December 4, 2025, 2:12 pm


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2025-12-04 13:21:37 BdST

স্মার্ট ব্যাংকিংয়ের যুগে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নাকি লুটপাটের সুযোগ?রূপালী ব্যাংকে আইসিটি ও জেনারেল ক্যাডার একীভূতকরণ উদ্যোগের নেপথ্যে কি?


‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের লক্ষে যখন দেশের পুরো আর্থিক খাতকে প্রযুক্তিনির্ভর ও পেপারলেস করার জোর তৎপরতা চলছে, ঠিক তখনই উল্টো রথযাত্রার অভিযোগ উঠেছে রাষ্ট্রায়ত্ব রূপালী ব্যাংক পিএলসিতে। ব্যাংকটির আইসিটি ক্যাডার বিলুপ্ত করে জেনারেল ব্যাংকিং ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত করার যে উদ্যোগ ম্যানেজমেন্ট গ্রহণ করেছে, তা নিয়ে ব্যাংক পাড়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে ভুল বুঝিয়ে স্বার্থান্বেষী একটি মহল ইতোমধ্যে আত্মঘাতী এই প্রস্তাব অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে এবং চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য তা বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

ব্যাংকিং ও প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ব্যাংকটি প্রযুক্তিগতভাবে অন্তত ২৫ বছর পিছিয়ে পড়বে এবং সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি ও দুর্নীতির এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।

নেপথ্যে ‘সুপার নিউমারি’ পদোন্নতি ও পদায়ন সংকট

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বছরে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে ‘সুপার নিউমারি’ (পদ না থাকলেও পদোন্নতি) ভিত্তিতে অসংখ্য কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এর ফলে ব্যাংকের সাংগঠনিক কাঠামোর চেয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, যা প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। এই সমস্যা সমাধানে অর্থ মন্ত্রণালয় চারটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের জন্য অভিন্ন নীতিমালা তৈরির লক্ষ্যে একজন পরামর্শক নিয়োগ দেয়।

মূল পরিকল্পনা ছিল প্রতিটি বিভাগের কাজের পরিধি অনুযায়ী নতুন পদ সৃষ্টি করে এই বাড়তি কর্মকর্তাদের সমন্বয় করা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, রূপালী ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট এই সুযোগকে ভিন্নভাবে কাজে লাগাতে চাইছে। আইসিটি বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় নতুন পদ সৃষ্টি না করে, উল্টো আইসিটি ক্যাডারকেই জেনারেল ক্যাডারের সাথে মিশিয়ে ফেলার পাঁয়তারা চলছে।

কারিগরি পদে অ-কারিগরি নেতৃত্ব: লুটপাটের নতুন ছক?

ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, বর্তমানে আইসিটি বিভাগে উচ্চতর পদগুলোতে (ডিজিএম, এজিএম) যোগ্য কর্মকর্তার সংকট রয়েছে। অন্যদিকে জেনারেল ব্যাংকিংয়ে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তার সংখ্যা পদের তুলনায় অনেক বেশি। জেনারেল ক্যাডারের এই ‘পোস্টিংবিহীন’ বাড়তি জনবলকে আইসিটির উচ্চ পদগুলোতে বসানোর জন্যই এই একীভূতকরণের নকশা করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, অতীতে যখনই নন-আইটি বা জেনারেল ব্যাকগ্রাউন্ডের কেউ আইসিটি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন, তখনই ব্যাংক চড়া দামে অপ্রয়োজনীয় ও নিম্নমানের সফটওয়্যার ক্রয়ের ফাঁদে পড়েছে। বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশ বা অন্যান্য উৎস থেকে সফটওয়্যার কেনাকাটায় ‘কমিশন বাণিজ্য’র সুযোগ তৈরি হয়।

তারা আরও বলেন, আইসিটি ক্যাডার স্বতন্ত্র থাকলে এবং নেতৃত্বে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোক থাকলে এই ধরণের দুর্নীতি করা কঠিন। তাই এই একীভূতকরণ মূলত দুর্নীতির পথ প্রশস্ত করার একটি সুকৌশল পদক্ষেপ বলে মনে করছেন অনেকে।

নিরাপত্তা ঝুঁকি ও পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা

বর্তমান যুগে ব্যাংক মানেই টেকনোলজি। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট কিংবা ফিনটেক—এসব বিষয়ে একজন জেনারেল ব্যাংকিং কর্মকর্তার পক্ষে গভীর জ্ঞান রাখা সম্ভব নয়। যেখানে সাইবার নিরাপত্তা ব্যাংকিংয়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে নন-টেকনিক্যাল লোক দিয়ে আইসিটি বিভাগ পরিচালনা করা ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ধসিয়ে দিতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, জেনারেল অফিসার দিয়ে আইসিটি ডিপার্টমেন্ট চালানোর চিন্তা করা মানে ‘এনালগ’ যুগে ফিরে যাওয়া।

আইসিটি কর্মকর্তাদের ক্যারিয়ার ধ্বংসের মুখে

এই একীভূতকরণ কার্যকর হলে ব্যাংকের আইসিটি কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা। ব্যাংকিং প্রমোশন নীতিমালায় সাধারণত যারা শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন, তারা পারফর্মেন্সের ওপর অতিরিক্ত নম্বর পেয়ে থাকেন। আইসিটি কর্মকর্তাদের কাজের ধরণ ভিন্ন হওয়ায় তাদের শাখায় কাজ করার সুযোগ নেই, ফলে তারা এই নম্বর থেকে বঞ্চিত হবেন।

একই স্কেলে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে আইসিটি কর্মকর্তারা সবসময় জেনারেল কর্মকর্তাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়বেন এবং এজিএম বা ডিজিএম হওয়ার সুযোগ হারাবেন। এতে মেধাবী আইটি গ্রাজুয়েটরা ব্যাংকিং পেশায় আসতে নিরুৎসাহিত হবেন, যা দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকে বড় ধরণের মেধা শূন্যতা তৈরি করবে।

মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ জরুরি

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে বিশেষায়িত কাজের জন্য বিশেষায়িত জনবল ও কাঠামোর কোনো বিকল্প নেই। জেনারেল কর্মকর্তাদের পুনর্বাসনের জন্য স্পর্শকাতর আইসিটি খাতকে বলি দেওয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না।

এমতাবস্থায়, ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ—অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত রূপালী ব্যাংকের এই ত্রুটিপূর্ণ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রস্তাবটি নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করে বাতিল করা। একইসাথে আইসিটি বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী জনবল কাঠামো অনুমোদন করা এখন সময়ের দাবি। অন্যথায়, এই ভুল সিদ্ধান্তের চড়া মাশুল দিতে হবে পুরো ব্যাংকিং খাতকে।

এই বিষয়ে জানতে রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো: নজরুল হূদা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো: ওয়াহিদুল ইসলাম এবং জেনারেল ম্যানেজার মো: শাফায়াত হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেয়া হলেও কেউ কল রিসিভ করেননি। 

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.