September 19, 2024, 10:34 pm


আবু তাহের বাপ্পা

Published:
2019-12-26 01:15:57 BdST

ব্যাংকিং খাতে সুখবর ছাড়াই শেষ হলো বছর


এফটি বাংলা

অনিয়ম-দুর্নীতি, খেলাপি ঋণের প্রবৃদ্ধি এবং আইনি সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে ২০১৯ শেষ করল ব্যাংকিং খাত। নতুন বছরে সকল দুর্বলতা কাটিয়ে আর্থিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে যাওয়ার প্রত্যাশা খাত সংশ্লিষ্টদের।

এ বছরে খেলাপি ঋণে হাজার কোটি টাকার সেঞ্চুরি, অনিয়মের দায়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়ন, ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা, নতুন তিন ব্যাংকের অনুমোদন এবং আমানত গ্রহণ ও ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ৬ ও ৯ শতাংশ সুদহার বাস্তবায়ন ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়ন

অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর লুটপাটের অভিযোগে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (পিএলএফএসএল)-কে প্রথমবারের মতো অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের ১৪ জুলাই পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য আদালতে মামলা দায়ের করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া অনিয়মের দায়ে বহিষ্কার করা হয় প্রতিষ্ঠানের নয় পরিচালককে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযোগ, বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে ৫৭০ কোটি টাকা বের করে নেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা।

এদিকে পিপলস লিজিং বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েন প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীরা। প্রতিষ্ঠানটির বেশিরভাগ সম্পদ লুটে নেয়ায় আমানত ফেরত নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। আমানতকারীরা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে টাকা ফেরত পেতে অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু এখনও কোনো সুরাহ হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির আমানতের তুলনায় সম্পদের পরিমাণ বেশি রয়েছে। বর্তমানে আমানত রয়েছে ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সম্পদ রয়েছে তিন হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। তাই পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা

সুবিধা ১. চলতি বছরের ১৬ মে ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট-সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দমানে খেলাপি ঋণ মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বিপরীতে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুবিধা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহারের সীমা ঠিক করে দেয়া হয় ৯ শতাংশ। পুনঃতফসিলের আগে গ্রাহককে সুদ মওকুফ সুবিধাও দেয়া যাবে।

সবশেষ তথ্য অনুযায়ী চতুর্থবারের মতো এই সুবিধার সময়সীমা আরও ৯০ দিন বাড়ানো হয়েছে। এই সময়সীমা শেষ হবে ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি।

সুবিধা ২. রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ দেখিয়ে ২০১৫ সালে বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধে বিশেষ নীতিমালা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময় ১১ শিল্প গ্রুপের ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। বেশিরভাগ গ্রুপের ঋণ আবারো খেলাপি হয়ে পড়ায় সুপারিশের ভিত্তিতে নতুন করে প্রতিটির সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে এতদিন যেসব গ্রাহক নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করেছেন কিন্তু বিশেষ কোনো কারণে এখন অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন শুধু তারাই পুনঃতফসিলের এই নতুন সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন।

শিল্প গ্রুগুলোর মধ্যে রয়েছে- বেক্সিমকো গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, থার্মেক্স গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ, আবদুল মোনেম লিমিটেড, কেয়া গ্রুপ, এসএ গ্রুপ (এসএ অয়েল রিফাইনারি ও সামান্নাজ), বিআর স্পিনিং, এননটেক্স গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ এবং রাইজিং স্টিল।

সরকারি-বেসরকারি প্রায় ২৪টি ব্যাংক থেকে ১৫ হাজার ২১৭ কোটি টাকা সুবিধা নিয়েছিল শিল্প গ্রুপগুলো। নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংকগুলোর পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। যার কারণে বেশ কিছু ব্যাংক নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) ঘাটতিতে পড়েছে।

খেলাপি ঋণ

এবছর রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড তৈরি করেছে খেলাপি ঋণ

‘খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না’ এমন ঘোষণার পরেও গত নয় মাসে খেলাপি ঋণ না কমে উল্টো বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত ৯ মাসে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার নয় কোটি টাকা।

বছরজুড়ে তারল্য সংকট

তারল্য সংকটের কারণে ধারাবাহিকভাবে কমছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ। অন্যদিকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিচ্ছে সরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের কোনো মাসেই মুদ্রানীতি ঘোষীত বেসরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের ঘোষিত ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ।

উল্লেখ, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালের আগস্টের তুলনায় চলতি বছরের (২০১৯) আগস্টে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর আগে জুলাই শেষে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ। তার আগের মাস জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ, মে মাসে ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ, এপ্রিলে ১২ দশমিক ০৭ শতাংশ, মার্চে ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ। অন্যদিকে মাত্র পাঁচ মাসেই নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার সমপরিমাণ ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার।

উচ্চ সুদহারে বিনিয়োগ ব্যাহত

ব্যাংক ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজেটে না আনতে পারায় সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ঋণের চড়া সুদে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সীমাহীন।

ব্যাংক ঋণের সুদের এত উচ্চহার পৃথিবীর কোথাও নেই। সিঙ্গেল ডিজিট কার্যকর না হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মাঝারি ও ক্ষুদ্র সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের করুণ অবস্থা।

অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও সরকারি ব্যাংক বাদে হাতেগোনা দু-একটি বেসরকারি ব্যাংক সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ দিচ্ছে। বাকিরা আমলেই নিচ্ছে না।

নয়-ছয় সুদ হার

ছয় শতাংশ সুদে আমানত নিয়ে নয় শতাংশে ঋণ বিতরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে একাধিক সুবিধা নেওয়ার পরেও আজও শুরু হয়নি এই প্রক্রিয়া। তবে শুধু উৎপাদনশীল খাতে ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার জন্য সম্প্রতি একটি কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

স্বল্প সুদে শিল্প ঋণ বিতরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসহ পুরো সুপারিশমালা অর্থমন্ত্রীর কাছে ইতোমধ্যেই হস্তান্তর করা হয়েছে।

উল্লেখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংকের কর্পোরেট করহার ৪২.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এতে ব্যাংকগুলো ২.৫ শতাংশ ট্যাক্স সুবিধা পায়। ফলে ১৩ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকার সুবিধা পেয়েছেন ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকরা।

ব্যাংক সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি খাতে প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে রক্ষিতব্য সাধারণ প্রভিশন সংরক্ষণের হার ২.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সময়ে এতে ব্যাংকগুলো ৫৩৪ কোটি টাকা সুবিধা ভোগ করেছে।

একইভাবে গৃহায়ণ খাতে রক্ষিতব্য সাধারণ প্রভিশন সংরক্ষণ হারেও সুবিধা দেয়া হয়। গৃহায়ণ খাতে সাধারণ প্রভিশন সংরক্ষণের হার ২ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এতে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ২৫৫ কোটি টাকা সুবিধা পায়।

সব মিলিয়ে শুধু এ সুবিধাগুলো থেকে ব্যাংকগুলোর লাভ হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় সরকারি তহবিল জমার হার বৃদ্ধি, পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত থাকার মেয়াদ ও একক পরিবারের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ১০ বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল এবং ঋণ শ্রেণিকরণ নীতিমালা শিথিলকরণ সুবিধা দেয়া হয়েছে। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

নতুন ৩ ব্যাংক অনুমোদন

চলতি বছরে ব্যাংক খাতের আরেকটি সমালোচনার বড় জায়গা হলো নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন। ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের বিরোধিতা সত্ত্বেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া হয় নতুন তিন ব্যাংকের অনুমোদন। ব্যাংকগুলো হলো- বেঙ্গল কমার্শিয়াল, পিপলস ও সিটিজেন ব্যাংক।

প্রাথমিকভাবে আগ্রহপত্র বা লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) পাওয়ার পরও শর্ত অনুযায়ী পর্যাপ্ত মূলধন সংগ্রহসহ বিভিন্ন নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থ হওয়ায় এখনও চূড়ান্ত লাইসেন্স পায়নি এসব ব্যাংক।

তবে চলতি বছর কার্যক্রম চালু করেছে পুলিশের মালিকানাধীন কমিউনিটি ব্যাংক। ব্যাংকটি গত বছর অনুমোদন পেয়েছিল।

রেমিট্যান্সে প্রণোদনার সুফল

অর্থনীতির অন্যান্য সূচক নেতিবাচক হলেও সুবাতাস বয়েছে প্রবাসী আয়ে। রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা প্রদান এবং টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে বৈধ পথে বেড়েছে রেমিট্যান্সের প্রবাহ।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ৭৭১ কোটি ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। গত বছর একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৬২৯ কোটি ডলার।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা