মানসুরা চৌধুরী দোলা
Published:2025-05-31 15:54:16 BdST
মরণ ঘাতক এডিস মশার দাপটঢাকায় মশা নিধনে শতকোটি টাকার ‘স্প্রে যুদ্ধ’, তবু কেন মশা অপ্রতিরোধ্য?
প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই রাজধানীবাসীর ঘরে-ঘরে শুরু হয় ভয়ংকর শত্রুর বিরুদ্ধে এক আজব যুদ্ধ। এই যুদ্ধ জীবাণুর বিরুদ্ধে নয়, সরাসরি জীবনের বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষের এই শত্রু অনেক পুরানো। সময়ের হিসাবে অন্তত ২৪ বছরের বৈরিতা। দীর্ঘ এই সময় ধরেই চলছে শত্রু দমনের নানা কার্যক্রম। শত্রুর অবস্থান, বংশবৃদ্ধি প্রক্রিয়া, প্রজননস্থল কারোই অজানা নয়। তবু প্রতিবছর দৃশ্যমান এই শত্রুর আক্রমণে ধরাশায়ী হতে হচ্ছে বহু মানুষকে। শুধু শহরই নয়, এই শত্রু ছড়িয়ে পড়েছে প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদেও।
এই শত্রু সৃষ্টিকুলের অতি ক্ষুদ্র একটি কীটপতঙ্গ; বিজ্ঞানের ভাষায় যার নাম এডিস মশা। এডিস নামক এই শত্রু বিনাশে প্রথমে হাতিয়ার হিসেবে সামনে আসে কীটনাশক। দিনের পর দিন একই কীটনাশক ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। করা হয় কীটনাশক পরিবর্তন। আসে পরিবেশবান্ধব বিটিআই। কিন্তু কিছুতেই যেন পেরে ওঠা দায়।
এডিস মশার কামড় আজ শুধু বিরক্তির কারণ নয়, এটি হয়ে উঠেছে রক্তচোষা এক দৈত্য, যার ছোবলে প্রাণ হারাচ্ছেন মানুষ, ঘরে ঘরে বাড়ছে আতঙ্ক। অথচ, সিটি করপোরেশনে কাগজে-কলমে চলছে ‘মশা নিধনের মহাযজ্ঞ’।
বছরে শতকোটি টাকা খরচ আর ভ্রাম্যমাণ আদালতের জেল-জরিমানার পরও মশক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ দুই সিটি করপোরেশন। কীটনাশকের মান নিয়ে প্রশ্ন রাজধানীবাসীর। তবে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, কীটনাশকের প্রয়োগবিধি সঠিকভাবে না হওয়ার কারণেই মিলছে না ফল।
ঢাকায় বর্ষা শুরু হতে না হতেই শহরের অলিগলি, ছাদবাগান, ড্রেন ও ঝোপঝাড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মশার ঝাঁক। পুরো ঢাকা মহানগরী ও তার আশেপাশের প্রতিটি এলাকা এখন জীবন ঘাতক মশার দখলে।
সরকারি হিসাব বলছে, মশক নিয়ন্ত্রণে সবশেষ অর্থবছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বাজেট ছিল ১৫২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন যৌথভাবে মশা নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ পেয়েছিলো ১৩০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত ১২ বছরে মশা মারার এই আয়োজনে খরচ হয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রতিদিন নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, শত শত গাড়ি নামছে স্প্রে করতে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, মশা যেমন ছিল তেমনি আছে, বরং আরও বেপরোয়া হয়েছে।
এত কিছুর পরও মশা নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না আসার পেছনে কীটনাশক প্রয়োগ পদ্ধতির গলদকে দায়ী করছেন কীটতত্ত্ববিদরা। তবে সর্বোচ্চ নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে কীটনাশক প্রয়োগের দাবি নগর কর্তৃপক্ষের।
মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা রোকসানা আক্তার প্রতিদিন সন্ধ্যার পর মশারি টাঙিয়ে বসেন সন্তানদের নিয়ে। কারণ, মশার কামড়ে টিকতে পারেন না।
এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “এখনো বর্ষা পুরোদমে শুরু হয়নি, এর মধ্যেই ঘরে-মাঠে সবখানে মশা। মনে হয় ওরা বুঝে গেছে—এ শহরে ওদের ঠেকানোর কেউ নেই। অথচ কোথাও কোনো স্প্রের গন্ধ পাই না।”
এই চিত্র শুধু মিরপুরের নয়। গুলশান, জুরাইন, মুগদা, ধানমন্ডি, কামরাঙ্গীরচর, ওয়ারী, বনশ্রী, ডেমরা, দনিয়া সহ প্রায় সব এলাকাতে একই চিত্র। এই দৃশ্য কি শুধুই রোকসানা আক্তারের? না, এটি রাজধানীর কোটি মানুষের অসহায়ত্বের চিত্র।
বর্ষা শুরুর আগেই রাজধানীতে মশার দাপট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। নিয়মিত ওষুধ ছিটানোর দাবি করলেও দুই সিটি করপোরেশনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞ ও এলাকাবাসী।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন যৌথভাবে মশা নিধনে যে ১৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছিলো, সেই টাকার কী ফল হলো?
‘ওষুধ আছে, কাজ নেই’ — মাঠে নেমে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র
সরেজমিনে দেখা গেছে, অনেক এলাকাতেই গাড়িভিত্তিক স্প্রে কার্যক্রম চলছে। তবে তা হয় দিনের এমন সময়, যখন বাসিন্দারা ঘরে থাকে না। অনেক স্থানে ওষুধ ছিটানো হলেও ড্রেন, খোলা পানি বা ঝোপঝাড়ে স্প্রের আওতা পড়ছে না।
গুলিস্তানে এক দোকানদার বলেন, “সপ্তাহে একদিন একটা গাড়ি আসে, ২০ মিনিট ঘুরে চলে যায়। এরপর মশা আরেক ধাপে বেড়ে যায় মনে হয়।”
মুগদা এলাকার এক কলেজছাত্র জানান, “ওষুধের গন্ধ তো পাইই না, বরং কয়েক সপ্তাহ ধরে মনে হচ্ছে মশার আক্রমণ দ্বিগুণ হয়েছে।”
বংশালের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, “একদিন একটা গাড়ি এল, তাও দুপুর ১টার সময়। ওই সময় তো সবাই বাইরে থাকে। মশা থাকে সন্ধ্যায়—তখন তো আসে না কেউ!”
ঔষুধে কি প্রতিরোধ হয়?
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) অ্যান্টোমলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার বলেন, ‘কোনো মানুষ যদি রোগাক্রান্ত হয় তার রোগকে সারাতে যত বড় ডাক্তারই আমরা দেখাই, যত ভালো ওষুধই আমরা কিনে নিয়ে আসি, সেটা সঠিকভাবে ব্যবহার বা সেবন যদি না করে তাহলে যেমন রোগ সারবে না; তেমনি আমরা যত ভালো ও দামি কীটনাশকই নিয়ে আসি না কেন, এটার প্রয়োগবিধি যথাযথ না হলে মশার ঘনত্ব কমবে না। উল্টো বাড়বে।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমি যে লিথাল ডোজ (একটা পদার্থের সর্বোচ্চ যে পরিমাণ কোনো প্রাণীর মৃত্যু ঘটাতে পারে) দিচ্ছি, সেটা সাব লিথাল ডোজ হয়ে গেলে মশার আশপাশে মশার যে শত্রু আছে সেগুলো মরে যাবে। তখন মশা দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। কারণ, মশাকে ঘায়েল করার মতো প্রকৃতিতে কেউ থাকবে না।’
অর্থাৎ প্রয়োগবিধি সঠিকভাবে না হওয়ার কারণেই শতকোটি টাকা খরচ, জেল-জরিমানার পরও মশাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলেই মত দেন নিপসমের অ্যান্টোমলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ব্যবহার করছে তা বহু বছর ধরে একই রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরিকৃত। এতে করে মশার শরীরে ওষুধ প্রতিরোধ ক্ষমতা (রেজিস্ট্যান্স) তৈরি হয়ে গেছে।
ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসক ডা. ফারহানা রহমান বলেন, "ওষুধে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না, অথচ মশা পরিবর্তন হচ্ছে। তার মানে ওষুধ আর কাজ করছে না।ব্যবস্থাপনায় বৈজ্ঞানিক হস্তক্ষেপ জরুরি।”
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার ৭০ শতাংশ এলাকা এমন, যেখানে ব্যবহৃত ওষুধে মশা আর সাড়া দেয় না।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়িয়েছে?
বর্তমানে বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১,৮৯০ জনে পৌঁছেছে, যা গত বছরের তুলনায় ১২৩% বেশি। এছাড়া, ডেঙ্গুজনিত মৃত্যুর সংখ্যা ১৬ জনে দাঁড়িয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৯% বৃদ্ধি পেয়েছে ।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন যে, এই বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হবে। এডিস মশার উপদ্রব বেড়েই চলেছে, এবং গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ৫৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তিকৃতদের মধ্যে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তির সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসের প্রথম তিন সপ্তাহেই রাজধানীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১,২০০ জন। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, এবং রক্তস্বল্পতা, হেমোরেজিক ডেঙ্গুর মতো জটিল অবস্থাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে, বিশেষজ্ঞরা মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ করা যায় এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে।
এই বিষয়ে মুগদা জেনারেল হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, "যত মশা কামড়ায়, তার বেশিরভাগই ডেঙ্গু বাহক। রোগীদের প্রায় সবাই বলছেন তারা ওষুধ ছিটানো দেখেননি বা মশার উপদ্রব কমেনি।”
সিটি করপোরেশনের দাবি ও বাস্তবতা
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো: রাসেল রহমান বলেন, "আমরা প্রতিদিন ১০০টির বেশি গাড়ি দিয়ে ওষুধ ছিটাচ্ছি। আমাদের নিজস্ব পরিদর্শক দল নিয়মিত তদারকি করে। যেসব এলাকা থেকে অভিযোগ আসে, সেগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়।”
তবে এলাকাবাসীর অভিযোগ, ফোন করেও অনেকে সাড়া পান না। অনেক সময় নিচতলার এলাকায় স্প্রে করা হলেও উপরের তলায় কিছুই পৌঁছায় না।
ঢাকা উত্তর সিটির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "ওষুধ ক্রয়, বিতরণ ও প্রয়োগে একধরনের চুক্তিভিত্তিক পদ্ধতি চলে। সব ঠিকাদারের কাজের মান একরকম হয় না। তদারকির ঘাটতিও আছে।"
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু নিয়ম মেনে গাড়ি চালালেই হবে না, এর সাথে এখনই তিনটি বড় উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। সেগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ:
• মশা নিধনে উন্নত প্রযুক্তির কার্যকর ঔষুধ ব্যবহার করা
• সঠিক সময় ও স্থানে স্প্রে নিশ্চিত করা
• স্বাধীন তদারকি টিম গঠন করে প্রতিটি ওয়ার্ডের কার্যকারিতা পর্যালোচনা করা
এছাড়া জনগণকে মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে সচেতন করা, স্বউদ্যোগে বাসা ও আশেপাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কার্যকর উদ্যোগও নিতে হবে।
ঢাকায় মশা নিধনে কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, প্রচার-প্রচারণাও আছে, কিন্তু মশা যেন কারও কথা শুনছে না। সিটি করপোরেশনগুলো তাদের কাজ করছে বলে দাবি করলেও বাস্তবে মশা নিধনে কার্যকর প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। সামনে বর্ষা আরও বাড়বে, বাড়বে ডেঙ্গুর ঝুঁকিও। এখনই সময় বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়ার।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এটা কি ওষুধের ব্যর্থতা, না ব্যবস্থাপনার গলদ? যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে এর জবাব চায় শহরবাসী। জীবন নিয়ে এই ছিনিমিনি খেলা আর চলতে দেয়া উচিৎ নয়।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.