নেহাল আহমেদ, কবি ও সাংবাদিক
Published:2025-02-19 18:49:20 BdST
সাহিত্য ও সাংস্কৃতির পার্থক্য
একটা ছোট্ট গল্প দিয়ে শুরু করি। কয়েকদিন আগে আমার শ্রদ্ধেয় এক সাংস্কৃতিক সংগঠক ও শিল্পী কোন একটা বিষয় নিয়ে আমার কাছে প্রশ্ন রাখেন, তোমরা যারা সংস্কৃতিকর্মী আছো তোমরা কি করছো? উত্তরে বলি ভাই আমি তো সাংস্কৃতিক কর্মী না, আমি সাহিত্য কর্মী। তিনি আমাকে ধমক দিয়ে বললেন সাহিত্যকর্মী আর সাংস্কৃতিক কর্মীর কোন পার্থক্য আছে?
না আমি কোন উত্তর দেইনি, শুধু তার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম। তাকে কোন দোষ দিচ্ছি না কারন আমরা অনেকেই তার মতো জানি না সাহিত্য আর সংস্কৃতির পার্থক্য। শিল্প কি জানি না।
জানি না স্কুলে এই বিষয়ে পড়ানো হয় কিনা। বড়রা হয়তো সবাই জানেন। শিশুরা হয়তো জানেই না। তাদের জানানো দরকার। সাহিত্য ও সংস্কৃতি কৃষ্টি বা সংস্কৃতির মূল কাণ্ড সাহিত্য। সাহিত্যকে অবলম্বন করেই সাধারণত সংস্কৃতির নানা শাখা-প্রশাখা দল মেলে–সংগীত বলুন, নাটক অভিনয় বলুন, চিত্র শিল্প বলুন; এ সব আর্বতিত হয়।
আমরা জানি যে সাহিত্য সমাজের একটি আয়না এবং একটি সমাজে যা ঘটে তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেই যুগের সাহিত্যকর্মে কোন না কোন রূপে প্রতিফলিত হয়। একইভাবে, সমাজ ও ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং সংস্কৃতি ভাগ করে নেয় মানুষ।
বানানের দিকে লক্ষ করে আরেক ভুল আমরা সচরাচর করি সেটা হল সাংস্কৃতি আর সংস্কৃতি। এ দুটোর আলাদা বৈশিষ্ট্য এবং অর্থ রয়েছে।
সংস্কৃতি হলো সংস্কার, উন্নয়ন (সমাজ-সংস্কৃতি); অনুশীলন দ্বারা লব্ধ বিদ্যাবুদ্ধি, রীতি-নীতি ইত্যাদির উৎকর্ষ, সভ্যতাজনিত উৎকর্ষ, কৃষ্টি বা কালচার। আর সাংস্কৃতি হলো সংস্কৃতি বা শিক্ষা, সভ্যতা ইত্যাদির সাথে যুক্ত যেমন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দুই সমাজের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগ।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বলতে বোঝায় বিভিন্ন সংস্কৃতির সমাহার। এটি ভাষা, ধর্ম, রীতিনীতি, পোশাক, খাবার, শিল্পকলা, সাহিত্য, ঐতিহ্য- এসবের বৈচিত্র্যকে নির্দেশ করে। বিশ্বে বিভিন্ন দেশ, জাতি, জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। এসব সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়া ও মেলবন্ধনে তৈরি হয় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য।
অন্য দিকে সংস্কৃতি এমন একটি শব্দ যা সামাজিক জীবনের বেশিরভাগ অধরা দিকগুলির একটি বৃহৎ এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ সেটকে বোঝায়।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সংস্কৃতি হল মূল্যবোধ, বিশ্বাস, ভাষা, যোগাযোগ এবং অনুশীলনের ব্যবস্থা যা লোকেরা সাধারণভাবে ভাগ করে নেয় এবং যেগুলিকে একটি সমষ্টিগত হিসাবে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যবহার করা হয়।
প্রশ্ন আসতে পারে তা হলে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নিয়েই কি সাহিত্য সৃষ্টি হয়? উত্তরে বলা যেতে পারে অনেকাংশেই হয়। বৃহৎ অর্থে বলা যায় হয় না। সাহিত্য শুধু সমাজ এবং তার পারিপার্শ্ব কথা নিয়েই সৃষ্টি হয় না
সাহিত্যের পরিধি ব্যাপক। সাহিত্যের কোন সীমানা নেই। সাহিত্যে রুপক ব্যবহার করা হয়। অলংকার ব্যবহার করা হয়। সাহিত্য বিমূর্ত চিন্তা ব্যবহার করা হয়। যেগুলো সাংস্কৃতিতে দেখা যায় না।
সমস্যা এখানেও আছে। বলা হয়ে থাকে ইন্দ্রিয় দ্বারা জাগতিক বা মহাজাগতিক চিন্তা চেতনা, অনুভূতি, সৌন্দর্য ও শিল্পের লিখিত বা লেখকের বাস্তব জীবনের অনুভূতি হচ্ছে সাহিত্য। সাহিত্য এবং সংস্কৃতির মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে এবং উভয়ই একে অপরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সংস্কৃতি সমাজের বিশ্বাস এবং মূল্যবোধকে আলিঙ্গন করে এবং বিপরীতে, সাহিত্য সেগুলিকে বিভিন্ন সাহিত্যিক আকারে প্রকাশ করে । সুতরাং, সাহিত্য, শেষ পর্যন্ত সংস্কৃতির প্রশংসা করে এবং প্রভাবিত।
প্রশ্ন আসতে পারে লিখিত ব্যতিত কোন কিচ্ছা গল্প গান কি সাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে না?
আমরা যদি গভীর ভাবে পর্যবেক্ষন করি তা তা হলে দেখবো পৃথিবীর বহু সাহিত্যই প্রথমে গ্রন্থ আকারে আসেনি। সেগুলো এসেছে মৌখিক ভাবে। মহৎ গ্রন্থ মানুষ মুখে মুখে শুনে মুখস্ত করছে। একটা পর্যায় সেটা পুস্তকে স্থান পেয়েছে। যাকে আমরা লোক সাহিত্য বলি সেগুলো কোন লিপিবদ্ব আকারে রচিত হয় নাই।
আমরা অস্বীকার করতে পারবো না যে লোক সাহিত্য অত্যান্ত শক্তিশালী। এছাড়া বোবা মানুষগণ আঙ্গিক ঈশারার মাধ্যমে ভাব বিনিময় করে, তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য লোকসাহিত্য হিসেবেই বিবেচিত হয়।
গল্প, কৌতুক, ও পদ্য এক ব্যক্তির থেকে অন্য ব্যক্তির নিকট কোন প্রকার লিখিত মাধ্যম ছাড়াই আদান-প্রদান হয়ে থাকে। জীবনের মূল্যমান নির্ধারণ ও বিনির্মাণে তার ভূমিকা অত্যন্ত প্রবল। মানুষের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যবোধ ও সৌন্দর্য চেতনাকে তা উজ্জীবিত, উচ্ছ্বসিত ও উদ্ভাসিত করে তুলতে সক্ষম।
সৌন্দর্য চেতনাকে ভারসাম্যময় এবং জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বানাতে এবং উচ্চ মানসম্মত লালিত্য ও সুধাময় করে তোলাও সাহিত্যেরই অবদান।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.