September 11, 2025, 9:24 pm


নিজস্ব প্রতিবেদক

Published:
2025-09-11 17:10:14 BdST

আওয়ামী দোসরদের দখলে ছিল শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানএক সালমানেই শেষ নজরুলের সারাজীবনের অর্জন


  • ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখলে নিতে দেওয়া হয় একের পর মামলা

  • নজরুলকে ফাঁসাতে দুদককেও হাতিয়ার বানান সালমান


আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা শুধুমাত্র রাষ্ট্র ক্ষমতা অবৈধ দখলে রাখেনি বরং  চর দখলের মতো দখল করেছে শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে মতের বিরোধী বহু কর্মকর্তা কর্মচারীকে চাকুরিচ্যুত করা হযেছে । তাদের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে ডজন ডজন মিথ্যা মামলা। নেয়া হয়েছে আয়না ঘরে । মূলত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে টাকা লুটই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ব্যবহার করেও মামলা দেওয়া হয় । বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে কারাগারে পাঠিয়ে লুট করা হয় তাদের প্রতিষ্ঠাগুলো ।

তেমনি আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের ভয়ানক শত্রুতার শিকার একজন ব্যবসায়ীর নাম নজরুল ইসলাম। শুধু ব্যবসায়ী মহল নয়; দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছিল তার সুনাম ও সুখ্যাতি। তিনি ছিলেন ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্স, ফারইস্ট সিকিউরিটিজ লিমিটেড ও প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাষ্টি বোর্ডের মতো বড় বড় সফল প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান।

নজরুল ইসলামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো দখলে নেয়ার নেপথ্যে ছিলেন পতিত শেখ হাসিনার বেসরকারী বিনিয়োগ ও শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তিনি সরকারের বিভিন্ন এজেন্সিকে ব্যবহার করে নজরুল ইসলামের নামে একের পর এক মামলা দেন। দুদককে ব্যবহার করেও কয়েকটি মামলা দেওয়া হয় তার বিরুদ্ধে। এক পর্যায়ে স্বপরিবারে নজরুল ইসলামকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয় ।

জুলাই বিপ্লবের পর চরম ক্ষতির শিকার নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় তিনটি মামলা করেছেন। ওইসব মামলার বিবরণ অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাদীকে (নজরুল ইসলাম) অফিসে ডেকে নিয়ে প্রধান আসামী সালমান এফ রহমানের ফরমায়েশ অনুযায়ী বাদীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে চাপ দিতে থাকেন। নজরুল ইসলাম তার কথায় রাজি না হওয়ায় পুলিশ দিয়ে অপহরণ, গুম ও খুন করার হুমকি দেন।

উল্লেখ্য যে, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এম. এ. খালেক কোম্পানি থেকে বিভিন্ন সময় প্রতারণা করে ৪৫১ কোটি ৩৭ লক্ষ ৬৮ হাজার ১৬৬ টাকা আত্মসাৎ করেন । পরবর্তীতে কোম্পানীর তৎকালীন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের হস্তক্ষেপে ৩৬৯ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা উদ্ধার করা হয়। বাকি ৮১ কোটি ৭৭ লক্ষ ৬৮ হাজার ১৬৬ টাকার জন্য মামলা করা হয়। এতে এম. এ. খালেক ক্ষিপ্ত হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমানের যোগসাজশে চক্রান্ত করে নজরুল ইসলামকে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন যা পরবর্তীতে বাস্তবায়ন করে অন্যায়ভাবে তাকে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

পুলিশের এক তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারী বিনিয়োগ ও শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন যে, নজরুল ইসলামকে আপহরণ করে, প্রতিষ্ঠান থেকে পদচ্যুত করে তাকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। এছাড়া বাদীকে জিম্মি করে তার অর্থ আত্মসাত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেন সালমান সালমান এফ রহমান। বেশ কযেকটি মিথ্যা ও হয়রানি মূলক মামলা দিয়ে নজরুল ইসলামকে জেল হাজতে পাঠান। ফারইষ্ট ইসলামী সিকিউরিটিজ লিমিটিডের চেয়ারম্যান ও প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান পদসহ সকল ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়ে জোর পূর্বক দখল করে নেয়ার কথাও স্বীকার করেছেন সালমান এফ রহমান।

পুলিশের বিশেষ শাখার আরও একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে নজরুল ইসলামকে যড়যন্ত্রমুলক বিভিন্ন মামলায় জড়ানো ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে নেওয়ার তথ্য।

পুলিশ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বাদী নজরুল ইসলামকে ডিবি পুলিশ দিয়ে বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় সালমান এফ রহমানের নির্দেশে। বিভিন্ন মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে চাপ দিয়ে সালমান এফ রহমান অপরাপর আসামীদের যোগসাজসে নজরুল ইসলামের নিয়ন্ত্রনাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহের বোর্ড ভেঙ্গে দিয়ে তড়িঘড়ি করে আলাদা বোর্ড গঠন করেন। সালমান এফ রহমানের নির্দেশে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মো. শিবলী রুবায়েত উল ইসলাম (বর্তমানে দুদক এর মামলায় জেল হাজতে আছেন) এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ নীতিবহির্ভূতভাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানী লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়। কোন কারণ ছাড়াই ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর বোর্ড ভেঙ্গে দিয়ে একটি অন্তবর্তীকালীন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে। পরে সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের দুইটি প্রতিষ্ঠানের নামে এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মামুন খালেদ, একাত্তর টিভির সাবেক সিইও ও প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবুকে পরিচালক করেন। একই সময় পতিত সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির আহম্মেদকে চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব শেখ হাসিনার দোসর মোঃ ইব্রাহিমকে ভাইস চেয়ারম্যান করে একটি অবৈধ বোর্ড কমিটি গঠন করা হয়। যাদের মাধ্যমে সালমান এফ রহমান তার অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেন।

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানীর পরিচালনা পর্ষদ অবৈধভাবে পুনর্গঠিত করে নজরুল ইসলামকে অন্যায়ভাবে পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরিয়ে দেয়। নজরুল ইসলামের নামে থাকা ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানীর শেয়ারগুলো কেড়ে নিতে সালমান এফ রহমান নিজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নেন। ঐ সময় ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোঃ হারুন উর রশীদ কোন অভিযোগ না থাকা স্বত্ত্বেও নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে একের পর এক সাজানো মামলা দেন। ডিবির হারুনের নির্দেশে ডিবি পুলিশ নজরুল ইসলামকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় মিন্টু রোডস্থ ডিবি কার্যালয়ে। সেখানে নজরুল ইসলামের কোম্পানীর শেয়ারসহ সকল ব্যবসার শেয়ার লিখে দেওয়ার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। নজরুল ইসলাম তাদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় পর পর ৬টি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। এসব মামলার নেপথ্যে ছিলেন সালমান এফ রহমান।

নজরুল ইসলাম ফারইস্ট লাইফ ইন্সুরেন্স লিমিডেট, ফারইষ্ট ইসলামী সিকিউরিটিজ লিমিটেড, ফারইষ্ট ইসলামী প্রোপার্টিজ লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান। এছাড়া তিনি প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। তিনি মেঘনা ব্যাংক পিএলসি ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের অংশীদার। তিনি অপ্সরা হোল্ডিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং রামিশা কোল্ড স্টোরেজ, পুনট কোল্ড স্টোরেজ, ফারইষ্ট কোল্ড স্টোরেজ, ফারইষ্ট সিকিউরিটিজ লিমিডেট, রামিশা বিডি ও রামিশা কম্পোজিট টেক্সটাইলেরও চেয়ারম্যান। তিনি বাংলাদেশ চেম্বার অব কর্মাস, কানাডা বাংলাদেশ চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলাদেশ থাই চেম্বার অব কমার্সসহ বিভিন্ন চেম্বার অব কর্মাস এর সদস্য। তিনি দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছিলেন। এমতাবস্থায় সালমান ফজলুর রহমান বাদীর সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে বাদীর প্রতিষ্ঠানগুলো তার কথামত পরিচালনা জন্য চাপ দেয়। সালমান এফ রহমানের কথা না শোনায় নজরুল ইসলামকে পদচ্যুত করা, আর্থিকভাবে নিঃস্ব করা, পথে বসিয়ে দেয়া, অসংখ্য মামলা দিয়ে হয়রানী করা, ডিবি পুলিশ দিয়ে অপহরণ, গুম এবং খুন করার হুমকি দিতে থাকে। বিষয়টি নজরুল ইসলাম তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব ডিরেক্টরকেও জানান। নজরুল ইসলাম আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেন। এতে আসামী সালমান এফ রহমান ও তার সহযোগীরা নজরুল ইসলামের প্রতি আরও হিংস্র হয়ে উঠে। পরিবারসহ বাদীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। নজরুল ইসলাম জীবনের নিরাপত্তা না পেয়ে ২০২১ সালের ১-লা আগস্ট পরিবারসহ আমেরিকা চলে যেতে বাধ্য হন।

নজরুল ইসলাম আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করেন কিন্তু খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন তার পাসপোর্ট ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। পরে ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট আদেশের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে আসেন। অত্র মামলার এজাহার নামীয় আসামীরা বাদীকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য পত্র-পত্রিকায় মিথ্যা প্রচারণা করে। এছাড়াও নজরুল ইসলামের প্রায় সকল ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে।

নজরুল ইসলাম একজন সফল উদ্যোক্তা। তিনি দীর্ঘ সময় জাপানে ছিলেন এবং নিজ মাতৃভুমির টানে তার অর্জিত সমূদয় সম্পদ বাংলাদেশে এনে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। যার ফলে লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। তার এসব প্রতিষ্ঠান রক্ষার জন্য তিনি সরকারের বিভিন্ন মহলে সহযোগিতা চেয়েছেন ।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.