September 17, 2024, 12:50 am


নেহাল আহমেদ

Published:
2024-09-03 11:23:49 BdST

ফোর আর্টস ক্লাব


বাংলা সাহিত্যে এরকম ক্লাবের নাম শোনা যায়না। যেমন যায় না হ্যাংরি জেনারেশন বা স্যাড জেনারেশনের মত কোন গোষ্ঠী। হয়তো দশক ধরে কিছু কবি বা সাহিত্যিকের নাম বলা হয়।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে গোকুলচন্দ্র নাগ, দীনেশরঞ্জন দাশ, সুনীতা দেবী এবং মনীন্দ্রলাল বসু প্রমুখ কলকাতার হাজরা রোডে “ফোর আর্টস ক্লাব” (four arts' club) নামে একটি আড্ডার সূচনা করেন।

সাহিত্য, ললিত কলা, সংগীত ও নাটক সৃষ্টি ও চর্চার জন্য। প্রথমে চার সদস্য একটি ছোটগল্পের সংকলন বের করেন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে , নাম “ঝড়ের দোলা”।
সেই সময় থেকেই রাজবাড়ীর সন্তানরা দারুণ ভুমিকা রেখেছিলেন সাহিত্য অঙ্গনে। কল্লোল যুগের সূচনা হয়েছিলো যে গোত্র দ্বারা, ফোর আর্টস তার সূতিকাগার।

আমরা রাজবাড়ী জেলায় জগদীশ গুপ্ত, রাস সুন্দরী দেবীর নাম জানলেও সুনীতি দেবীর নাম অনেকেই জানি না। সুনীতি দেবী সম্পর্কে আমারও ধারনা খুবই অল্প। যেটুকু জানি তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

কল্লোলের আর একজন লেখিকা ছিলেন সুনীতি দেবী (১৮৯৪)। ডায়াসেশন থেকে ইংরেজি অনার্স গ্র্যাজুয়েট ও সর্ববিদ্যা পটিয়সী সুনীতি দেবী ছিলেন তৎকালীন কবি বিজয়চন্দ্র মজুমদারের কন্যা ও অধ্যাপক বিজলী বিহারী সরকারের স্ত্রী। ফোর আটর্স ক্লাবের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন তিনি। কল্লোল পত্রিকার সূচনাকালে তাঁর কলমের উপর খানিকটা ভরসা করেই এগিয়েছিলেন সম্পাদক।

বিজয়চন্দ্র মজুমদার ২৭ শে অক্টোবর, ১৮৬১ খ্রি. বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার খানাকুলে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম হরচন্দ্র মজুমদার। হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল থেকে প্রবেশিকা, কলকাতার মেট্রোপলিটন কলেজ থেকে বি এ (১৮৮৫) এবং ১৮৯৫ খি. বি এল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন । সাহিত্য ইতিহাস বিজ্ঞান ও আইনের উপর তার সমান দখল ছিল।

তুলে ধরছি সেই সময়ের লেখক চন্দ্রনাগের একটি স্মৃতি চারণ।

বুধবারের সকাল কোনো ইতিহাসের পাতায় নেই, ঠিক যেমন নেই সেই আশ্চর্য ক্ষণটি যখন দু'শ বছরেরও কিছু আগে 'রান্না ঘরের হেঁসেলের মধ্যে খোড়ীর নীচে' এক নারী লুকিয়ে রাখছেন 'চৈতন্যভাগবত' এর একখানা পাতা , সময় মতো ছেলের তালপাতায় লেখা বর্ণের সঙ্গে মিলিয়ে পড়বেন বলে।অথচ সেই ক্ষণেই হয়ত নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল তিনিই লিখবেন বাংলাভাষার প্রথম আত্মজীবনীটি।

বাংলাভাষায় মেয়েদের সাহিত্য চর্চার প্রসঙ্গে রাসসুন্দরী দাসীর কথা তাই না উল্লেখ করলেই নয়। ১৩০৩ সালে ৮৮ বছর বয়সে তিনি লিখছিলেন তাঁর জীবন কথা। ততদিনে নারী শিক্ষার প্রসার এবং মেয়েদের জন্য স্কুল কলেজ স্থাপিত হওয়ার অন্তঃপুরে কিছুটা আলো এসে পৌঁছেছিল।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বামাবোধিনী পত্রিকা এবং এডুকেশন গেজেটে প্রায়ই অনেক মহিলার রচনা প্রকাশিত হত তবে তাদের পরিচয় জানা যেত না সেভাবে। উনিশ শতকের শেষ দিকে গিরীন্দ্রমোহিনী দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবী এবং কুসুমকুমারী দেবীর নাম এবং রচনা পাঠক পরিচিতি পায়। শুধু তাই নয় নানা সাময়িক পত্র পত্রিকা প্রকাশে মেয়েদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এই প্রসঙ্গে মোক্ষদাদায়িনী মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত 'বঙ্গমহিলা'(১৮৭০), জ্ঞানদানন্দিনীর 'বালক' (১৮৮৫) ,স্বর্ণকুমারীর 'ভারতী'( ১৮৭৭ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশ হলেও এর মূল প্রেরণাদাত্রী ছিলেন কাদম্বরী দেবী। ১৮৮৪ সাল থেকে স্বর্ণকুমারীদেবী এটি পরিচালনার ভার নেন)। সুতরাং সমাজের সর্বস্তরে না হলেও কিছুটা আলোকিত অংশে মেয়েদের লেখা ও সাহিত্য চর্চার কাজ বৃহত্তর নারীসমাজের কাছে প্রেরণা হয়ে ওঠে।

আমরা যদি আবার ফিরে যাই সেই বিশেষ বুধবারটির কাছে। যে বুধবার বিকেল চারটে থেকে রাত আটটা পর্যন্ত দাশগুপ্ত বাড়ির বাইরের একটি ঘরে নারী পুরুষের সম্মিলিত কন্ঠে শোনা যাবে গান, সাহিত্য আলোচনা।

এমন অসম্ভব ঘটনা তৎকালীন কলকাতার বুকে ঘটানোর ক্ষমতা যাদের ছিল তাদের হাত ধরেই যে বাংলা সাহিত্য জগতটি নতুন পৃথিবীর সন্ধান পাবে এমনটাই যেন পূর্ব নির্ধারিত। গোকুল চন্দ্র নাগ নিরুপমা দাশগুপ্তকে এই চিঠি লেখার একমাস সাতদিন আগে অর্থাৎ ১৯২১ সালের ৪ঠা জুন দীনেশরঞ্জন দাশ ও গোকুল চন্দ্র নাগের উৎসাহে স্থাপিত হয় ফোর আটর্স ক্লাব বা চতুষ্কলা সমিতি। সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্র শিল্প ও কারুশিল্প চর্চার জন্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের জন্য এমন একটি সমিতির উপস্থিতি বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলা যায় এবং এটিই আয়োজকদের অজ্ঞাতসারেই হয়ে উঠেছিল।

১৯২৩ সালে প্রকাশিত 'কল্লোল' পত্রিকার ভূমিকা স্বরূপ। ক্লাবটির সূচনা কালের চারজন ছিলেন দীনেশরঞ্জন দাশ, গোকুলচন্দ্র নাগ, সুনীতি দেবী ও সতীপ্রসাদ সেন। ক্লাবের নানা কাজে পরবর্তীকালে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশেষতঃ এই প্রসঙ্গে সুনীতি দেবী, মায়া দেবী, উমা দাশগুপ্ত ও নিরুপমা দাশগুপ্তের নাম করা যেতে পারে। নিমন্ত্রিত মহিলা অতিথিদের মধ্যে ছিলেন শান্তা দেবী, সীতা দেবী প্রমুখ। সেই সময়ের অনেক খ্যাতনামা লেখকের সঙ্গেও ক্লাবটির যোগাযোগ ছিল। কিন্তু নারী পুরুষের এমন সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক এবং যৌথভাবে এমন সৃজন ভাবনার চর্চা তৎকালীন সমাজের বিরোধিতার মুখে পড়ে এবং দু'বছর পর ক্লাবটি উঠে যায়। ক্লাবটির একটি পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছা ছিল। তা পূরণ করা যায়নি। পরে 'ঝড়ের দোলা' (১৯২২) নামে একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় সেখানে সুনীতি দেবী, গোকুল চন্দ্র নাগ, মণীন্দ্রলাল বসু ও দীনেশরঞ্জন দাশের লেখা চারটি গল্প ছিল। ক্লাব থেকে আর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।সেটি হল উমাদেবীর লেখা ছোটদের ছড়া ও গল্পের সংকলন 'ঘুমের আগে'।

ফোর আটর্স ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মূল দুই উদ্যোক্তার উৎসাহ ও উদ্যমী মন থেমে থাকেনি। আদ্যন্ত শিল্পী ও সাহিত্যপ্রেমী দুই বন্ধু ঠিক করলেন পত্রিকা প্রকাশ করবেন।

লেখার আয়োজন বলতে ছিল ফোর আটর্স ক্লাবের সাহিত্য বিভাগের একটি খাতা, মণীন্দ্রলাল বসু, সুনীতি দেবীর কলমের জোর, 'প্রবাসী'র সঙ্গে যুক্ত সুধীর কুমার চৌধুরীর লেখক যোগাড় করে দেওয়ার আশ্বাস। সর্বোপরি দীনেশরঞ্জন ও গোকুলচন্দ্রের প্রবল আগ্রহ ও আত্মবিশ্বাস। দীনেশরঞ্জন দাশের সেই বহুশ্রুত উক্তি ...
"নাম ঠিক করিয়া ফেলিলাম...কল্লোল।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা