July 4, 2024, 8:55 am


নেহাল আহমেদ

Published:
2024-07-01 23:25:31 BdST

ছোট কলকাতা


ঝাঁ ঝাঁ রোদ্রে ভরা দুপুরবেলায় হঠাৎ আমার মনে হলো, আমি যাকে খুঁজছি বোধ হয় সত্যি না। না... মানে...বলছি যে এই গ্রাম সম্পর্কে যা শুনেছি অন্তত সেই ছোটগল্পকে আমি যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না।

যে গল্পের কথা শুনেছি , যে আলো দিয়ে পুরো গ্রাম ভর্তি যে আলোর গ্রাম জুড়ে জলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে উদ্ভাসিত ঢেউ। যে গ্রামের কথা বলছিলাম, সেখানে রোদ এমন জলের মতো। মনে হয় রোদকে কেউ জলরং বানিয়ে ছবি এঁকেছে।

সেই গ্রামটির নাম কোড়কদী।

কোড়কদী গ্রামটি এক সময় ‘ছোট কলকাতা’ হিসেবে পরিচিত ছিল। দেশের প্রতিটি প্রান্তেই রয়েছে অসংখ্য গ্রাম। তবে, সেগুলির মধ্যে এমন কিছু গ্রাম রয়েছে যেগুলি তাদের অভিনব বিশেষত্বের মাধ্যমে এক আলাদা নজির তৈরি করেছে। শুধু তাই নয়, ওই গ্রামগুলি সম্পর্কে জানার পর অবাক হয়ে যান প্রত্যেকেই। আজ আমরা এমন একটি গ্রাম সম্পর্কে জানবো।

৩০০ বছর আগে গ্রামটিকে কনকদ্বীপ নামে ডাকা হতো। গ্রামটি প্রথমে বালিয়াকান্দির মেঘচামি ইউনিয়নে ছিল, পরবর্তীতে কোড়কদীকে ইউনিয়ন করে মেঘচামি ইউনিয়ন সহ মধুখালি থানার ফরিদপুর জেলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

কোড়কদী নামে এই গ্রাম বারেন্দ্রদের গ্রাম হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল এবং এখানে লেখাপড়ার প্রসার ছিল তুলনাহীন৷ এটিকে একসময় ছোট কলকাতা বলা হত৷ এই গ্রামে বাস করতেন মৈত্র, সান্যাল, লাহিড়ী ভাদুড়ি বাগচি ইত্যাদি পদবীধারী ও তৎসহ চক্রবর্তী ও ভট্টাচার্য পদবীধারী যাঁদের পূর্বপদবী ওই পাঁচটি বারেন্দ্র পদবীর কোনও একটি ছিল৷ রত্নগর্ভা ছিল এই গ্রাম৷

এই গ্রাম বহু বিখ্যাত মানুষকে জনমানসের পাদপ্রদীপের কাছে এনে দিয়েছে৷ এই গ্রামের বারেন্দ্র পরিবারের মেয়েরাই বাংলায় প্রথম ব্যাপক হারে পড়াশুনা শুরু করেছেন৷ অবিভক্ত বঙ্গদেশের নারীশিক্ষায় তাঁরা পথিকৃৎ বলা যেতে পারে।

গ্রামটি একসময় রত্নগর্ভা ছিল৷ বারেন্দ্রপ্রধান এবং বহু গুণী মানুষের আবাস ছিল এই গ্রাম৷ আগেকার দিনের বিদ্বজ্জন এঁদের নিশ্চয় চিনবেন৷ কম্যুনিস্ট আন্দোলনের উৎস বাংলাদেশে অনেকটাই এই গ্রামে।

ঐতিহ্যবাহী এই গ্রামটির শুরুতেই রয়েছে শত বছরেরও বেশি পুরনো কোড়কদী রাস বিহারী উচ্চ বিদ্যালয় যার প্রতিষ্ঠা সাল “১৯০১” যে কোনো কৌতূহলী পড়িয়াদের অবাক করবে। কালের সাক্ষী হয়ে আজও অত্র এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। ভারত বিভাগের আগে প্রত্যন্ত এই গ্রামেই কেরোসিন চালিত ফ্রিজ ব্যবহৃত হতো, যার নমুনা জাদুঘরে রক্ষিত আছে বলে জানা যায়।

কোড়কদী গ্রামের ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ২০১০ সালের ৩০ জানুয়ারি আয়ােজন করা হয় কোড়কদী সমাবেশ। বাংলাদেশ লিটারারি রিসাের্স সেন্টার (বিএলআরসি)-এর উদ্যোগে এই সমাবেশটি সম্পন্ন হয়।

১৮৬৯ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশ হয়েছিল কালীকৃষ্ণ লাহিড়ীর উপন্যাস ’রশিনারা’। ’দুর্গেশ নন্দিনী’ প্রকাশের মাত্র চার বছরের মাথায় প্রকাশিত সেই উপন্যাসটির লেখকের বাড়ি এই কোড়কদী গ্রাম। বিখ্যাত পন্ডিত ও নৈয়ায়িক রামধন তর্কপঞ্চানন ভট্টাচার্য এই গ্রামের বাসিন্দা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই গ্রামে এসে বিধবাবিবাহ বিষয়ে পন্ডিত তর্কপঞ্চাননের সাথে বিতর্কে মেতেছিলেন। পন্ডিত তর্কপঞ্চাননের নামে এখানে একটি লাইব্রেরি রয়েছে। লাইব্রেরি ভবনটি এখন ভেঙ্গে ঝুরঝুরে! পাঠাগারটিতে তখন বিভিন্ন পুস্তকের সাথে তালপাতার পুস্তক সংরক্ষিত ছিলো।

এই গাঁয়ের লেখক অমল সান্যালের একটি বই ছিল, নাম 'কনকদ্বীপ'। 'মশাল' নামে হাতে লিখে একটি লিটিলম্যাগাজিন তখন সে এই গ্রাম থেকে বের করতো। পন্ডিত অবন্তী কুমার সান্যাল, নবাঙ্কুর উপন্যাসের লেখিকা সুলেখা সান্যাল, বিপ্লবী রাজনীতিক শ্যামেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, বরেণ্য নৃত্যশিক্ষক অজিত সান্যাল প্রমুখের বাড়িও ছিল এই গ্রামে। এই গাঁয়ের জমিদার মধুসূদন সান্যাল নীলকুঠির আয়ের দ্বারা কয়েকটি পরগণার মালিক হয়। কোড়কদীর মানুষ হলেও মধুসূদন সান্যাল বেশিরভাগ কলকাতার জোড়াসাঁকো এলাকায় বসবাস করতো। বৃটিশ আমলের মুন্সেফ যতীন্দ্র নাথ লাহিড়ী ও অনঙ্গ লাহিড়ী এই গ্রামের মানুষ।

কোড়কদীতে ১৯২০-৩০ দশকের দিকেও ৩০ থেকে ৪০ জন বিএ/এমএ পাস মানুষ ছিল। মধ্যযুগের বৃহৎ বাংলার সংস্কৃত শিক্ষার প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় ছিল কোড়কদীর নাম। শ্যামেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের যোগ্য সহধর্মিণী কোড়কদীর মেয়ে মৃদুলা ভট্টাচার্য এই গ্রামে নারী আন্দোলন পরিচালনা করতো। গ্রামের মেয়েরা কোঁদাল কেটে পুকুর করেছিল স্বদেশী যুগে।

ভাষা আন্দোলনে এই গ্রামের প্রায় ৫০ জন ভাষা সৈনিক ছিল যারা অধিকাংশই রাস বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের একটি ঘাঁটি ছিল এই গ্রাম। গ্রামটি অর্থ শিক্ষা সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে অনেক উন্নত ছিলো।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা