নেহাল আহমেদ & সামিউর রহমান
Published:2025-11-28 14:01:41 BdST
হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুরের রস ও গাছি পেশা
একসময় শীতের সকাল মানেই ছিল গরম রোদে বসে কাঁচা খেজুরের রস খাওয়ার মধুর স্মৃতি। কিন্তু গ্রামবাংলার সেই পরিচিত দৃশ্য এখন বিলুপ্ত প্রায়। খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং অভিজ্ঞ গাছির অভাবে এই ঐতিহ্যবাহী পেশা হারাতে বসেছে।
শীত মৌসুমের শুরুতে গ্রামাঞ্চলে গাছিদের ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। বেতের ঝুড়ি, কাছি ও দা নিয়ে ভোরের কুয়াশা ভেদ করে তারা ছুটে যেতেন মেঠোপথ ধরে। গাছের বুক কেটে রস সংগ্রহের কৌশল ছিল একপ্রকার শিল্প, যার ওপর ভর করেই চলত তাদের জীবিকা।
সুস্বাদু এই খেজুরের রস আগুনে জ্বাল দিয়ে বানানো হতো বিভিন্ন রকমের গুড়ের পাটালি ও নালি গুড়। খেতেও যেমন সুস্বাদু, চাহিদাও ছিল ব্যাপক। সেসময় ঘরে ঘরে রস জ্বাল দিয়ে তৈরি হতো গুড়, পিঠা-পায়েস আর নবান্নের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ত গ্রামময়।
কিন্তু এখন সেই আনন্দ অতীত। খেজুর রসের অভাবের কারণে নবান্নের অনেক রীতিই আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। গ্রামবাংলার শীতকালীন সংস্কৃতি, নবান্ন উৎসব এবং খেজুর রসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কুটিরশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে।
স্থানীয়রা জানান, আগে গাছিদের দারুণ কদর ছিল। মৌসুম শুরুর আগেই কথাবার্তা পাকা হতো কার কটি খেজুর গাছ কাটতে হবে। কিন্তু, এখন গাছের স্বল্পতার কারনে আগের মতো তেমন খেজুর গাছও নেই। আর গ্রামের লোকেরাও এখন আর কাউকে ডাকে না।
গাছ কমছে, হারাচ্ছে ঐতিহ্য
খেজুর গাছ হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে— ইট ভাটার জ্বালানি হিসাবে ব্যবহারের জন্য বেপরোয়া খেজুর গাছ কাটা। এতে দিনে দিনে সারাদেশ জুড়ে আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে খেজুরের গাছ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যত্রতত্র ইটভাটা গড়ে ওঠা, ভূপৃষ্ঠের রুপ পরিবর্তন, বনভূমি ধ্বংস, কৃষি জমি বাড়ানো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এছাড়া অসাধু ব্যক্তিরা ইট ভাটাসহ বিভিন্ন কাজে অধিক মুনাফার লোভে খেজুর গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে। যে কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খেজুর গাছ কমে যাচ্ছে।
গাছিরা জানান, মাটির লবণাক্ততা বাড়ায় দক্ষিণের অনেক এলাকায় খেজুর গাছ মারা যাচ্ছে। নতুন করে গাছ লাগানোর আগ্রহও কম। অপরদিকে রাস্তা প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন কাজে গ্রামের অনেক খেজুর গাছ নিধন হয়েছে। ফলে গাছি পেশায় নতুন প্রজন্ম আর আগ্রহী হচ্ছে না।
চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন কম
বাজারে এখন খেজুর রস ও গুড়ের চাহিদা আগের চেয়ে অনেক বেশি। বর্তমানে ১টি এক লিটার কলসের রস বিক্রি হচ্ছে ১৫০–২০০ টাকা। প্রতি কেজি গুড় ৫৪০–৫৫০ টাকা তবুও গাছের স্বল্পতার কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাজারে খেজুর রস এখন প্রায় দুর্লভ।
কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে উচ্চ ফলনশীল আরব জাতের পাশাপাশি দেশীয় খেজুর গাছ রোপণের পরামর্শ দেওয়া হলেও মাঠপর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
গাছিরা মনে করেন, তালগাছ রোপনের মতো সরকারি-বেসরকারি প্রচারণা থাকলে খেজুর গাছের সংখ্যাও বাড়ানো সম্ভব হতো।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি
খেজুরের রস হলো একটি প্রাকৃতিক এবং পুষ্টিকর পানীয়, যা শীতকালে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। এটি খাওয়ার ফলে কয়েকটি স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং সতর্কতা রয়েছে।
খেজুরের রস গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজ সমৃদ্ধ, যা তাৎক্ষণিক শক্তি জোগায়। এতে আয়রন, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ভিটামিন বি থাকে, যা শরীরের নানা কার্যক্রমে সহায়ক। এতে প্রাকৃতিক এনজাইম রয়েছে, যা হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে।
তবে খেজুরের রস দ্রুত ফরমেন্টেড হয়ে টডি (অ্যালকোহলিক পানীয়) এ পরিণত হয়। তাই দীর্ঘ সময় রেখে দিলে এটি পান করলে ক্ষতি হতে পারে। ডায়াবেটিক রোগীদের এটি সাবধানে খেতে হবে, কারণ এতে প্রাকৃতিক চিনি থাকে।
বর্তমানে অপরিষ্কার পাত্র ব্যবহার এবং ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ভয়ে অনেকেই খেজুরের রস পান করা বন্ধ করে দিয়েছেন। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই খেজুরের রস খাওয়ার ক্ষেত্রে নিপাহ ভাইরাস আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
উৎপাদন বৃদ্ধিতে করনীয়
নতুন খেজুর গাছ লাগানোর পাশাপাশি পুরোনো গাছ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। গাছিদের প্রশিক্ষণ ও রস সংগ্রহের আধুনিক সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। দেশীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও খেজুরে রস ও পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব। সঠিক পদ্ধতিতে রস সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
খেজুরের রস বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও খাদ্য ঐতিহ্যের একটি অনন্য অংশ। এটি সংরক্ষণ করা শুধু অর্থনৈতিক নয়; সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকেও জরুরি। যদি সঠিক উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে হারিয়ে যাওয়া এই ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার সম্ভব। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আমাদের বেশি বেশি খেজুর গাছ রোপণ করতে হবে।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.
