September 21, 2024, 6:49 am


নেহাল আহমেদ

Published:
2024-05-19 20:16:31 BdST

১৯২১ সালে গোয়ালন্দের ইতিহাসে জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ হয়েছিলো?


গোয়ালন্দ ঘাট স্টেশন দিয়ে সেকালে আসামের চা–বাগানে শ্রমিক পাঠানো হতো। সে জন্য এখানে একটি ডিপোর ব্যবস্থা ছিল। অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট, এজেন্ট এবং মেডিকেল ইন্সপেক্টররা এখানে চা–শ্রমিকদের বহির্গমন ও অভিবাসনের কাজ তদারক করত। শ্রমিক নির্যাতনের এক লোমহর্ষক ঘটনার সাক্ষী এই গোয়ালন্দ ঘাট।

এ প্রসঙ্গে প্রদোষ চৌধুরী তাঁর ‘সমাজচিত্রে ভারতীয় রেল’ গ্রন্থে লিখেছেন, আসামের চা–বাগানের কুলিরা দীর্ঘ বঞ্চনা, শোষণ সহ্য করতে না পেরে দলে দলে দেশে ফিরতে শুরু করে। চা–শিল্পের মালিকেরা একজোট হয়ে রেল কর্তৃপক্ষকে কুলিদের টিকিট বিক্রি বন্ধের অনুরোধ জানায়। বাধ্য হয়ে কুলিরা হেঁটেই দেশে চলে যাওয়ার সংকল্প গ্রহণ করে। ক্ষুধার্ত ক্লান্ত অবসন্ন কুলিরা চাঁদপুর এবং গোয়ালন্দ স্টিমারঘাটে রাতে বিশ্রামের জন্য উপস্থিত হয়।

১৯২১ সালের ২০ মে প্ল্যাটফর্মে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে সপরিবার ঘুমিয়েছিল কুলিরা। মাঝরাতে কোনো রকম উত্তেজনা ছাড়াই ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ফরিদপুরের নির্দেশে ব্রিটিশ অফিসাররা এবং গোর্খা চৌকিদাররা নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে অসহায় হাজার হাজার কুলি পরিবার।

কলকাতা আর পূর্ববঙ্গের মধ্যে ‘বন্ধুত্ব’ রক্ষায় একমাত্র রাজবাড়ী ছিলো গুরুত্বপুর্ণ। গোয়ালন্দের ভূমিকা অপরিসীম। ১৮৬২ সালে শিয়ালদা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত চালু হয় রেল চলাচল। আর, তার ন’বছর পরেই, কুষ্টিয়া থেকে রেলপথ সম্প্রসারিত হয় গোয়ালন্দ পর্যন্ত। সেটা ১৮৭১। তখন থেকেই, ঢাকা থেকে কলকাতায় যাওয়ার জন্য গোয়ালন্দ ছিল প্রধান ভরসা।

গোয়ালন্দের ষ্ট্রিমারের খাবারের কথা সৈয়দ মুজতবা আলী, ধীরাজ ভট্টাচার্য লিখে গেছেন।গোয়ালন্দের অনেক স্মৃতি অনেক বইতে পাওয়া যায়। কোলকাতা থেকে ট্রেনে গোয়ালন্দ ঘাটে এসে ষ্ট্রিমারে ঢাকা যাওয়ার স্মৃতি গুলো এখনকার অনেকেই আমরা জানি না।

শ্রমিক নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে বিফল হয়েছি। বইটি খুজেঁ পাইনি। যদিও শিক্ষক বাতায়নে এমন একটা লেখা দেখেছি যতদুর মনে পড়ে। রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দের ইতিহাস, চা শ্রমিকদের যাওয়ার প্রবেশদ্বার প্রমান করে গোয়ালন্দের গুরুত্ব। এতো বছর পর ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের দপ্তরেও কোন তথ্য সংরক্ষণ করা হয়নি। বলা যায় শুধু মাত্র তথ্য সংরক্ষনের অভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে গোয়ালন্দের চা শ্রমিকদের ইতিহাস।

সেই সময়ের আসামের চা–বাগানে শ্রমিক পাঠানো সেখানে স্থাপন করার ডিপোর ব্যবস্থা অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট, এজেন্ট এবং মেডিকেল ইন্সপেক্টররা এখানে চা–শ্রমিকদের বহির্গমন ও অভিবাসনের কাজ তদারক প্রমান করে শ্রমিক নির্যাতনের এক লোমহর্ষক ঘটনার।কারন হিসাবে উল্লেখিত কাহিনী গোয়ালন্দের ইতিহাস,পর্যালোচনা করে সহজেই অনুমান করা যায় কি ঘটেছিলো সেদিন গোয়ালন্দ ঘাটে।

হয়তো গবেষণায় বেরিয়ে আসবে শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের সত্য ঘঠনা। ইতিহাসের সাক্ষী এই গোয়ালন্দ ঘাট তখন আরো বেশী গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠবে। ইতিহাস হল সমাজ, সভ্যতা ও মানুষের রেখে যাওয়া নিদর্শনের উপর গবেষণা ও সেখান থেকে অতীত সম্পর্কের সিদ্ধান্ত ও শিক্ষা নেবার শাস্ত্র। অথচ আমরা অনেকেই ইতিহাস বিমূখ।

চাদঁপুর শ্রমিক গণহত্য সম্পর্কে কিছু তথ্য থাকলেও গোয়ালন্দ ঘাটে ঘটে যাওয়া গণহত্যা সম্পর্কে আমরা অনেকেই তেমন কিছু জানি না। হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি নিয়ে যেখানে যে টুকু পেয়েছি তা তুলে ধরা হলো। সেদিনে সেই কাহিনীর বিস্তারিত না থাকলেও প্রদোষ চৌধুরীর সমাজ চিত্রে ভারতীয় রেল নামক গ্রন্থে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। শিক্ষক বাতায়নে উদ্ধতি দেয়া নাসিমা আক্তারের লেখাটা সত্য বলে মনে হয়েছে। চাদঁপুরের শ্রমিকদের কথা কয়েকটি গ্রন্থে উল্লেখ থাকলেও গোয়ালন্দের কথা কোথাও খুজেঁ পাওয়া যায় না অথবা সেই ইতিহাস কেউ লিখেন নাই এমনটাও হতে পারে।

প্রদোষ চৌধুরীর বইয়ের প্রমান থাকলেও রকমারি ডটকমে জানানো হয়েছে এই বইয়ের আর কোন সংখ্যা নেই। রিপ্রিন্ট করা হবে কি না তাও বলা হয়নি। শুধু "সমাজচিত্রে ভারতীয় রেল" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা আছে।

ভারতীয় রেলের ইতিহাসের সঙ্গে সমাজ-জীবনের ইতিহাস ওতপ্রােত ভাবে জড়িত।সূচনাকাল থেকেই রেল চক্রের ঘূর্ণনের সঙ্গে আবর্তিত হয়ে চলেছে সমাজের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক নানান কর্মকাণ্ডের বিবিধ গতি-প্রকৃতি। রেল ছাড়া জীবনকে ভাবাই যায় না।

জনজীবনে রেলের বৈপ্লবিক প্রভাব জানতে গেলে রেলের ইতিহাসও জানা দরকার। এই জানা নিছক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে রেলের বিবর্তনের ইতিহাস জানা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সারা দেশের ইতিহাস- চলমান ট্রেনের সঙ্গে প্রবাহমান জীবনের বাঙ্গয় ইতিহাসের যােগ। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, ডিব্ৰুগড় থেকে দ্বারকা, এক প্রান্তের সঙ্গে অন্য প্রান্তের মানুষের এবং স্থানের যােগসূত্র। রচনাকারী ভারতীয় রেল জাতীয় সংহতির প্রতীক ইস্পাতবত্ম যা গােটা দেশকে জুড়ে দিয়েছে।

সে-কাল এ-কালের সাহিত্য, সংবাদপত্র এবং সাময়িকপত্র থেকে সংগৃহীত, নানান তথ্য সম্ভারে সমৃদ্ধ। এ বই পড়তে পড়তে পাঠক নিজেকে অনুভব করেন, তিনি যেন বসে আছেন চলন্ত ট্রেনের খােলা জানালার ধারে— তার চোখের সামনে সিনেমার পর্দার মতাে সরে সরে যাচ্ছে আসমুদ্রহিমাচল বৈচিত্র্যময় ভারতের নানান দেশের নানান দৃশ্য রেলগাড়ির আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে ধ্বনিত হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া অতীতের কাহিনি। কানে কানে যেন বলছে ‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?’) এই ইতিহাসে নিশ্চয়ই গোয়ালন্দ একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়।

এই গ্রন্থে লিখা আসামের চা–বাগানের কুলিরা দীর্ঘ বঞ্চনা, শোষণ সহ্য করতে না পেরে দলে দলে দেশে ফিরতে শুরু করে। চা–শিল্পের মালিকেরা একজোট হয়ে রেল কর্তৃপক্ষকে কুলিদের টিকিট বিক্রি বন্ধের অনুরোধ জানায়। বাধ্য হয়ে কুলিরা হেঁটেই দেশে চলে যাওয়ার সংকল্প গ্রহণ করে। ক্ষুধার্ত ক্লান্ত অবসন্ন কুলিরা চাঁদপুর এবং গোয়ালন্দ স্টিমারঘাটে রাতে বিশ্রামের জন্য উপস্থিত হয়। ১৯২১ সালের ২০ মে প্ল্যাটফর্মে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে সপরিবার ঘুমিয়েছিল কুলিরা। মাঝরাতে কোনো রকম উত্তেজনা ছাড়াই ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ফরিদপুরের নির্দেশে ব্রিটিশ অফিসাররা এবং গোর্খা চৌকিদাররা নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে। উল্লেখ্য যে, সে সময় গোয়ালন্দ ছিল ফরিদপুর জেলার একটা মহকমা। যদি ফরিদপুর জেলার ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট নির্দেশ দিয়ে থাকেন তবে সেটা গোয়ালন্দের চা শ্রমিকের কথাই হওয়ার কথা।

এই গুরুত্বপুর্ন বিষয়টি কেন সেই সময়ের পত্রপত্রিকা বা ইতিহাসবিদ তুলে ধরেন নি সেটা একটা বড় প্রশ্ন। (হয়তো কোথাও যাকতেও পারে আমাদের নজরে পড়ে নাই।)

১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি কুষ্টিয়া থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের (ইবিআর) আওতায় এই সম্প্রসারণ ঘটে। রেল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার পর পূর্ববঙ্গের যোগাযোগের ক্ষেত্রে গোয়ালন্দের অবস্থানগত গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়, যা প্রকাশিত হয়েছে সেকালের পত্রপত্রিকাতেও।

১০ জানুয়ারি ১৮৭৫ সাধারণীর সংবাদ থেকে জানা যায়, ‘পূর্ব্বে গোয়ালন্দ একটি যৎসামান্য গ্রাম ছিল। এখন রেলওয়ে ষ্টেশন হইয়া অতি বিখ্যাত স্থান হইয়াছে। উত্তর, পূর্ব্ব-বাঙ্গালা ও আসাম অঞ্চলের লোকদিগকে কলিকাতা অঞ্চলে যাইতে হইলে এস্থানে আসিয়া রেল গাড়ীতে উঠিতে হয়। বাণিজ্য উপলক্ষে বহুতর বণিক মহাজনের এখানে সমাগম হইয়া থাকে।’ যাত্রীসংখ্যা এতই বৃদ্ধি পায় যে, ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ১৮৭৪ সালে শুধু তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীদের জন্য গোয়ালন্দ থেকে কলকাতা রুটে রিটার্ন টিকেট প্রবর্তন করে।গোয়ালন্দ বহু বছর ধরে পূর্ববঙ্গ ও আসাম অংশে যাতায়াতের জন্য পরিবহনের একটি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল।

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পদ্মা ও গোয়ালন্দ তীরবর্তী গ্রামের চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় ‘ফ্রম দ্য হুগলি টু দ্য হিমালয়াস’ গ্রন্থে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র (১৯৩৫) প্রেক্ষাপট ছিল সে সময়কার গোয়ালন্দ। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবনালেখ্যসহ তৎকালীন গোয়ালন্দের রেল, স্টিমার, ব্যবসা–বাণিজ্যসহ জমজমাট শহর জীবনের কিছুটা আভাস পাওয়া যায় উপন্যাসটিতে।

অনুভবে হয়তো এখনো দেখা যায় খানিক দূরে একজোড়া ‍উঁচু–নিচু ও প্রায় অকেজো লাইনের উপর চার–পাঁচটা ওয়াগন দাঁড়াইয়া আছে। পেট ভর্তি মাছ নিয়ে যথাসময়ে ওয়াগনগুলি কলিকাতায় পৌঁছাইবে। সকালে–বিকালে বাজারে বাজারে ইলিশ কিনিয়া কলিকাতার মানুষ বাড়ী ফিরছে। কলিকাতার বাতাসে পদ্মার ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ।’ কলকাতায় মাছের বাজারে অপর উৎস ছিল লালগোলা ঘাট। তবে লালগোটা ঘাট থেকে আসা মাছের পরিমাণ গোয়ালন্দ থেকে রপ্তানিকৃত মাছের তুলনায় ছিল নিতান্তই নগণ্য। হয়তো অতিপরিচিত গোয়ালন্দের সেই ইলিশের ঘ্রাণ এখনো স্মৃতিতাড়িত করে কলকাতার প্রবীণদের।১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর, ইস্ট বেঙ্গল এক্সপ্রেস ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এখানে চলাচল করেছিল।এরপর গোয়ালন্দের ঘাট রেল সংযোগ শুধুমাত্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।

নৌঘাট স্টেশন দিয়ে সেকালে আসামের চা–বাগানে শ্রমিক পাঠানো হতো। সে জন্য এখানে একটি ডিপোর ব্যবস্থা ছিল। অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট, এজেন্ট এবং মেডিকেল ইন্সপেক্টররা এখানে চা–শ্রমিকদের বহির্গমন ও অভিবাসনের কাজ তদারক করত।

শ্রমিক নির্যাতনের এক লোমহর্ষক ঘটনার সাক্ষী এই গোয়ালন্দ ঘাট। দু’শো বছরের শাসনামলে ব্রিটিশরা উপমহাদেশে কত নির্মমতার জন্ম দিয়েছে, তার কোনো হিসেব নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব নির্মমতার ভুক্তভোগী ছিল দেশের অসহায় মানুষ। যাদের কাঁধে ভর করেই ব্রিটিশরা এদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ব্রিটেনে পাচার করতে সক্ষম হয়েছিল। তেমনই এক নির্মম উপাখ্যান রচিত হয় ১৯২১ সালে। নির্মম সেই ঘটনাটি ঘটে গোয়ালন্দ ও চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটে।

সিলেট এবং আসামের বন-জঙ্গল সাফ করে সেখানে চায়ের বাগান গড়ে তোলে ব্রিটিশরা। চা বাগানগুলোতে কাজের জন্য প্রয়োজন হতো প্রচুর শ্রমিক। স্থানীয় মানুষজন এসব পরিশ্রমের কাজ করতে চাইত না। তাই দূরদূরান্ত থেকে উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে ধরে আনা হতো শ্রমিকদের, যাদেরকে আর কখনোই ফেরত যেতে দেওয়া হতো না।

দারিদ্র্যপীড়িত ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, মাদ্রাজসহ বিভিন্ন অঞ্চলের নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ধরে নিয়ে আসা হতো কাজের জন্য। এছাড়া দলিত এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণও উন্নত জীবনের লোভে পড়ে ব্রিটিশদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে পাড়ি জমাত আসামে। নিম্নবর্ণের এই লোকদের দেখানো হয় সুবর্ণ এক ভূমির ঠিকানা। সেখানে সবুজে ঘেরা পাহাড়ের বেদীতে গাছে গাছে সোনার পাতা ধরে, আর সেই স্বর্ণপত্র সংগ্রহ করাই তাদের কাজ। এমন সব কাল্পনিক এবং রূপকথার গল্প শুনিয়ে অনাহারে ভুগতে থাকা লোকেদের আকৃষ্ট করা হতো।

এসব মানুষ প্রলোভনে পড়ে যখন বন-জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ে আসতো , তখনই বাস্তবতা বুঝতে পারতো বন-জঙ্গলের হিংস্র প্রাণী এবং বিষাক্ত পোকামাকড়ের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেঁচে থাকতে হতো তাদের। মালিকের দেওয়া ছোট্ট এক মাটির কুটিরে পরিবারসমেত বসবাস করতে হতো। দিনের পর দিন বৃষ্টিতে ভিজে অনাহারে দিনাতিপাত করতে হতো। পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া হতো না কোনো অর্থ। টি-টোকেন নামক এক ধাতব পত্র দেওয়া হতো, যার মাধ্যমে শুধুমাত্র বাগানের মধ্যে নির্ধারিত দোকান থেকেই পণ্য কেনা যেত। বাগানের বাইরে এ টোকেনের কোনো মূল্য ছিল না। ফলে চাইলেই শ্রমিকরা বাইরে যেতে বা কিছু কিনতেও পারতেন না। তাদের জীবন বাঁধা পড়েছিল একটি চা বাগানের মধ্যে।

১৯২১ সালের ২০ মে চাঁদপুরে মেঘনার তীরে জাহাজঘাটে শ্রমিক ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। সেই বর্ণনাতে চাঁদপুরের কথা উল্রেখ করা হলেও গোয়ালন্দের পরিস্থিতি অস্বীকার করার উপায় নেই।এ বিষয়ে কথা বলেছি ড সরকার মান্নান ড দেবোব্রত চক্রবর্তী, মফিদুল হকের সাথে। তারা এ বিষয়ে গবেষণা করা দরকার বলে মত দিয়েছেন।
বিভিন্ন জার্নাল এবং চাদঁপুর থেকে প্রকাশিত পত্রিকা সহ অন্তজালে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে বোঝা যায় ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ড বা গণহত্য গোয়ালন্দে হয়েছিলো।

ব্রিটিশ উপনিবেশ দ্বারা চা শিল্পের গোড়াপত্তনের সময় উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই চায়ের বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য বিপুল শ্রমিকের চাহিদা দেখা দেয়। কিন্তু স্থানীয় শ্রমিকদের দ্বারা শ্রমঘন এই শিল্প চালু করা সম্ভবপর নয়। তাই ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দালালদের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়ে আসা শুরু করে। শ্রমিক সংগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট কমিশনপ্রাপ্ত দালালরা ‘আরকাট্টি’ নামে পরিচিত ছিল।

বিপুল শ্রমিক সংগ্রহের ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে তৎকালীন সরকার ১৮৬৩ সালে ‘লেবার ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করে আর বিভিন্ন সময়ে সেটাকে পরিমার্জনও করে। শ্রমিকদের ধোঁকা দিয়ে চা শিল্প শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন সময় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে বিষাক্ত সাপ, হিংস্র জন্তু-জানোয়ার, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা আর মালিকশ্রেণির নির্যাতন নিত্যসঙ্গী চা শ্রমিকদের। নামমাত্র মজুরিতে ক্রীতদাসের মতো সারাদিনের খাটুনিতে একবেলা খাবার জুটত না তাদের।

অখাদ্য-কুখাদ্য, অসুখ-বিসুখ আর বন্দিদশায় অপর্যাপ্ত মজুরির পাশাপাশি বাসস্থান, খাবার, স্বাস্থ্য নিরাপত্তাসহ নানামুখী সঙ্কটে জর্জরিত শ্রমিকরা ক্রমশই বাগানমালিক দ্বারা নিপীড়ন-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

আসাম লেবার এনকোয়েরি কমিটির ১৯১৯-২১ সালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯১৭-২০ সময়কালে লক্ষাধিক চা শ্রমিক মৃত্যুবরণ করে। যাদের বেশিরভাগই অপুষ্টিজনিত ও সংক্রামক ব্যাধিতে মারা যায়। এভাবে চা বাগানে শ্রমিকদের বিদ্রোহ প্রকট আকার ধারণ করে।১৯২০ সালের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে চাঁদপুর রেলস্টেশনে হাজার হাজার শ্রমিক জড়ো হন। প্রথম দিকে জড়ো হওয়া শ্রমিকেরা স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের সহায়তায় গোয়ালন্দগামী জাহাজে উঠে পড়েন। এ সময় চাঁদপুরের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন সুশীল কুমার সিংহ। তিনি শ্রমিকদের পাশে ছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই প্ল্যান্টার্সদের প্রতিনিধি হিসেবে ম্যাকফারস এখানে এসে হাজির হন।

চা–বাগানে শ্রমিকেরা ছিল চরমভাবে নিপীড়িতচা–বাগানে শ্রমিকেরা ছিল চরমভাবে নিপীড়িত ১৯ মে সুশীল কুমার সিংহের নেতৃত্বে সশস্ত্র সৈন্যরা জাহাজে উঠতে থাকা শ্রমিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। একসময় জাহাজের পাটাতন সরিয়ে দেওয়া হয়। এতে এক মর্মন্তুদ দৃশ্যের অবতারণা হয়। শত শত শিশু, বৃদ্ধ ও নারী ভেসে যায় মেঘনার জলে।

কিন্তু তখনো আরও নিষ্ঠুরতার বাকি ছিল। পরদিন জাহাজে নারায়ণগঞ্জ থেকে ৫০ জন গোর্খা সৈনিক আসেন। তাঁদের সঙ্গে সশস্ত্র ইউরোপীয় জুট মার্চেন্টরা। চাঁদপুর রেলস্টেশনে তখনো গিজগিজ করছে স্বদেশমুখী চা–শ্রমিকে। রাতের শেষ ট্রেন চলে যাওয়ার পর স্টেশন থেকে রেলকর্মীদের সরিয়ে দেওয়া হয়। চট্টগ্রামের ডিভিশনাল কমিশনার কিরণচন্দ্র দে বা কে সি দের নেতৃত্বে সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়েন ঘুমন্ত শ্রমিকদের ওপর। হাজার হাজার শ্রমিকের কালচে লাল রক্তে ছেয়ে যায় চাঁদপুর বড় স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। সেই স্টেশন এখন অবশ্য নেই। হারিয়ে গেছে মেঘনার গর্ভে। ইতিহাস বিমূখতা অথবা ইতিহাস সংরক্ষনের অভাবে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারি না। পত্রপত্রিকা কিংবা ইতিহাস নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা সম্ভবত কোন কারনে এ সব নিয়ে আর ভাবতে চাননা। যার কারনে চাদঁপুর কিংবা গোয়ালন্দের সেই বিভৎস কর্মকান্ড আমরা ভুলে গেছি।

যুগে যুগে বিপ্লবীরা তাদের জীবন উৎস্বর্গ করে দেশকে দেশের মানুষ কে রক্ষা করে গেছেন। গোয়ালন্দে এই নারকীয় গণহত্যা আমাদের চোখের আড়ালেই রয়ে গেছে। গোয়ালন্দে কোন মনুমেন্ট নাই। তাদের নামের কোন তালিকা নাই অথচ তারাও মানুষ।

ইতিহাস একটি জাতির শিকড়ের আমরা যদি চর্চা না আমরা যদি ইতিহাস-বিমুখতা হই তা হলে সেটা হবে শিকড়চ্যুত হওয়ার নামান্তর।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা