March 1, 2025, 11:16 pm


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2025-03-01 13:04:31 BdST

ময়মনসিংহের কেওয়াটখালী সেতু প্রকল্পের অনিয়মআদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভূমি অধিগ্রহনের ক্ষতিপূরণ প্রদানেও অনিয়ম


ময়মনসিংহ জেলার ব্রক্ষপুত্র নদীর উপর নির্মিত হতে যাওয়া সর্ববৃহৎ ও দৃষ্টিনন্দন কেওয়াটখালী আর্চ স্টিল সেতুর নির্মাণ প্রকল্পের সংযোগ সড়কের নকশা প্রণয়ন ও ভূমি অধিগ্রহণে প্রকল্প পরিচালকদের অনিয়ম ও দুর্নীতির পর এবার অধিগ্রহণকৃত একটি বিরোধপূর্ণ জমির ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে।

চাঞ্চল্যকর এই ঘটনাটি ঘটেছে ২৬/০২/২০২৫ইং তারিখ (বুধবার) অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এর কার্যালয়ে।

সূত্র মতে, কেওয়াটখালি সেতু প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা এলে কেস নং ০৪/২০২২-২৩ এর আওতায় অধিগ্রহণকৃত এই জমির পরিমাণ ৩.৩৯ একর। যার বি আর এস দাগ নং ৭৪৫৮, বি আর এস খতিয়ান নং ৫০৩, ৬৭৬, ১০১৪, ১০৬৯ উপরোক্ত দাগ খতিয়ানে মোঃ সারয়ার হোসেন মন্ডল বনাম রবিনা খাতুনের মধ্যে জমির মালিকানা স্বত্ব ও দখল নিয়ে বিরোধ থাকায় আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। মামলা নং ৬০/২০২৪।

বিজ্ঞ আদালত উক্ত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করে একটি আদেশ প্রদান করে এবং কোন পক্ষকেই অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ না দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করে।

নিষেধাজ্ঞার এই আদেশের বিষয়ে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (এলে), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, (রাজস্ব) জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সহ সকল দপ্তরকে অবহিত করা হয়।

আরও পড়ুন: ময়মনসিংহে আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভূমি অধিগ্রহনের ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ

কিন্তু উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে একটি বিশেষ পক্ষকে অনৈতিক সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ২৬/০২/২০২৫ ইং তারিখ (বুধবার) মৌখিক নোটিশে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এর কার্যালয়ে এলে শাখার মিস কেস নং: ২৯(Xlll)২০২৪-২৫ এর প্রথম পক্ষ রবিলা খাতুন; পিতা: মৃত মফিজ উদ্দিন ও দ্বিতীয় পক্ষ মোঃ সারোয়ার হোসেন মন্ডল; পিতা: মৃত মিয়া বকশ মন্ডল এর মধ্যে অধিগ্রহণকৃত ভূমির বিরোধ সংক্রান্ত শুনানি কার্যক্রম পরিচালনা করে।

শুনানিতে দ্বিতীয় পক্ষের আইনজীবী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কে আদালতে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে অবহিত করে আদেশের কপি উপস্থাপন করেন। কিন্তু অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোঃ আজিম উদ্দিন বিষয়টি আমলে না নিয়ে এবং বিজ্ঞ আদালতের আদেশ অমান্য করে প্রথম পক্ষ রবিলা খাতুনকে ৯৯ শতাংশ ভূমির ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মোছাঃ সুমাকে আদেশ প্রদান করেন।

এই বিষয়ে আমাদের বিশেষ অনুসন্ধানের আলোকে দেখা যায় যে, উপরোক্ত দাগ খতিয়ানে ময়মনসিংহ এলে শাখা হইতে গত ৩/৩/২০২৪ইং তারিখে অধিকার আইনের ০৮ ধারায় দুইটি নোটিশ জারি করে দুটি অ্যাওয়ার্ড করা হয়। অ্যাওয়ার্ড নং ৭০ এ জমির পরিমাণ ৯৯ শতাংশ। এই অ্যাওয়ার্ড এর মালিক রবিনা খাতুন। অ্যাওয়ার্ড নং ৭১ এ জমির পরিমাণ ২.৪০ একর৷ এই অ্যাওয়ার্ড এর মালিক মোঃ সারোয়ার হোসেন মন্ডল, আব্দুর রশিদ, আয়তন নেছা, ফিরোজা খাতুন, চান বানু, অলিমনছা, আবুল কাশেম, ফকির আবুল, হাসেম ফকির, আবুল কালাম ফকির, কদ বানু।

আমাদের অনুসন্ধানী টিম উপরোক্ত দাগ খতিয়ান সরেজমিনে পরিদর্শন করে এবং স্থানীয় বাসিন্দা ও পার্শ্ববর্তী দাগের মালিক আবু সাঈদ ওরফে রাসুল মিয়া এবং উক্ত দাগের বর্গা চাষী মোঃ আইয়ুব আলী, মোঃ আব্দুল হাই, মোঃ সুলতান মিয়া, ও উপরোক্ত দাগ খতিয়ানে অবস্থিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দোকান ভাড়াটিয়া রাজীব পাল, মাজারুল মাস্টার, রফিকুল ইসলাম সহ আরো অনেকের সাথে কথা বলে জানা যায় যে উক্ত দাগ খতিয়ানে অধিগ্রহণকৃত ভূমির প্রকৃত মালিক মো: সারোয়ার হোসেন মন্ডল।

৭০ নং অ্যাওয়ার্ড মালিক রবিলা খাতুনের দখলে ৪০ শতাংশ যার বর্গাচাষী মোঃ আব্দুল হাই। বাকি তিন একর জমি ৭১ নং অ্যাওয়ার্ড এর মালিক মো: সারোয়ার হোসেন মন্ডলের কমপক্ষে ৪০ বছর যাবৎ ভোগ দখলে রয়েছে।

৭১ নং অ্যাওয়ার্ড এর অন্যান্য নামধারীদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে এই দাগ খতিয়ানে তাদের কোন মালিকানার দখল পাওয়া যায়নি। এমনকি ৭১ নং অ্যাওয়ার্ড এ অনেক মৃত ব্যক্তির নাম উল্লেখ রয়েছে, যেমন আয়তন নেছা, ফিরোজা খাতুন, ওলীমুন নেসা, কদ বানু। উনারা কমপক্ষে ১০ হতে ৪০ বছর পূর্বে মারা গিয়েছেন।

আমাদের অনুসন্ধানী টিম মৃত ব্যক্তির নামে অ্যাওয়ার্ড হওয়ার বিষয়ে ময়মনসিংহের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় জানতে চাইলে কেউ মুখ খুলতে রাজি হননি। এমনকি অ্যাওয়ার্ডের স্বাক্ষরকৃত সার্ভেয়ার মোঃ মহিউদ্দিন ও মো: আজহারের ফোনে এই বিষয়ে জানতে চেয়ে একাধিকবার ফোন করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি।

পরবর্তীতে আমাদের টিম একাধিক বিশেষজ্ঞ আইনজীবীদের সাথে এই বিষয়ে কথা বলে জানতে পারে যদি অ্যাওয়ার্ড হওয়ার পূর্বে মারা যায় তাহলে মৃত ব্যক্তির নামে অ্যাওয়ার্ড হওয়ার কোন সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে যদি জমির দখলীয় মালিকানা থাকে তাহলে তাদের ওয়ারিশানের নামে অ্যাওয়ার্ড হতে পারে।

উল্লেখ্য যে, কেওয়াটখালি সেতু প্রকল্পের সংযোগ সড়কের নকশা প্রণয়ন ও ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় উপদেষ্টা; সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় বরাবর এলাকাবাসীর পক্ষে মোশাররফ হোসেন নামে এক ব্যক্তির লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২/০১/২০২৫ইং তারিখে মন্ত্রণালয়ের অধীনে একজন যুগ্ম সচিবকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

আরও পড়ুন: কেওয়াটখালী সেতুর সংযোগ সড়কের নকশা পরিবর্তনের নেপথ্যে দুটি হাউজিং কোম্পানীকে সুবিধা প্রদান

উক্ত কমিটি ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ ইং তারিখে ময়মনসিংহ সার্কিট হাউসে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। উক্ত বৈঠকে কমিটির সদস্যরা অভিযোগকারী ও অভিযুক্তদের সবার বক্তব্য শুনেন এবং সরেজমিন পরিদর্শন করেন। মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি এই বিষয়ে কি রিপোর্ট প্রদান করেছে এখনো জানা যায়নি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার নিকট থেকে জানা যায় যে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা হতে একটি রিপোর্ট প্রদান করা হয় যেখানে উল্লেখ করা হয় যে, এল এ কেস নং ০৪/২০২২-২৩ এ ক্ষতিপূরণের শতভাগ বিল দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু আমাদের অনুসন্ধানী টিম সরেজমিন পরিদর্শন করে জানতে পারে সর্বোচ্চ ৫% থেকে ১০% ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হতে পারে।

উল্লেখ্য, কেওয়াটখালি সেতুটি অষ্ট্রেলিয়ার সিডনী হারবার ব্রীজের মত ষ্টীল সেতু বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরকে। এই প্রকল্পটির মোট ব্যয় তিন হাজার ২৬৩ কোটি ৬৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ হাজার ৩৫৩ কোটি ৮২ লাখ ও বাকী অর্থ এশিয়ান অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইবিবি) দেওয়ার কথা।

কেওয়াটখালী আর্চ স্টিল সেতু প্রকল্পটির কাজ ০১/০৭/২০২১ইং তারিখে শুরু হয়ে ৩০/৬/২০২৫ ইং তারিখে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহলের হস্তক্ষেপে নকশা পরিবর্তনের কারনে অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণের কারনে এই প্রকল্পের ব্যয় ৩ হাজার ২৬৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা থেকে আরও প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।

নতুন প্রযুক্তির এই স্টিল আর্চ (ধনুক) সেতুর নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ৩৩ দশমিক ২ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। মূলত এই অধিগ্রহণখাতে মাত্রাতিরিক্ত টাকা ব্যয়ের অপকৌশলের পাশাপাশি ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণকেন্দ্রিক সংঘবদ্ধ একটি চক্র সেতু প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা লুটপাট নিশ্চিত করতেই ত্রুটিপূর্ণ নকশায় ঘুরিয়ে পেচিয়ে সংযোগ সড়কটি ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা ও শতাধিক মিল-কারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নেওয়া হয়েছে। এটিকে ঘিরেই শুরু হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণকেন্দ্রিক লুটপাটের কার্যক্রম।

জমির শ্রেণীর পরিবর্তন করাসহ কারো নিচু নামা চাষাবাদের ভূমিকে ভিটে বাড়ি দেখানো, টিনের বস্তি সাদৃশ্য ঘরকে বিরাট আয়তনের কারখানা হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। লাখ টাকার সম্পদ-স্থাপনাকে কয়েক কোটি টাকা মূল্য নির্ধারণের নকশা আঁকাআঁকির অপকর্ম চলছে জোরেসোরেই। এর সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে তড়িঘড়ি করে বিরোধপূর্ণ জমির ক্ষতিপূরণ প্রদান।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.