January 18, 2025, 1:05 am


অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

Published:
2025-01-06 15:52:14 BdST

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ফেরি নির্মান বিভাগের টেন্ডারে অনিয়মসর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে সিন্ডিকেটের ঠিকাদারদের সাথে সমঝোতার প্রস্তাব


অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের মেকানিক্যাল উইংস এর ফেরী নির্মাণ বিভাগের দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে পুনরায় টেন্ডার আহবান করা হয়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎ একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার ও সিন্ডিকেটের অধীনে ফেরী নির্মাণ বিভাগের অধিকাংশ টেন্ডার হাতিয়ে নিচ্ছে একটি গ্রুপ। আর এই গ্রুপকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য মেকানিক্যাল উইংস এর এক শ্রেনীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।

বিগত ৫ অর্থ বছরের ফেরি নির্মাণ ও মেরামত বিভাগের কার্যাদেশ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, মেসার্স কুমিল্লা শিল্প বিল্ডার্স লিঃ নামক একটি প্রতিষ্ঠান একচ্ছত্রভাবে আধিপত্য বিস্তার করে টেন্ডার বাগিয়ে নিচ্ছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের যান্ত্রিক জোনের অধীনে ফেরি নির্মাণ বিভাগের ঢাকা রিহেভীটেশন প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্নি স্থানের ৭টি ফেরী পল্টুন পুনঃ নির্মাণ কাজের জন্য গত অক্টোবর ২০২৪ইং তারিখে অনলাইনে টেন্ডার আহব্বান করা হয়। যার আইডি নং ১০২৪১৫১/১০২৪১৫২/১০২৪১৫৩/১০২৪১৫৪/১০২৪১৫৫/১০২৪১৫৬ ও ১০২৪১৫৭।

উক্ত দরপত্রে বিভিন্ন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। উক্ত দরপত্রে অংশগ্রহনকারী একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফিসারিজ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন। এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারী একটি স্বায়ত্বশাষিত প্রতিষ্ঠান। সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ার পরও উক্ত প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদান না করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স কুমিল্লা শীপ ইর্য়াড লিঃ কে কার্যাদেশ প্রদান করে দরপত্র আহবানকারী প্রতিষ্ঠান ফেরি নির্মাণ ও মেরামত বিভাগ। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ফিসারিশ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সহ মন্ত্রণালয় ও উপদেষ্টার দপ্তরে অভিযোগ দায়ের করে। ফিসারিশ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এর প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ঘাটতি আছে এই অভিযোগে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান হয়েও তারা কার্যাদেশ পায়নি এবং তাদের নন রেসপনসিভ ঘোষনা করে।

এই বিষয়ে 'দ্যা ফিন্যান্স টুডে’র নিকট অভিযোগের একটি কপি এসেছে। উক্ত অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে শুধু ফিসারিশ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনই নয় আরও একাধিক টেন্ডার আইডিতে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স রকি ডকইয়ার্ড হওয়া সত্ত্বেও এবং তাদের সমস্ত কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ প্রদান না করে পিপিআর এর দোহাই দিয়ে প্রধান প্রকৌশলীর দাপ্তরিক ক্ষমতা বলে পুনঃ টেন্ডার আহবান করেছে। এই দাবী করেছে ফেরি নির্মাণ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগন।

অথচ মেসার্স কুমিল্লা শিপইয়ার্ড লিঃ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতাকে কার্যাদেশ প্রদান করে তাদের টেন্ডার বহাল রেখেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে, যদি এই টেন্ডার বাতিল বা পুনঃ টেন্ডার করতেই হয় তাহলে একই সাথে আহবআনকৃত আইডির সকল দরপত্রে হওয়ার কথা।

দ্যা ফিন্যান্স টুডে অনুসন্ধানী টিম আসল ঘটনা উৎঘাটনের জন্য অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্ঠ দরপত্র আহবানকারী প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী সহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেন। প্রত্যেকেই প্রধান প্রকৌশলীর মৌখিক নির্দেশে পুনঃরায় দরপত্র আহবান করেছে বলে দাবী করেন।

দরপত্রে অংশগ্রহনকারী একাধিক ঠিকাদারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের একটাই বক্তব্য সিন্ডিকেটের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্যই পুনরায় দরপত্র আহব্বান করা হয়েছে।

একজন সর্বনিন্ম দরদাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি অনুসন্ধানী প্রতিবেদককে বলেন যে, টেন্ডারের সর্বনিন্ম দরদাতার কাগজ-পত্রের ঘাটতি আছে বলে দাবী করা হয় উক্ত আইডির টেন্ডারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতাকে যদি কার্যাদেশ প্রদান করা হয় তাহলে যে ঠিকাদারের সমস্ত কাগজ পত্র ঠিক থাকার পরেও সর্বনিন্ম দরদাতা প্রতিষ্ঠান কোন কার্যদেশ পাবে না?

মূলত: বিদায়ী ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুগত ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিতেই প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তর থেকে পুন:দরপত্র আহব্বানের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে বলে দাবী করেন ঠিকাদারগন। আর এই কাজে লিয়াজোঁ করেছেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শামীমুল হক।

দরপত্র আহব্বানকারী প্রতিষ্ঠান সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের মেকানিক্যাল উইংস এর একাধিক বিভাগের ব্যাপারে ঘুপচি টেন্ডার, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কাজ ভাগাভাগি,ভূয়া বিলের মাধ্যমে টাকা আত্নসাৎ সহ নানাবিধ অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। মেকানিক্যাল উইংস এর নিদিষ্ট কিছু ঠিকাদারের সাথে বিভিন্ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীদের রয়েছে আলাদা সখ্যতা।

ইতোমধ্যে এমনও অভিযোগ রয়েছে ঘুপচি টেন্ডারের মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকার পুরানো যন্ত্রাংশ প্রকৃত পরিমাপের চেয়ে কম পরিমাপ দেখিয়ে এবং প্রকৃত মুল্যের চেয়ে কম মুল্য দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্নসাতের সুযোগ করে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট ও নির্বাহী প্রকৌশলীগন। এই ব্যাপারে মন্ত্রনালয়ের সাবেক সচিবের নির্দেশে বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী (হজ্জ পালনরত কালীন সময়ে) ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী একটি টেন্ডার এর কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশনা থাকলেও ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর উক্ত কোটি কোটি টাকার মালামাল নিদিষ্ট ঠিকাদারের নিকট গোপনে ভেলিভারী দিয়েছে।

এই ঘটনার পর সড়ক অধিদপ্তর জুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হলেও প্রধান প্রকৌশলীর নাম ভাঁঙ্গিয়ে তা প্রচার করা হয় যে প্রধান প্রকৌশলীর নির্দেশনাতেই উক্ত টেন্ডারের মালামাল সরবরাহ করা হয়েছে।
ঠিক একই প্রক্রিয়ায় বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীকে অন্ধকারে রেখে ফেরি নির্মান ও মেরামত বিভাগে টেন্ডার নিয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। উক্ত বিভাগের তত্ববধায়ক প্রকৌশলী শামীমুল হক ইতোপূর্বে সংগ্রহ বিভাগের থাকার সময়েও তার বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। একই ব্যক্তি ‍আবারও ফেরী নির্মান ও মেরামত বিভাগে ও একই অভিযোগ অভিযুক্ত। এমনও অভিযোগ পাওয়া গেছে যে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিদিষ্ট ঠিকাদারের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে কাজ করার প্রস্তাব ও দিয়েছে উক্ত দরপত্র আহব্বান কারী বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী।কিন্তু সর্বনিন্ম দরদাতা প্রতিষ্ঠান তার অনৈতিক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে বলে জানা গেছে।যা দুর্নীতি দমন কমিশন পর্যন্ত গড়াচ্ছে। এ নিয়ে অধিদপ্তর জুড়ে আবার ও নতুন করে আলোচনায় এসেছে শামীমুল হক।

দেশে ফ্যাসিষ্ট সরকারের বিদায় হলেও উক্ত সরকারের আমলে যে সমস্ত ঠিকাদাগন বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শত শত কোটি টাকার কাজ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাগিয়ে নিয়েছে একই সিন্ডিকেট বর্তমানে বহাল আছে এবং দাবিয়ে বেড়িয়ে একই প্রক্রিয়ায় নামে-বেনামে বিভিন্ন ঠিকাদারি লাইসেন্স দিয়ে বর্তমানেও হাতিয়ে নিচ্ছে সমস্ত টেন্ডারের কাজ। বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী ও সিন্ডিকেট ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে এখন কার্যকর গ্রহণ না করলে দুর্নীতির রাহুগ্রাসে তলিয়ে যাবে সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর। এ অধিদপ্তর এর কার্যক্রমকে ঘিরে ইতোমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিগত ফাসিস্ট সরকারের আশীর্বাদপুষ্টরা দীর্ঘদিন যাবৎ একই কর্মস্থলে বসে দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। ইতোমধ্যে টিআইবি’র এক প্রতিবেদনে দুর্নীতিগ্রস্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নাম উঠে এসেছে।বিগত ৫ অর্থ বছরের সকল বিভাগের টেন্ডার প্রক্রিয়া ঘুপচি টেন্ডার নির্ধারণ করা ও কোন কোন ঠিকাদারগণ কোন কোন কাজ পেয়েছে এবং কত টাকা পরিশোধ করা হয়েছে তা দুর্নীতি দমন কমিশনের বিশেষ সেলের মাধ্যমে অনুসন্ধানের দায়ী করেছে ভুক্তভোগী ঠিকাদারগণ। শুধু তাই নয় এমনও অনেক টেন্ডার ও পণ্য ক্রয়ের কাগজপত্র দ্য ফিন্যান্স টুডের হাতে এসেছে যে সমস্ত যন্ত্রাংশ/পন্য ক্রয় করা হয়েছে অদৌ তার কোন প্রয়োজন ছিলো কিনা বা প্রকৃত ক্রয় করা হয়েছে কিনা তার যাচাই করলে টায়ার,টিউব,তেল ও যন্ত্রাংশ ক্রয়ের দুর্নীতি বের হয় আসবে।
ইতোপূর্বে মেকানিক্যাল উইংস ভারত থেকে আমদানিকৃত শত শত কোটি টাকার হেভিওয়েট যন্ত্রপাতি, গাড়ী ও যে সমস্ত পন্য ক্রয় করা হয়েছিল তা উন্মুক্ত মাঠে বিভিন্ন স্থানে অব্যাহত অবস্থায় পড়ে আছে। উক্ত যন্ত্রাংশ ও হেভী ওয়েট মেশিনারিজ ক্রয়ের যৌক্তিকতা কতটুকু ছিল বা তা কোথায় কোথায় ব্যবহৃত হয়েছে এবং উক্ত যন্ত্রপাতির ডিমান্ড সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তর থেকে ছিলো কিনা তাও তদন্ত করা প্রয়োজন বলে একাধিক জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীগন দাবি করেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগের ভিত্তিতে অতিসম্প্রতি মেকানিক্যাল উইংস এর একাধিক কর্মকর্তা ও ঠিকাদার গোপনে হাজিরা দিয়েছে। উক্ত দুর্নীতির অভিযোগের বিস্তারিত তথ্য ও প্রমান ফিন্যান্স টুডে হাতে এসছে। এসব অভিযোগ যে অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে সেই অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মাইনুল হাসানের বিরুদ্ধে ও রয়েছে শতশত কোটি টাকার দুর্নীতি,স্বজনপ্রীতিও অনিয়মের অভিযোগ।

বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের অত্যন্ত আস্থভাজন প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মাইনুল হাসান সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অত্যন্ত আস্থাভাজন। তিনি বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের সদস্য এবং আইবি ২২ সালে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু প্যানেলে নির্বাচন করেন। বিনা ভোটে সেন্ট্রাল কাউন্সিল মেম্বার নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে ও তদন্ত করেছে। তার বিরুদ্ধে নিয়োগ ও পোস্টিং বাণিজ্যের অভিযোগ ও তার নির্ধারিত সিন্ডিকেটের ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ রয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুগত হওয়ার কারনে তার স্ত্রী ফেরদৌস শাহরিয়ার ও ডেপুটি চিফ অফ মিশন হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়াশিংটন ডিসিতে কর্মরত ছিলেন।

বর্তমানে টেন্ডার প্রক্রিয়ার পিপিআর এর দোহাই দিয়ে তাদের সিন্ডিকেটের সদস্যদের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য পুন: টেন্ডার আহব্বান করা পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারেরই প্রতিফলন ।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.