April 13, 2025, 7:24 am


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2025-04-12 23:41:19 BdST

প্রিমিয়াম আয়ের সঠিক হিসাব নেই, গড়মিল ২৯.২৬ কোটি টাকারাজস্ব ফাঁকি, অর্থ আত্মসাতসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স


প্রিমিয়াম আয়ের সঠিক হিসাব দেয়নি বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স। গ্রাহকের কাছ থেকে যে পরিমাণ প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে তার চেয়ে প্রায় ২৯ কোটি ২৬ লাখ টাকার হিসাব কম দেখিয়েছে বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে। এই হিসাব শুধু ২ বছরের। এছাড়াও কোম্পানিটি গেলো ৪ বছরে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ২৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা। রয়েছে ভ্যাট ফাঁকি, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও। সর্বশেষ হিসাব অনুসারে কোম্পানিটি গ্রাহকের ৪৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা দাবি পরিশোধ করেনি।

আইডিআরএ’র নিয়োগকৃত বিশেষ নিরীক্ষকের নিরীক্ষা প্রতিবেদন, বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন ও অন্যান্য নথিপত্র যাচাই-পর্যালোচনা করে এই গড়মিলের তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড দেশের বীমা বাজারে ব্যবসা শুরু করে ১৯৯৬ সালে। পুজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০১৬ সালে। কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদে রয়েছে দেশের বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কর্ণধার মোস্তফা কামালের পরিবার। কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন তিনি।

এছাড়াও মোস্তফা কামালের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তার স্ত্রী বিউটি আকতার, তার ৩ মেয়ে তাহমিনা মোস্তফা, তানজিমা মোস্তফা ও তাসনিম মোস্তফা, ছেলে তানভির মোস্তফা এবং মেয়ের স্বামী তায়েফ বিন ইউসুফ কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন। মূলত কোম্পানিটি মোস্তফা কামাল ও তার পরিবারের আধিপত্যে পরিচালিত হয়ে আসছে। এই পরিবারের হাতে রয়েছে ১ কোটি ৬৭ লাখ ২৮ হাজার ৩৩৪টি শেয়ার, যা বীমা কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৩৭.৮০ শতাংশ।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, মেঘনা গ্রুপের ৭০টি প্রতিষ্ঠানের বীমা করে প্রিমিয়ামের টাকা ও আমদানি মূল্য কম দেখিয়ে ১ হাজার ৩৭২ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি এবং অর্থ আত্মসাৎ করেছে।

এই অভিযোগ তুলেছেন বীমা কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালক এমএফ কামাল। এই বিষয়ে দফায় দফায় তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ২০১৯ সালের আগষ্ট থেকে ২০২১ সালের মে এবং ২০২২ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দু’দফায় বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। দু’টি বিশেষ নিরীক্ষাতে প্রিমিয়াম আয় সংক্রান্ত সঠিক হিসাব দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান হাওলাদার ইউনুস এন্ড কোং এবং এইচএম এনাম এন্ড কোং নামের দু’টি চার্টার্ড একাউন্টেন্ট প্রতিষ্ঠান।

অথচ বীমা কোম্পানিটির প্রিমিয়াম আয় গোপন করার অভিযোগ উঠে আসে এক বিশেষ অনুসন্ধানে।

নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশেষ নিরীক্ষায় প্রিমিয়াম আয়ের তথ্য গোপনের বিষয়টি উঠে না আসার কারণ হিসেবে বীমা খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বীমা কোম্পানি থেকে দেয়া তথ্যের উপর নির্ভর করে বিশেষ নিরীক্ষা করে থাকে। ফলে কোনো কোম্পানি উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো তথ্য গোপন করলে সীমাবদ্ধতার কারণে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। তবে এক্ষেত্রে আইনের ৪৮ ধারা অনুসারে তদন্ত করা হলে যে কোনো প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করার এখতিয়ার থাকে তদন্ত দলের।

২০২০ সালে ১৪.৩২ কোটি টাকা প্রিমিয়াম আয়ের তথ্য গোপন

সূত্র মতে, নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো প্রিমিয়াম আয়ের ব্যাংক হিসাবগুলোতে বীমা গ্রাহকরা ভ্যাট, স্ট্যাম্প ডিউটিসহ টাকা জমা দিয়ে থাকে। জমাকৃত এই টাকা থেকে বীমা কোম্পানি চেক ডিজঅনার, ভ্যাট, স্ট্যাম্প ডিউটি বাদ দিয়ে জমাকৃত বাকী টাকাকে প্রকৃত প্রিমিয়াম আয় হিসেবে গণ্য করে থাকে। এর সাথে নৌ-বীমার আগের বছরের ডিপোজিট প্রিময়াম যোগ করে এবং চলতি বছরের ডিপোজিট প্রিময়াম বাদ দিয়ে প্রকৃত প্রিমিয়াম আয়ের এই হিসাব করা হয়। যা কোম্পানিটির নিজস্ব প্রিমিয়াম আয়। এর সাথে সরকারি খাতের ব্যবসা (পিএসবি) যোগ করে গ্রস প্রিমিয়াম হিসাব করা হয়।

নৌ বীমার কভার নোটের বিপরীতে জমা নেয়া প্রিমিয়াম শিপমেন্ট এডভাইস না পাওয়া পর্যন্ত ডিপোজিট প্রিমিয়াম হিসেবে দেখানো হয়। পরে শিপমেন্ট এডভাইস পাওয়ার পর কভার নোটটি বীমা পলিসিতে রূপান্তরিত হয় এবং ডিপোজিট প্রিমিয়ামকে কোম্পানির প্রিমিয়াম আয় হিসেবে প্রদর্শন করতে হয়।

অুনসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম জমার ৩টি ব্যাংক একাউন্টে ২০২০ সালে প্রিমিয়াম ও ভ্যাট-স্ট্যাম্প বাবদ জমা হয় ৭৬ কোটি ৯৮ লাখ ২ হাজার ৭৮২ টাকা। ব্যাংক একাউন্টগুলোতে গ্রাহকের জমা করা এই টাকা থেকে রিটার্নের ১ কোটি ৮৩ লাখ ১০ হাজার ৯৩৮ টাকা, ভ্যাটের ৪ কোটি ৬৩ লাখ ৪১ হাজার ৮৪৯ টাকা এবং স্ট্যাম্প ডিউটির ১ কোটি ৬২ লাখ ৮৩ হাজার ১২৯ টাকা বাদ দিয়ে ২০২০ সালের নিজস্ব প্রিমিয়াম আয় দাঁড়ায় ৬৮ কোটি ৮৮ লাখ ৬৬ হাজার ৮৬৬ টাকা।

কোম্পানিটির ২০১৯ সালের ডিপোজিট প্রিমিয়াম ১ কোটি ৫০ লাখ ৭ হাজার ৬০৯ টাকা এবং ২০২০ সালের ডিপোজিট প্রিমিয়াম ৫ কোটি ৯০ লাখ ১৪ হাজার ৮৬ টাকা। ডিপোজিট প্রিমিয়ামের এই টাকা ব্যাংক একাউন্টগুলোতে জমাকৃত প্রকৃত নিজস্ব প্রিমিয়াম আয়ের সাথে সমন্বয় করা হলে কোম্পানিটির নিজস্ব (ডিরেক্ট) প্রিমিয়াম আয় দাঁড়ায় ৬৪ কোটি ৪৮ লাখ ৬০ হাজার ৩৮৯ টাকা।

অথচ বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স ২০২০ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে নিজস্ব প্রিমিয়াম আয় দেখিয়েছে ৫০ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৩৫৮ টাকা। অর্থাৎ ২০২০ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে ১৪ কোটি ৩১ লাখ ৯০ হাজার ৩১ টাকার প্রিমিয়াম গোপন করেছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি।

২০২০ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে ভ্যাট ও স্ট্যাম্প ডিউটির তথ্য না থাকায় ২০২১ সালের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য নেয়া হয়েছে।

তবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম গোপন করার এই তথ্য উঠে আসেনি বিশেষ নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে। ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের এই বিশেষ নিরীক্ষা পরিচালনা করে আইডিআরএ। সংস্থাটির ২০১৯ সালের ৬৪ নং সার্কুলার বীমা কোম্পানিগুলো যথাযথভাবে পরিপালন করছে কিনা তা যাচাই করতে এই বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়।

নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে ২০১৯ সালের ৬৪ নং সার্কুলার পরিপালনের বিষয়ে মতামতে উল্লেখ করে- বীমা কোম্পানিটি এই সার্কুলার যথাযথভাবে পরিপালন করেছে।

নিরীক্ষকদের হিসাবে ২০২২ সালে ৩১.১৭ কোটি টাকার প্রিমিয়াম আয় গোপন

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২২ সালেও বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সে বিশেষ নিরীক্ষার জন্য এইচএম এনাম এন্ড কোং-কে নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে ৩১ কোটি ১৭ লাখ ১১ হাজার ১৯৭ টাকার প্রিমিয়াম আয় কম দেখানোর আপত্তি তোলা হয়।

নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুসারে কোম্পানিটি প্রিমিয়াম সংগ্রহের ব্যাংক একাউন্টগুলোতে জমার পরিমাণ ১২৪ কোটি ৮৩ লাখ ৯৫ হাজার ৫৬০ টাকা। জমাকৃত এই প্রিমিয়ামের সাথে ২০২১ সালের ডিপোজিট প্রিমিয়াম ৬ কোটি ২৮ লাখ ৫৫ হাজার ৬৫৫ টাকা যুক্ত করে এবং ২০২২ সালের ডিপোজিট প্রিমিয়ামের ৮ কোটি ৮১ লাখ ৬৪ হাজার ৫০৩ টাকা এবং প্রিমিয়াম রিফান্ড বাবদ ৫৯ লাখ ৭২ হাজার ১২৭ টাকা বাদ দেয়া হলে প্রকৃত প্রিমিয়াম বাবদ জমার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২১ কোটি ৭১ লাখ ১৪ হাজার ৫৮৫ টাকা।

অথচ কোম্পানিটি বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে নেট প্রিমিয়াম আয় দেখিয়েছে ৯০ কোটি ৫৪ লাখ ৩ হাজার ৩৮৮ টাকা।

এই হিসাবে ২০২২ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের ব্যাংকে জমাকৃত প্রিমিয়াম এবং আর্থিক প্রতিবেদনের হিসাবে পার্থক্য দাঁড়ায় ৩১ কোটি ১৭ লাখ ১১ হাজার ১৯৭ টাকা। এই আপত্তির বিষয়ে কোম্পানিটি ১২৪ কোটি ৮৩ লাখ ৯৫ হাজার ৫৬০ টাকার হিসাব দাখিল করে। যা নিরীক্ষক তার প্রতিবেদনের তুলে ধরে।

এতে দেখানো হয়- প্রিমিয়াম কালেকশনের ৩টি ব্যাংক একাউন্টে ২০২২ সালে জমা হয়েছে ১২৪ কোটি ৮৩ লাখ ৯৫ হাজার ৫৬০ টাকা। যার মধ্য থেকে চেক ডিজঅনার হয়েছে ৭ কোটি ৩৭ লাখ ৭২ হাজার ২৮৪ টাকা, আগের বছরের কালেকশন ৮ কোটি ১০ লাখ ২ হাজার ৩৭১ টাকা, রিফান্ড প্রিমিয়াম ৫৯ লাখ ৭২ হাজার ১২৭ টাকা, অ্যাডভান্স প্রিমিয়াম রিসিভড ৫ কোটি ৩৪ লাখ ৮৪ হাজার ১০৮ টাকা, স্ট্যাম্প ডিউটি পরিশোধযোগ্য ৩১ লাখ ৯৯ হাজার ৪৩৪ টাকা ও স্ট্যাম্প ডিউটি পরিশোধিত ২ কোটি ৪০ লাখ ২৮ হাজার ৩১৩ টাকা, ভ্যাট পরিশোধযোগ্য ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ১২৮ টাকা ও ভ্যাট পরিশোধিত ৭ কোটি ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৫৫৯ টাকা, চলতি বছরের ডিপোজিট প্রিমিয়াম ৮ কোটি ৮১ লাখ ৬৪ হাজার ৫০৩ টাকা বাদ দেয়া হয়েছে। আর আগের বছরের ডিপোজিট প্রিমিয়াম ৬ কোটি ২৮ লাখ ৫৫ হাজার ৬৫৫ টাকা যুক্ত করে নেট প্রিমিয়াম সংগ্রহ ৯০ কোটি ৫৪ লাখ ৩ হাজার ৩৮৮ টাকা দেখানো হয়েছে।

তবে আগের বছরের কালেকশন ৮ কোটি ১০ লাখ ২ হাজার ৩৭১ টাকা এবং অ্যাডভান্স প্রিমিয়াম রিসিভড ৫ কোটি ৩৪ লাখ ৮৪ হাজার ১০৮ টাকার কোন তথ্য আর্থিক প্রতিবেদনে নেই এবং বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও তুলে ধরা হয়নি। ফলে একপাক্ষিকভাবে দাখিলকৃত এই তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অনুসন্ধানে পাওয়া গেলো ২০২২ সালে ১৪.৩৪ কোটি টাকার প্রিমিয়াম আয় গোপন

প্রিমিয়াম আয় সংক্রান্ত হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২২ সালেও বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির প্রিমিয়াম আয়ের হিসাবে ১৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা গোপন করার তথ্য উঠে আসে।

পর্যালোচনা অনুসারে, ২০২২ সালে কোম্পানিটির প্রিমিয়াম সংগ্রহের ব্যাংক একাউন্টগুলোতে জমাকৃত টাকার পরিমাণ ১২৪ কোটি ৮৩ লাখ ৯৫ হাজার ৫৬০ টাকা।

এর মধ্য থেকে চেক রিটার্নের ৭ কোটি ৩৭ লাখ ২২ হাজার ২৮৪ টাকা, ভ্যাটের ৭ কোটি ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৫৫৯ টাকা এবং স্ট্যাম্প ডিউটির ২ কোটি ৪০ লাখ ২৮ হাজার ৩১৩ টাকা বাদ দিলে প্রিমিয়াম বাবদ জমাকৃত টাকার পরিমাণ ১০৮ কোটি ৯০ হাজার ৪০৪ টাকা।

অপরদিকে আগের বছর ২০২১ সালে ডিপোজিট প্রিমিয়াম ৬ কোটি ২৮ লাখ ৫৫ হাজার ৬৫৫ টাকা যোগ করা হলে এবং ২০২২ সালের ডিপোজিট প্রিমিয়াম ৮ কোটি ৮১ লাখ ৬৪ হাজার ৫০৩ টাকা বাদ দেয়া হলে কোম্পানিটির নিজস্ব প্রিমিয়াম সংগ্রহ দাঁড়ায় ১০৫ কোটি ৪৭ লাখ ৮১ হাজার ৫৫৬ টাকা।

অথচ কোম্পানিটি বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে ২০২২ সালের নিজস্ব প্রিমিয়াম সংগ্রহ দেখিয়েছে ৯০ কোটি ৫৪ লাখ ৩ হাজার ৩৮৮ টাকা। এই হিসাবে কোম্পানিটি আর্থিক প্রতিবেদনে ১৪ কোটি ৯৩ লাখ ৭৮ হাজার ১৬৮ টাকার প্রিমিয়াম গোপন করেছে।

ব্যবস্থাপনা খাতে চার বছরে ২৭.১৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ

বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স চার বছরে ২৭ কোটি ১২ লাখ ৬৪ হাজার ৫৪০ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। এসব অতিরিক্ত খরচ করা হয়েছে কমিশন ও বেতন-ভাতাসহ ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বিভিন্ন খাতে। ২০১৯ থেকে ২০২২ সালে এই অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে।

এর মধ্যে ৯ কোটি ৭৩ লাখ ৮৬ হাজার ৬৩২ টাকা অতিরিক্ত খরচ করা হয়েছে ২০২২ সালে। আর ২০২১ সালে অতিরিক্ত খরচ করা হয়েছে ৩ কোটি ৬৯ লাখ ২৫ হাজার ৫১৪ টাকা।

এর আগে ২০২০ সালে এই অতিরিক্ত খরচের পরিমাণ ছিল ৭ কোটি ৫৬ লাখ ৪২ হাজার ৮৭৩ টাকা এবং ২০১৯ সালে এই খরচের পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ৫৬ লাখ ৪২ হাজার ৮৭৩ টাকা।

আইডিআরএ নিযুক্ত বিশেষ নিরীক্ষককের ২০২১ ও ২০২২ সালের প্রতিবেদন এবং ২০২১ সালের চতুর্থ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

গ্রাহকের ৭৫% বীমা দাবি বকেয়া

বছরের পর বছর ধরে গ্রাহকদের উত্থাপিত বীমা দাবির টাকা পরিশোধ করছে না বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স। অর্থের দিক দিয়ে কোম্পানিটির ৭৫ শতাংশ বীমা দাবির টাকা অপরিশোধিত রয়েছে।

বিশেষ নিরীক্ষকরা বলছেন, ২০১৫ সাল থেকেই বীমা দাবির টাকা বকেয়া রয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সে। কোম্পানিটিতে বকেয়া বীমা দাবির মোট অর্থের পরিমাণ ৪৮ কোটি ৩১ লাখ ৩ হাজার ১৮৬ টাকা।

ফায়ার, মেরিন কার্গো, মোটর এবং বিবিধ বীমা খাতে এসব দাবি অনিষ্পন্ন রয়েছে।

২০২১ সালের বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, বীমা কোম্পানিটিতে ৬৭৫টি বীমা দাবি উত্থাপন হয়। এসব বীমা দাবির অর্থের পরিমাণ মোট ৬৪ কোটি ৯ লাখ ১১ হাজার ৯৯৩টাকা। তবে কোম্পানিটি ৪৬৫টি বীমা দাবি বাবদ পরিশোধ করেছে ১৫ কোটি ৭৮ লাখ ৮ হাজার ৮০৭ টাকা।

গ্রাহকের দেয়া ১.৩৩ কোটি টাকার ভ্যাট পরিশোধ করেনি সরকারকে

বিভিন্ন বীমা পলিসি বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ১ কোটি ৩৩ লাখ ৫৮ হাজার ৫০৯ টাকার ভ্যাট সরকারী কোষাগারে জমা দেয়নি বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স। সরকারের পাওনা এসব ভ্যাট সংগ্রহ করা হয় ২০১৯ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০২১ সালের ৩১ মে পর্যন্ত।

বীমা কোম্পানিটির সিস্টেম জেনারেটেড রেজিস্ট্রার ও প্রকৃত ভ্যাট পরিশোধের তথ্য যাচাই করে ২০২১ সালের বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালে কোম্পানিটি ২ কোটি ২০ লাখ ৫৭ হাজার ৭৭৯ টাকার ভ্যাট সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ৬০৬ টাকার ভ্যাট সরকারের কোষাগারে জমা দেয়নি।

২০২০ সালে সংগৃহীত ৫ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার ৪২৬ টাকা ভ্যাটের মধ্যে সরকারের কোষাগারে জমা দেয়নি ৩৬ লাখ ৭৭ হাজার ৩১১ টাকা। আর ২০২১ সালে জমা দেয়নি ৮৩ লাখ ৩ হাজার ৫৯২ টাকা, এই বছরে ১০ কোটি ৬৭ লাখ ৫১ হাজার ৮১৮ টাকার ভ্যাট সংগ্রহ করে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স।

১.৩৯ কোটি টাকার কমিশন গোপন, ট্যাক্স ফাঁকি ৬.৯৬ লাখ টাকা

আইডিআরএ’র সার্কুলার অনুসারে নন-লাইফ বীমা খাতের প্রিমিয়ামের ওপর এজেন্টদের কমিশনের হার নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫%। যার মধ্যে ৫% সরকারের ট্যাক্স।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স ২০১৯ ও ২০২০ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে কমিশন দেখিয়েছে ১৪ কোটি ৫ লাখ ৯ হাজার ২২৫ টাকা।

অথচ সরকারের ট্যাক্স পরিশোধের চালান অনুসারে কোম্পানিটি এজেন্ট কমিশন দিয়েছে ১২ কোটি ৬৫ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। ১ কোটি ৩৯ লাখ ১০ হাজার ২২৫ টাকার কমিশন প্রদানের হিসাব দেয়নি সরকারের কাছে।

এতে কোম্পানিটি এজেন্ট কমিশনের বিপরীতে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে ৬ লাখ ৯৫ হাজার ৫১১ টাকা।

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সানাউল্লাহর বক্তব্য জানতে কোম্পানিটিতে সরাসরি যোগাযোগ করা হয়। তবে বিষয়টি নিয়ে তারা কোন কথা বলেননি।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র উপ-পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সোলায়মান বলেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনগুলো নিয়ে কর্তৃপক্ষে ত্রিপক্ষীয় শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই শুনানিতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সভার মাইনটস এখনো পাস হয়নি। তাই এসব সিদ্ধান্ত সম্পর্কে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

সূত্র: ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.