মোঃ হুমায়ুন কবির
Published:2025-02-10 20:35:37 BdST
পতিত সরকারের প্রেতাত্মাসওজ প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান হাজার কোটি টাকার মালিক
- তিনি প্রতিটি টেন্ডারে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা কমিশন বাণিজ্য করেছেন
- অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে রাজধানী সহ গ্রামের বাড়িতে গড়ে তুলেছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদ
- সবুজ উদ্দিন খান কারো মুখাপেক্ষী নয় এমনটাই তার ধারণা
- বাড়ীর পাশে স্ত্রী পান্না একটি স্কুল ও বিশাল একটি গরুর ফার্ম করেছেন
- যে কোনো সময় দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারে সওজ অধিদপ্তরের দুর্নীতির বরপত্র সবুজ উদ্দিন খান।
সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের (সওজ) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান পতিত সরকারের প্রেতাত্মা ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের তল্পী বাহক হিসেবে পরিচিত লাভ করেছিলেন সওজে। আওয়ামী সরকার আমলে সবুজ উদ্দিন খান অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে আরো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের ঘোর বিরোধিতা করেছেন। আন্দোলন ঠেকাতে খরচ করেছেন কোটি কোটি টাকা। তৎকালীন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান (হাবিব) ডিবি প্রধান হারুনকে কয়েক কোটি টাকা ডোনেশন দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে খবর জানা গেছে। আলোচিত এই প্রকৌশলী পতিত সরকারের রাজনৈতিক নেতা এবং মন্ত্রীদের প্রভাব বিস্তার করে প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি , নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার, ভূয়া বিল উত্তোলনের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন। তিনি প্রতিটি টেন্ডারে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা কমিশন বাণিজ্য করেছেন। টেন্ডারে অতিরিক্ত রেট প্রদান করা হতো। তার মনোনীত ঠিকাদার ছাড়া অন্য কাউকেই কাজ দিতেন না। প্রধান প্রকৌশলী থেকে শুরু করে সবাই থাকতেন এই প্রকৌশলীর ভয়ে তটস্থ। সওজে কায়েম করে ছিলেন এককছত্র আধিপত্য বিস্তার। ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসনামলে প্রকৌশলী সবুজ খানের অনিয়ম দুর্নীতি, জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তথ্যবহুল সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রীদের কারণে এদের ভূমিকা ছিল একেবারেই নিষ্ক্রিয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সবুজ উদ্দিন খান প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হলেও তার চালচলন, কাজকর্ম, আচার-আচরণ ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতাদের মতন। তিনি পতিত সরকার আমলে অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে রাজধানী সহ গ্রামের বাড়িতে গড়ে তুলেছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদ। স্ত্রী মাহমুদা আক্তার পান্নার নামে রয়েছে সম্পদের পাহাড়। প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান স্ত্রীকে নারী কোটায় আওয়ামীলীগ সরকারের মহিলা এমপি বানানোর স্বপ্ন দেখে ছিলেন। এজন্য তৎকালীন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং পাবনার এমপি শামসুল হক টুকুকে দিয়ে লবিং করে ছিলেন । ক্ষমতার পালা বদলে শেষ পর্যন্ত তার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। স্ত্রী মাহমুদা আক্তার পান্নাকে দিয়ে একটি অনিবন্ধিত এনজিও পরিচালনা করতেন। এই এনজিওর মূল কাজ ছিল সবুজ উদ্দিনের কালো টাকাকে সাদা বানানো এবং সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি করা।
গোয়েন্দা ডায়রি‘র অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তার সম্পদের বিবরণী। ধানমন্ডিতে একটি ছয় তলা বিলাসবহুল বাড়ী, উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টর ও ১৩ নম্বর সেক্টর সহ রাজধানীতে একাধিক বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। বসুন্ধরা সিটিতে ৪টি দোকান সহ রাজধানীর অভিজাত এলাকায় সবুজ উদ্দিনের সম্পত্তি আনুমানিক মূল্য কয়েক শত কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়-স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনদের নামে বিভিন্ন জায়গায় জমি বাড়ি বাণিজ্যিক সম্পত্তি কেনা হয়েছে যা সাধারণত তার আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার কাছের লোকজন জানিয়েছেন, বিদেশ পড়ুয়া সন্তানের মাধ্যমে সেকেন্ড হোম করেছেন কানাডা। মালয়েশিয়ায়ও প্রচুর অর্থ পাচার করেছেন। অনুসন্ধানে আরো বেরিয়ে এসেছে, রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর রোডের ২৫ নম্বর বাড়িটির রাজউকের নকশা অনুযায়ী মালিক সবুজ উদ্দিন খান। প্লটটির মালিকানায় দেওয়া আছে স্ত্রী মাহমুদ আক্তার পান্না, শ্যালিকা নুরজাহান, নার্গিস আক্তার হীরার নাম। এই বাড়িটিতে সবুজ উদ্দিন নিজে থাকেন না সেখানে শ্যালিকা পরিবার নিয়ে বসবাস করেন এবং অন্যান্য ফ্ল্যাট গুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
সবুজ উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার আমিনপুর থানায়। সেখানে তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার পান্না সিনথি চ্যারিটি ফাউন্ডেশন নামে একটি অনিবন্ধিত এনজিও পরিচালনা করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার দপ্তরের সহকর্মীরা বলেন, উল্লেখিত এনজিও সংগঠনটির নামে বিভিন্ন কারসাজি দেখিয়ে কালো টাকা সাদা করার একটি কৌশল হিসাবে ব্যবহার করছে ধুরন্ধর প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান। অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারদের সুবিধা দিয়ে ফাউন্ডেশনের নামে টাকা আদায় করতেন সবুজ উদ্দিন। দুর্নীতির টাকা স্থানীয় বিশ্বস্ত কিছু অনুসারীর কাছে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার নিজ এলাকার লোকজন।
সিনথি ফাউন্ডেশন ও সবুজ উদ্দিনের পরিবারের বিরুদ্ধে জমি দখলসহ নানান অভিযোগ করেছে আমিনপুরের সাধারণ মানুষ।
সবুজ উদ্দিনের গ্রামের আমিনপুরে ডালাচর ইউনিয়নে মিরপুর চরে ১০০ বিঘা জমি, স্ত্রীর নামে জাতসাখিনি ইউনিয়নে নামদিয়ার গ্রামে ৩০ বিঘা জমি, গাজনার বিলে স্ত্রীর নামে আরো অন্তত: ৫০ বিঘা জমি কিনেছেন। সবুজ খানের এক আত্মীয় জানান, আমিনপুর থানার মাসুন্দিয়া ইউনিয়নের সবুজের গ্রামের বিলাস বহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি ৩০ বিঘা জমির ওপর। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এই গ্রামে সিনথি পাঠশালা(স্কুল) মাঠ সহ প্রায় ২৫/৩০ বিঘা জমির ওপর। এছাড়া বাড়ীর পাশে স্ত্রী পান্না বিশাল একটি গরুর ফার্ম করেছেন। এই ফার্মে ২০০ থেকে ২৫০ টি গরু একত্রে লালনপালন করা সম্ভব।
শ্যামপুর গ্রামের ভুক্তভোগী আক্কাস, মজিদ, সন্তোস সহ অনেকেই জমি বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় মাস্তান বাহিনী দিয়ে জমি দখলে নিয়েছেন সবুজ উদ্দিন ও তার স্ত্রী পান্না।
এছাড়া শ্যামপুর, চর শ্যামপুর, মালঞ্চি, দয়াল নগর, আমিরাবাদ, তালিম নগর, কাশিনাথপুর, বাঁধাই, নান্দিয়ারা গ্রামগুলোতে নামে বেনামে ৩০০ বিঘা জমি রয়েছে।
সবুজ উদ্দিনের আত্মীয় আরো বলেন, সবুজ খান টাকার মেশিন। অবৈধ আয় ধামাচাপা দিতে ঘুষের টাকায় স্ত্রীকে দিয়ে লোক দেখানো সমাজসেবার নাটক করতেন। পতিত সরকারের সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকায় বেশি বেপরোয়া ছিলেন সবুজ উদ্দিন খান। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে গিয়ে স্ত্রী মাহমুদ আক্তার পান্নাকে দিয়ে পাবনা ২ আসনের এমপি বানানোর স্বপ্ন দেখে ছিলেন সবুজ উদ্দিন খান। তার আত্মীয় বলেন আমরা ভয়ে কিছুই বলতে পারতাম না সব দেখেও মুখ বুজে সহ্য করতাম। আমরা এই ঘুষখোর, লুটপাট কারী, কালো টাকার মালিক, জমিদখলদার সবুজ উদ্দিন ও তার পরিবারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
এদিকে গোয়েন্দা ডায়রি’র অনুসন্ধানী টীম সবুজ উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি পাবনার আমিনপুর অনুসন্ধানে যায়। অনুসন্ধানের সময় বাড়ির সিসি ক্যামেরায় তাদেরকে দেখে সবুজ খানের পালিত সন্ত্রাসী বাহিনী ধেয়ে আসেন। বাড়ি থেকে বের হয়ে যখন গরুর ফার্মে অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন ঠিক তখনই কয়েকজন ভয়ংকর তরুণ এসে অনুসন্ধানী টিমকে ঘেরাও করে। পাবনার আমিনপুরে সবুজ উদ্দিন নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছেন। কোন গণমাধ্যম কর্মী তার তথ্য অনুসন্ধানে গেলে তার বাহিনী দিয়ে গণমাধ্যম কর্মীদেরকে প্রতিহত করা হয়। ওই বাহিনী মিডিয়ার লোকজনকে লাঞ্চিত করে এমনকি শারীরিক নির্যাতনও চালায়।
বহুবার পতিত সরকারের আমলে তার অফিসে অনেক গণমাধ্যম কর্মীকে প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান নিজেই লাঞ্ছিত করেছেন। তিনি নিজেকে সব সময় ক্ষমতাধর ভাবেন। সবুজ খান কারো মুখাপেক্ষী নয় এমনটাই তার ধারণা । তার বিরুদ্ধে নিউজ করলে তাকে দেখে নেয়ার হুমকি দেন সবুজ খানের পেটুয়া বাহিনী।
সবুজউদ্দিন খানকে ৫ আগস্ট এর পর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সরকার এসে সওজ প্রথমে প্রকল্প পরিচালক ও পরে অধিদপ্তরে রিজার্ড বদলি করা হয়।
মূলত: সবুজ উদ্দিন খান মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, ঢাকা, বিভাগ তিন কার্যালয়ে দায়িত্বে টানা ৮ বছর পালন করেছেন। সবচেয়ে আকর্ষণীয় পোস্টিং ঢাকা সার্কেলের প্রথমে তত্ত্বাবধায় প্রকৌশলী ও পরে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে। মূলত: আবেগ মনসুর কনস্ট্রাকশন এর সমস্ত কাজকর্ম পেতেন তারই আশীর্বাদে। জনশ্রুতি রয়েছে আবেগ মনসুর কনস্ট্রাকশন অঘোষিত মূল অংশীদার সবুজ উদ্দিন খান।
সহস অধিদপ্তরের হিসাব বলছে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলে নতুন কাজের ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। অর্থের মূল্যের দিক থেকে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে প্রায় অর্ধেক। সবুজ উদ্দিন খান একদিনে এত দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে যুক্ত হতে পারেনি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের মূল কারিগর সড়ক ও সেতুমন্ত্রী আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আশ্রয় ও প্রশ্রয়েই হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে সবুজ উদ্দিন খান। তিনি এখনো ধরাকে সরাজ্ঞান করেছেন। যে কোনো সময় দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারে সওজ অধিদপ্তরের দুর্নীতির বরপত্র সবুজ উদ্দিন খান।
বিষয় গুলো নিয়ে একাধিক বার সবুজ উদ্দিন খানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তার বক্তব্য জানা যায়নি। অফিসে গিয়েও পাওয়া যায়নি। সবুজ খানের স্ত্রীর সাথেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাকেও কোনভাবে পাওয়া যায়নি।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.