April 27, 2024, 4:38 pm


বিশেষ প্রতিবেদক:

Published:
2024-03-18 11:07:34 BdST

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরেজন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর মজুদশূন্যতার মধ্যে টেন্ডার কেলেংকারি!


একে তো জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর মজুদশূন্যতা অন্যদিকে আইন বহিঃর্ভূতভাবে দরপত্র বাতিলের ঘটনা! সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্য কোন স্বার্থন্বেষী গ্রুপ এসব কাজ করছে না তো? অধিদপ্তর থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে কথা হলো যাদের সকলেরই মুখে এই একই প্রশ্ন।

সাম্প্রতিককালে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সংকটের কথা কারো অজানা নয়। বিগত ৩-৪ মাস যাবৎ জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবার ঔষধ সামগ্রীর মজুদশূন্যতার বিষয় সারাদেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ডাঃ সামন্ত লাল সেন প্রয়োজনী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আশ্বস্ত করলেও এখন পর্যন্ত কোন আলোর মুখ দেখা যাচ্ছে না।

কারণ কয়েকদিন আগেই ৪৫ মিলিয়ন সাইকেল খাবার বড়ি (তৃতীয় প্রজন্ম) এর সকল দরপত্র বাতিল করা হয়েছে মর্মে আদেশ জারি করা হয়েছে। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানানোর পর বেশ কয়েকজন প্রকিউরমেন্ট এক্সপার্ট এই বাতিলের ঘটনাকে পিপিএ, ২০০৬ এবং পিপিআর, ২০০৮ এর ব্যত্যয় হিসেবেই বিশ্লেষণ করেছেন এবং পিপিআর অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে মত প্রকাশ করেছেন।

১৩ মার্চ, ২০২৪ তারিখ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপকরণ ও সরবরাহ ইউনিটের পরিচালক (উপকরণ ও সরবরাহ), জাকিয়া আক্তার স্বাক্ষরিত দরপত্র বাতিলের একটি আদেশ আমাদের হাতে এসেছে। ক্রয়কারী পরিচালক (উপকরণ ও সরবরাহ) এই ক্রয়ের দরপত্র বাতিলে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন মর্মে জানা যায়। মূল্যায়ন কমিটির কয়েকেজন সদস্য এই বিষয়ে সত্যতা স্বীকার করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায় ২ জানুয়ারী, ২০২৪ তারিখ ৪৫ মিলিয়ন খাবার বড়ির (তৃতীয় প্রজন্ম) জন্য OTM (NCT) পদ্ধতিতে প্রাক্তণ পরিচালক (উপকরণ ও সরবরাহ), মর্জিয়া হক দরপত্র আহবান করেন। প্রাথমিকভাবে ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ তারিখ দরপত্র উন্মুক্তকরণের জন্য নির্ধারিত থাকলেও ২৮.০১.২০২৪ খ্রি. তারিখ যোগদানকৃত পরিচালক (উপকরণ ও সরবরাহ), জাকিয়া আক্তার নতুন পদে যোগদান করেই ৩১ জানুয়ারী, ২০২৪ তারিখ দরপত্র উন্মুক্তকরণের সময় পিছিয়ে ১২ জানুয়ারীতে নিয়ে যান। এর পর তিনি দুই দফা দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করে এই দরপত্র উন্মুক্তকরণের সময় প্রায় ১ মাস পিছিয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৮ এ নিয়ে যান। এভাবে বার বার দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন এবং দরপত্র উন্মুক্তকরণের পর দরপত্র বাতিলের ঘটনাকে এই অধিদপ্তরের অনেকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে মন্তব্য করেছেন।

দরপত্র উন্মুক্তকরণে দেখা যায় ৫ টি লটে ৪৫ মিলিয়ন খাবার বড়ি (তৃতীয় প্রজন্ম) সংগ্রহের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়। লট-১, ২ ও ৩ এর জন্য রেনেটা লিমিটেড ও টেকনো ড্রাগস লিমিটেড এবং লট-৪ এবং ৫ জন্য পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস্ লিমিটেড দরপত্র দাখিল করেছে।

লট-১, ২, ও ৩ এর রেনেটা লিমিটেড প্রতি সাইকেল খাবার বড়ির (তৃতীয় প্রজন্ম) জন্য উদ্ধৃত ইউনিট মূল্য ৪৯.৭৫ টাকা পক্ষান্তরে ওই লট সমূহে টেকনো ড্রাগস লিমিটেড এর উদ্ধৃত ইউনিট মূল্য ৪৬.৮৫ টাকা।

অর্থ্যাৎ প্রত্যেক লটেই রেনেটা লিমিটেডের চেয়ে দরদাতা টেকনো ড্রাগ্স লিমিটেড ২ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা করে কম মূল্য প্রস্তাব করেছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর প্রতি সাইকেল খাবার বড়ি ৫০.৫০ টাকায় μয়ের জন্য দাপ্তরিক প্রাক্কলিত মূল্য নির্ধারণ করেছে। এছাড়া লট-৪ এবং ৫ এ পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস্ লিমিটেড একক দরদাতা হলেও তাদের উদ্ধৃত ইউনিট মূল্য
(৪৯.৭৫ টাকা) পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নির্ধরিত ক্রয় মূল্যের নিম্নে।

দরপত্র আহবানের প্রায় ৫৭ দিন পর দরপত্র উন্মুক্তকরণের জন্য নির্ধারণ করা হলেও মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে তড়িঘড়ি করে এই ক্রয়ের সকল দরপত্র বাতিল করা হয়েছে। এতেই ঘটেছে বিপত্তি!

Supply Chain Management Portal এর তথ্য অনুযায়ী দেশের ৪৯ টি উপজেলা স্টোরে খাবার বড়ি (তৃতীয় প্রজন্ম) Stockout হয়ে আছে। এছাড়াও ১০০ টি উপজেলা স্টোরে Potential Stockout, ১৫৭ টি উপজেলা স্টোরে Under Stock। অর্থ্যাৎ অতি শীঘ্রই ৩০৬টি উপজেলার পরিবার পরিকল্পনা স্টোরে কোন খাবার বড়ি (তৃতীয় প্রজন্ম) থাকবে না। এ ধরনের সংকটের মধ্যেও এমন কি ঘটল যার ফলে সকল দরপত্র বাতিল করতে হলো।

এই বিষয়ে ক্রয়কারী- জাকিয়া আক্তারের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। এছাড়া উপকরণ ও সরবরাহ ইউনিটের একাধিক কর্মকর্তাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তাঁরাও কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। এমনকি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কোন রেসপন্স করেননি।

বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির (বিপিপিএ) প্রাক্তন সিপিটিউর কয়েকজন প্রকিউরমেন্ট এক্সপার্ট এর সাথে এ বিষয়ে কথা বলা হলে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, পিপিআর অনুযায়ী কিছু পরিস্থিতি রয়েছে যেগুলো ঘটলে দরপত্র বাতিল হতে পারে। তবে এসবের প্রমাণক থাকতে হবে। তবে দরপত্রে সকল শর্তপূরণ করলে এবং দাপ্তরিক প্রাক্কলিত সীমার মধ্যে যদি কোন দরপত্র পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে দরপত্র বাতিল না করার বিষয়ে পিপিআর গাইড করেছে। তবে অন্যায়ভাবে দরপত্র বাতিলের ফলে কোন দরদাতা যদি সংক্ষুব্ধ হয় তাহলে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ করার সুযোগ আছে।

প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ অভিযোগের প্রেক্ষিতে তা নিষ্পত্তি করতে পারে। প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে যদি দরদাতা প্রতিষ্ঠান সন্তুষ্ট না হয় তাহলে সিপিটিউর রিভিউ প্যানেল সহ আদালত পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে মতামত পাওয়া যায়।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বিগত ৮-১০ বছরের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ক্রয়ের তথ্য থেকে জানা যায় রেনেটা লিমিটেড, টেকনো ড্রাগস লিমিটেড, নুভিস্তা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড বেশিরভাগ জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সরবরাহ করে আসছে।

এবছরও এসকল প্রতিষ্ঠানসমূহ উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে দরপত্রে অংশগ্রহণ করে এর মধ্যে প্রথম তিনটি লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে টেকনো ড্রাগস লিমিটেড এবং লট-৪ ও ৫ এ পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড একক দরদাতা হিসেবে অংশগ্রহণ করেছে। যেহেতু প্রথম তিনটি লটে রেনেটা লিমিটেডের তুলনায় টেকনো ড্রাগ্স লিমিটেড প্রতি লটে ২ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা করে কম মূল্য উদ্ধৃত করেছে সেহেতু দরপত্রের সকল শর্ত পালন করলে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিতে আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া সিপিটিউর প্রকিউরমেন্ট এক্সপার্ট এর মতামত অনুযায়ী পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর নির্ধারিত মূল্যসীমার মধ্যে থাকায় লট-৪ ও ৫ এর দরদাতাকেও কার্যাদেশ দিতে আইনগত বাধা নেই। বিগত ৮-১০ বছর এই সকল দরপত্রে এভাবেই কার্যদেশ প্রদান করা হয়েছে।

আইনগত বাধা না থাকা সত্ত্বেও এভাবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে দরপত্র বাতিলের ঘটনা নজিরবিহীন।

আমাদের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বর্তমান পরিচালক (উপকরণ ও সরবরাহ) জাকিয়া আক্তারের আপন ভাই নুভিস্তা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। নুভিস্তা ফার্মা লিমিটেড কখনো রেনেটা লিমিটেড, কখনো টেকনো ড্রাগস লিমিটেড, কখনো পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এর সাথে যৌথভাবে দরপত্রে অংশগ্রহণ করে। এবার তারা রেনেটা লিমিটেড এর সাথে যৌথভাবে দরপত্রে অংশগ্রহণ করেছে। রেনেটা লিমিটেড অধিক মূল্য প্রস্তাব করে দরপত্র থেকে ছিটকে পড়েছে বিধায় এই ক্রয়ের সকল দরপত্র বাতিলে পরিচালক (উপকরণ ও সরবরাহ) ভূমিকা রেখেছেন মর্মে অনেকেই আশংকা করছেন। পিপিআর, ২০০৮ অনুযায়ী ক্রয়ের সাথে সম্পৃক্ত কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর কোন দরদাতার সাথে কোনরুপ সম্পর্ক থাকার সুযোগ নেই।

উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে কিভাবে এই ধরনের একজন কর্মকর্তা ক্রয়ের মত সংবেদনশীল পদে চাকুরী করছেন তা খতিয়ে দেখার দাবী করেছেন খোদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ। তার দুর্নীতি-অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সম্প্রতি অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে কাওরান বাজারে লাগানো ব্যানার-পোস্টারও এই  প্রতিবেদকের চোখে পড়েছে।

ইতিপূর্বে এই ইউনিটেই কর্মরত থাকাকালীন এই কর্মকর্তা ট্যাব ক্রয়সহ বিভিন্ন ক্রয়ের অনিয়মের সাথে জড়িয়েছেন। এ সংক্রান্ত তদন্তের পর তাকে এ ইউনিট থেকে অডিট ইউনিটে বদলী করা হয়। এই কর্মকর্তা অধিদপ্তরের আইইএম ইউনিটে কর্মরত থাকা অবস্থায় বিভিন্ন কাজে দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে যুক্ত হওয়ার কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পর্যন্ত যেতে হয়েছে।

বর্তমান সরকারের অত্যন্ত সফল একটি কর্মসূচীকে বাধাগ্রস্থ করে দেশে ও বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে কিনা তা টেন্ডার কেলেংকারির সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবী রাখে।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা