বণ্টনের জন্য উত্তরাধিকার সনদের বিষয়ে কোনও অগ্রগতি হয়েছে কিনা, তার খোঁজ নেই। তাদের কাছে কথিত ডিড অব সেটলমেন্টের কপি সরবরাহ করতে বললে, তারা তা সরবরাহ করতে অস্বীকার করেন। ইতোমধ্যে আসামিরা কথিত ডিড অব সেটলমেন্ট ব্যবহার করে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন ও এক সপ্তাহ পর প্রত্যাহার করে নেন। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর আমি এই জাল দলিলের সন্ধান পাই।’
শাযরেহ হকের অভিযোগ, ৩ নম্বর আসামি (ফখরুল) তার অপকর্মের পুরস্কার হিসেবে ২০২১ সালে কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স- লিগ্যাল) হিসেবে প্রমোশন পায়। ৪ নম্বর আসামি (কামরুল) তার অপকর্মের পুরস্কার হিসেবে ২০২৩ সালে কোম্পানির পরিচালক হিসেবে অবৈধভাবে নিয়োজিত হন এবং ১০০টি শেয়ার দুই নম্বর আসামির (শাহনাজ রহমান) কাছ থেকে অভিহিত মূল্যে খরিদ করেন, যা বেআইনি।’
তৃতীয় মামলায় শাযরেহ হক বলেন, আমার পিতা জীবিত থাকা অবস্থায় প্রাইম ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, এইচএসবিসি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকে তার নামীয় বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট এবং এফডিআরে প্রায় একশ কোটি টাকা রেখে যান। আমিসহ অন্যান্য ওয়ারিশ আমার পিতার রেখে যাওয়া প্রায় একশ কোটি টাকার মুসলিম শরিয়া আইন অনুযায়ী হকদার। এক নম্বর আসামি (মা শাহনাজ রহমান) নমিনি ট্রাস্টি ছিলেন। এক নম্বর (শাহনাজ রহমান) আসামি ও দুই নম্বর (সিমিন রহমান) আসামি আমার পিতার প্রায় একশ’ কোটি টাকা সব ওয়ারিশের মধ্যে বণ্টন না করে আত্মসাৎ করার হীন উদ্দেশ্যে অন্যান্য আসামির সহযোগিতায় আমার পিতার মৃত্যুর পর নিজের অ্যাকাউন্টে সরিয়ে ফেলেন। পরবর্তীকালে এক নম্বর আসামি (শাহনাজ রহমান) ট্রান্সকম ইলেকট্রনিক্স থেকে নিজের নামে ট্রান্সকম লিমিটেডের ১৮ শতাংশ শেয়ার ৬০ কোটি টাকা দিয়ে কেনার বাহানা করে নিজের নামে হস্তগত করেন। ওই শেয়ার পুনরায় এক নম্বর আসামি (শাহনাজ রহমান) দুই নম্বর আসামিকে (সিমিন রহমান) দান করেন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, এক নম্বর আসামি দুই নম্বর আসামিকে ট্রান্সকম লিমিটেডের মেজরিটি শেয়ার পাইয়ে দেওয়া এবং ট্রান্সকম গ্রুপে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার হীন উদ্দেশ্যে পরস্পর যোগসাজেশে অবৈধভাবে বিশ্বাস ভঙ্গ করে সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছেন।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.