October 29, 2025, 11:16 am


সামিউর রহমান লিপু

Published:
2025-10-29 02:30:46 BdST

অর্থ আত্মসাৎ, আমেরিকায় বাড়ি, দেশে শত কোটি টাকার সম্পদফারইস্ট লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুলের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি


ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম সোমবার ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে তিনি এই জবানবন্দি প্রদান করেন। আদালত সূত্র থেকে এই তথ‌্য জানা গেছে।

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামকে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বংশাল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

পরে তাকে আদালতে সোপর্দ করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। শুনানি শেষে তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ সাব্বির ফয়েজ।

এদিকে, দুদকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নজরুল ইসলাম চেয়ারম্যান থাকাকালে অন্য আসামিদের সঙ্গে যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।

এছাড়া নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী তাসলিমা ইসলাম যৌথভাবে প্রায় ১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা অবৈধভাবে গ্রহণ করে আত্মসাৎ করেছেন।

এই ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, দণ্ডবিধি এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা করা হয়েছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, পরস্পর যোগসাজশে আসামিরা রাজধানীর তোপখানা রোডের জমি কেনার ক্ষেত্রে প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নেন। এর মাধ্যমে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের ৪৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলামসহ অন্যরা।

মামলার আসামিদের মধ্যে পরিচালক নাজনিন হোসেন এখনো পরিচালনা পর্ষদে আছেন। এই মামলায় অন্যান্য আসামিদের মধ্যে মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডা. মো. মনোয়ার হোসেনের বড় ভাই ড. মোকাদ্দেস হোসেন ফারইস্ট ইসলামী লাইফের ভাইস চেয়ারম্যান। ড. মোকাদ্দেস হোসেনের আরেক ভাই মোজাম্মেল হোসেনও দুদকের অপর মামলার আসামি। এছাড়াও ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের নিরপেক্ষ পরিচালক হিসেবে আছেন মোবারক হোসেনের ভাই ও মামলার অপর আসামি আমানত শাহ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মো. হেলাল মিয়া।

মামলার অন্য আসমিরা হলেন- পিএফআই প্রোপার্টিজ ও নর্দার্ন জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক শাহরিয়ার খালেদ, গেটকো টেলিকমিউনিকেশন ও গেটকো এগ্রো ভিশনের চেয়ারম্যান কে এম খালেদ, প্রাইম ব্যাংক ও প্রাইম ফাউন্ডেশনের উদ্যোক্তা এবং ম্যাক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টি এম এ খালেক, টারটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ড. ইফফাৎ জাহান, ফারইস্ট ইসলামী লাইফের পরিচালক খন্দকার মোস্তাক মাহমুদ, ফারইস্ট ইসলামী লাইফের পরিচালক মো. মিজানুর রহমান, মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন, ফারইস্ট ইসলামী লাইফের শেয়ারহোল্ডার পরিচালক রাবেয়া বেগম, স্বতন্ত্র পরিচালক ও আইডিআরএ’র সাবেক চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন এবং স্বতন্ত্র পরিচালক ও পিএফআই সিকিউরিটিজের সাবেক এমডি কাজী ফরিদ উদ্দীন আহমেদ। কোম্পানিটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হেমায়েত উল্যাহকেও দুদকের মামলায় আসামি করা হয়।

দুদকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং, অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তিনটি মামলার প্রস্তুতি চলছে।

এদিকে, আদালত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, গতকাল আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে নজরুল ইসলাম ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনিয়ম, আত্মসাৎ, মানিলন্ডারিং ও বিপুল সম্পদ অর্জনের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেন।

তিনি জানান, তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। ২০১৫ সালে ৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলিংটনে একটি বাড়ি ক্রয় করেন।

নজরুল ইসলাম আরও বলেন, ২০১৪ সালে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের নামে ৩৬ তোপখানা রোডে ২০৭ কোটি টাকায় জমি ক্রয়ের সময় ২৮ কোটি টাকা ভাগাভাগি হয়। এর মধ্যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ৬ কোটি টাকা পান। পরে জমির বিক্রেতা আজহার হোসেন খানের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তার কাছ থেকে নিজের হিসাবে ১০ কোটি ও স্ত্রীর হিসাবে ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা স্থানান্তর করেন। এসব অর্থ পরে বিদেশে পাচার করে মানিলন্ডারিং করা হয় বলেও তিনি আদালতে স্বীকার করেন।

তিনি আরও জানান, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এম এ খালেক নিজের নামে ও পরিচিতদের নামে ১১টি প্রতিষ্ঠান গঠন করে ৫৯১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এই আর্থিক অনিয়মে তিনিও সম্পৃক্ত ছিলেন বলে আদালতে স্বীকার করেন।

নজরুলের ভাষ্যমতে, এম এ খালেক, তার ছেলে শাহরিয়ার খালেদ এবং প্রাইম ফাইন্যান্সিয়াল সিকিউরিটিজ, পিএফআই সিকিউরিটিজ, প্রাইমেশিয়া ইউনিভার্সিটি ও প্রাইমেশিয়া ফাউন্ডেশনসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।

নজরুল আরও জানান, তিনি ঢাকা বোট ক্লাব, ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাবসহ ১৪টি ক্লাবের সদস্য। ২০১৬ সালে ১০ লাখ টাকা দিয়ে ঢাকা বোট ক্লাবের সদস্যপদ নেন এবং বারিধারা ক্লাবের সদস্য হন ২ লাখ টাকা পরিশোধ করে।

জবানবন্দিতে নজরুল ইসলাম দেশে তার ঘোষিত ও অঘোষিত প্রায় ২০০ কোটির বেশি টাকার সম্পদের কথাও জানিয়েছেন। এসব সম্পদের মধ্যে রয়েছে—

> বারিধারায় ৮ কাঠা জমির ওপর ‘পুতুল হাউজ’ নামে ট্রিপ্লেক্স ভবন (বিদেশি নাগরিকদের ভাড়া দেয়ার জন্য নির্মিত)

> বারিধারার ডিওএইচএসে ২৮৪১ বর্গফুট আয়তনের আরেকটি ফ্ল্যাট

> গুলশান-১ এ ভাসাবি রেস্টুরেন্টের পেছনে ৩২০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট

> গুলশান-২ এ ৫ কাঠা জমির ওপর দুইতলা অফিস ভবন

> নিকুঞ্জে তিন কাঠার ওপর আরেকটি ‘পুতুল হাউজ’ নামে ডুপ্লেক্স বাড়ি

> বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় (২০/২/৫, ব্লক-জি, সায়েম সোবহান রোড) ৩৬০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট

> নারায়ণগঞ্জের ভুলতা গাউছিয়ায় এম এ খালেক ও আজহার খানের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় ‘প্রাইম শপ’ নামে ১৮ কোটি টাকার সম্পদ

> মাতুয়াইল ও যাত্রাবাড়িতে প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ

> মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে আলু কেনা ও উৎপাদনের জন্য কৃষিজমি

তাছাড়া নজরুল ইসলামের আয়কর রেকর্ডে ফার ইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্স, ফার ইস্ট ইসলামী সিকিউরিটিজ, ফার ইস্ট ইসলামী প্রোপার্টিজ, সিভিসি ফাইন্যান্স এবং ফার ইস্ট ফাইন্যান্সসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে।

নজরুল ইসলাম বলেন, তার আয়কর নথিতে এসব সম্পদের কিছু অংশ দেখানো হয়েছে, তবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদ অন্যদের নামে বা সরাসরি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে।

তিনি আদালতে আরও বলেন, আমার নেতৃত্বে থাকা সময়ে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন স্বচ্ছ ছিল না। এম এ খালেক ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে, যার অংশ আমিও পেয়েছি।

এর আগে ২০২০ সালের ২৪ জুন ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডকে নিয়ে 'দি ফিন্যান্স টুডে' সহ একাধিক গণমাধ্যমে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে বলা হয়, ফারইস্ট ইসলামী লাইফের সাড়ে ১৪ কোটি টাকার জমিতে বালু ফেলতেই খরচ দেখানো হয় ১৪২ কোটি টাকা।

বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত হওয়া এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) তদন্ত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়।

পরবর্তীতে এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর দুদক কর্তৃপক্ষ ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টস সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কো. কে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডে হওয়া এই আর্থিক অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে তদন্তকারী হিসেবে নিয়োগ দেয়। এই নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ২০২২ সালের ১৮ মে বীমা কর্তৃপক্ষ আইডিআরএ’র কাছে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

সিরাজ খান বসাক এন্ড কোম্পানির তদন্তে ফারইস্ট লাইফের ২ হাজার ৮শ’ কোটি টাকার তহবিল তসরুফের তথ্য উঠে আসে। এর মধ্যে ২ হাজার ৩৬৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা তসরুফ করা হয়েছে বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে জমি ক্রয় ও উন্নয়ন দেখিয়ে, এমটিডিআর বন্ধক রেখে পরিচালক ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া ও ক্ষতিকর বিনিয়োগ করে। বাকি ৪৩২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা তসরুফ করা হয়েছে পরিচালনাগত ত্রুটি ও অনিয়ম করে।

এই বিপুল পরিমাণ টাকা তসরুফের জন্য দায়ী করা হয় বীমা কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামসহ সকল পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী হেমায়েত উল্লাহকে। ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের তহবিল তসরুফের ঘটনায় এর আগেও দুর্নীতি দমন কমিশন আরো তিনটি মামলা দায়ের করে।

এর মধ্যে ৭০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আসামি করা হয় ৯ জনকে। যাদের মধ্যে পরিচালক ছিলেন ৭ জন। তারা হলেন, নজরুল ইসলাম, কে এম খালেদ, শাহরিয়ার খালেদ, এম এ খালেক, মিজানুর রহমান, ফরিদউদ্দিন এফসিএ ও আসাদ খান।

৭২, কাকরাইলের জমি কেনার ক্ষেত্রে ১১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে দুদকের মামলায় আসামি করা হয় ৮ জনকে।

মামলার আসামিরা হলেন, কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী তাসলিমা ইসলাম, তাসলিমা ইসলামের ভাই সেলিম মাহমুদ, কোম্পানির সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত উল্যাহ, সাবেক ইভিপি ও প্রজেক্ট ইনচার্জ ইঞ্জিনিয়ার আমির ইব্রাহিম, টিপু সুলতান, ফুয়াদ আশফাকুর রহমান এবং মোহাম্মদ আলম খান।

তবে এসব মামলায় ফারইস্টের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও সাবেক পরিচালক এম এ খালেক ছাড়া অপর কোন আসামি অদ্যাবধি গ্রেফতার হয়নি।

পরিশেষে, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে অনিয়ম, আত্মসাৎ ও অর্থপাচারসংক্রান্ত মামলার তদন্তে এই জবানবন্দিকে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.