April 30, 2024, 1:37 am


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2024-04-07 07:25:34 BdST

সমবায় সমিতির নামে আড়াই হাজার কোটি টাকা লোপাট


জামালপুরের মাদারগঞ্জে সমবায় কার্যালয়ের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে তোলা হয়েছে সমবায় সমিতি। নামে সমবায় সমিতি হলেও এসব সমিতির ব্যানারে পরিচালনা করা হয় ব্যাংকিং কার্যক্রম। ব্যাংকের চেয়ে উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে সমবায় সমিতিগুলো প্রায় ৫০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকা। শুরুর দিকে গ্রাহককে কিছু মুনাফা দিলেও বর্তমানে সমবায় সমিতির লোকজন টাকা নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে।

ফলে সর্বস্ব হারিয়ে দিশাহারা এসব সমিতির গ্রাহকরা। আর জেলা প্রশাসন বলছে, কীভাবে এত প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পেল এবং আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা করল সেটি তদন্ত করে দেখা হবে।

সরেজিমন দেখা গেছে, উপজেলাজুড়ে আবাসিক এবং বাণিজ্যিক ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন নামে বহুমুখী সমবায় সমিতি। এর মধ্যে রয়েছে মাদারগঞ্জ আল-আকাবা বহুমুখী সমবায় সমিতি লি., শতদল বহুমুখী সমবায় সমিতি, জনতা শ্রমজীবী সমবায় সমিতি, স্বাধীন ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি, রংধনু ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি, নবদ্বীপ বহুমুখী সমবায় সমিতি, আনন্দ সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি, জনকল্যাণ কৃষি সমবায় সমিতি, অগ্রগামী কৃষি উন্নয়ন সমিতি, সাত রং কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতি, নব কল্যাণ কৃষি সমবায় সমিতি, স্বদেশ বহুমুখী সমবায় সমিতি, রূপসী বাংলা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি, স্বপ্নতরী সমবায় সমিতি, শ্যামল বাংলা সমবায় সমিতিসহ শতাধিক সমবায় সমিতি।

সবই অবৈধভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এক ভবনেই পাওয়া গেছে অন্তত ১০টি সমিতির কার্যালয়। এসব সমিতিতে একেক জন গ্রাহক সর্বনিম্ন ২ লাখ থেকে শুরু করে কোটি টাকা পর্যন্ত আমানত রেখেছেন। এর মাঝে আল-আকাবা এবং শতদল বহুমুখী সমিতির নামেই রয়েছে অন্তত ২০ হাজার গ্রাহকের হাজার কোটি টাকার ওপরে আমানত।

জেলা সমবায় কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, তাদের সাত ক্যাটাগরির সমবায় সমিতির মধ্যে মাদারগঞ্জে নিবন্ধিত বহুমুখী সমবায় সমিতি রয়েছে ২৮টি, সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি ৩১টি, ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি ২৫টি, কৃষি সমবায় সমিতি ৭৯টি, শ্রমজীবী সমবায় সমিতি ১৩টি, মহিলা সমবায় সমিতি একটি এবং মৎস্য সমবায় সমিতি চারটি। মহিলা এবং মৎস্য সমবায় সমিতি পরিচালনায় অনিয়ম না থাকলেও বাকি পাঁচটি ক্যাটাগরির কার্যক্রমে অনিয়ম রয়েছে। যে কারণে ৫২টি সমবায় সমিতির নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। এরই মধ্যে ২১টি সমবায় সমিতির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে এবং বাকিগুলোর বিষয়ে তদারকি চলছে।

এ ছাড়া সমবায় কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত আল-আকাবার আমানত ৪১৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা, শতদলের ২২১ কোটি ৮৫ লাখ ৮১ হাজার ৫৫ টাকা, নবদ্বীপ ২৫ কোটি ৮০ লাখ, স্বদেশের ৫৬ কোটি ৮৭ লাখ ৫৭ হাজার ৫১ টাকা।

এ ছাড়া বাকি সমিতিগুলোর আমানত ১ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা বলা হলেও বাস্তবে এসব সমিতির আমানতের পরিমাণ সমবায় কার্যালয়ের হিসাবের চাইতে দুই থেকে তিনগুণ বেশি।

জানা গেছে, বেশির ভাগ বড় আমানতকারীদের আয়ের উৎস এবং আয়কর রিটার্ন না থাকায় তারা আমানতের টাকার দাবি নিয়ে প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না। নিজেদের বড় অংকের টাকা গচ্চা যাচ্ছে জেনেও নিজের পরিচয় গোপন রাখছেন। এই সুযোগটিকেই কাজে লাগিয়েছে সুযোগ সন্ধানী সমবায় সমিতির মালিকরা। বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংক যেখানে গ্রাহকদের লাখপ্রতি আমানতের বিপরীতে হাজার খানেক টাকা মুনাফা দিয়ে থাকে, সেখানে এসব সমবায় সমিতি গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে প্রতি লাখ টাকার বিপরীতে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা মুনাফা দেওয়ার প্রলোভন দেয়। আর ব্যাংকের চেয়ে বেশি মুনাফা পাওয়ার আশায় প্রবাসী এবং অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীরা তাদের সারা জীবনের কষ্টার্জিত অর্থের পুরোটাই সমিতিতে জমা রেখেছেন। কেউ আবার খেয়ে না খেয়ে, ভিটে-মাটি, গরু-ছাগল বিক্রি থেকে শুরু করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে এসব সমিতিতে টাকা জমা রেখেছেন। বর্তমানে প্রায় সব সমিতির কার্যালয়ে তালা ঝুলছে, আর গ্রাহকরা লভ্যাংশ তো দূরের কথা জমানো আমানত কীভাবে ফিরে পাবেন- তার আশায় প্রতিদিন সমিতির কার্যালয়ের সামনে এসে ভিড় করছেন।

ভুক্তভোগীরা জানান, আমানতের টাকা ফেরত চাইলে সমিতির লোকজন বার বার তারিখ দিয়ে ঘুড়াচ্ছে তাদের। বর্তমানে সমিতির অফিস বন্ধ থাকায় মুঠোফোনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে টাকার পরিবর্তে জমি নিতে বলছেন। কিন্তু সেই জমির বর্তমান বাজারমূল্য ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা শতাংশ হলেও তারা সেই জমির মূল্য ধরছে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা শতাংশ। এ দামে জমি নিতে না চাইলে টাকা দিতে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে দিচ্ছে সমিতিগুলো। অথচ গ্রাহকদের টাকার পরিবর্তে যে জমি তাদের নিতে বলছে সমবায় সমিতিগুলো, সে জমি গ্রাহকদের কাছ থেকেই স্বল্পমূল্যে কিনে। আবার সেই জমি বিক্রির টাকা আমানত হিসেবে জমা রেখে দিয়েছিল সমবায় সমিতিগুলো। কাগজে-কলমে জমি বিক্রি এবং মালিকানা পরিবর্তন হলেও জমি বিক্রির টাকা কখনো স্পর্শ করে দেখতেই পারেননি গ্রাহক তথা ভূমির মালিকরা।

এসব সমিতির বেশিরভাগ মালিকরা জামায়াতে ইসলামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, রয়েছেন কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাও। সমিতির মালিকরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারছেন না ভুক্তভোগীরা।

সম্প্রতি জামালপুর ডিবি পুলিশ মাদারগঞ্জে অভিযান চালিয়ে শতদল, নবদ্বীপসহ একাধিক সমবায় সমিতির কয়েকজন কর্মচারীকে গ্রেফতার করলেও এখন পর্যন্ত মালিক পক্ষের লোকজন রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ডিবি পুলিশের অভিযানে আটক শতদল বহুমুখী সমবায় সমিতির ম্যানেজার দাবি করেন, তাদের ৫ হাজার গ্রাহকের ২৪৬ কোটি টাকার আমানতের মধ্যে ৪২ কোটি টাকা এরই মধ্যে তারা ফেরত দিয়েছেন। তাদের টাকা জমির মধ্যে লগ্নি করা আছে। জমি বিক্রয় সাপেক্ষে তারা ছোট গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিচ্ছেন এবং বড় গ্রাহকের জমির বিনিময়ে টাকা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

মাদারগঞ্জ কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির সভাপতি এবং রূপসী বাংলা সমবায় সমিতির চেয়ারম্যান স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রায়হান রহমতুল্লাহ রিমু অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ টাকা লেনদেনের বিষয়টি স্বীকার করে জানান, নিয়ম না থাকলেও সবাই যেভাবে টাকা লেনদেন করেছে, আমরাও সেভাবে করেছি। তবে টাকা নিয়ে সমিতির অন্য পরিচালকরা ঝামেলা করছে বুঝতে পেরে তিনি কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি এবং রূপসী বাংলা দুই প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক মাস আগে পদত্যাগ করেছেন বলে দাবি করেন।

এসব ব্যাপারে জেলা সমবায় সমিতির কর্মকর্তা মো. আবদুল হান্নান সমবায় আইনে ব্যাংকিং কার্যক্রম করা সম্পূর্ণ নিষেধ জানিয়ে বলেন, সমবায় সমিতিগুলো আমাদের কাছ থেকে নিবন্ধন নিয়ে গোপনে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, আর যারা টাকা রেখেছে তারা সমবায়ী না, তারা লোভে পড়ে টাকা রেখেছে। আমরা অডিট করতে গেলে এসব কার্যক্রম আমাদের কাছে গোপন রাখা হতো। কেউ সমবায় সমিতিতে টাকা রাখলে এটা আমাদের দায়-দায়িত্ব না।

তিনি বলেন, সমিতির নিবন্ধন দেওয়া কোনো দোষের কিছু না, তবে আমাদের কেউ এই অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জেলা প্রশাসক শফিউর রহমান জানান, সমবায় সমিতিতে যারা টাকা রেখে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা অভিযোগ করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারপরও আমরা সরেজমিন তদন্ত করে দেখব, কেন এত প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে এবং তারা বিধি মেনে আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে কি না।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা