April 26, 2024, 8:26 am


সামি

Published:
2020-01-06 08:16:00 BdST

ভেঙ্গে গেল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিন্ডিকেট?


এফটি বাংলা

একজন নিষ্ঠাবান সচিব একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা। সকলেই জানতেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মুখ্য সচিব হিসেবে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। কারণ সিনিয়রিটিসহ সব বিষয়ের বিবেচনায় তিনি এগিয়ে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হওয়ার সময় নাটকীয় ঘটনা ঘটলো। প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকে নিলেন, ডেকে নিয়ে তাকে জানালেন যে, সামনে নির্বাচন এবং নানা বাস্তবতার কারণে তাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নেওয়া হচ্ছে না। বরং আচমকাভাবে তৎকালীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর চেয়ারম্যানকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিয়ে আসা হলো।

২০১৮ সালের এই ঘটনাটি সাধারণ বিচারে একটি সাদামাটা ঘটনা ছিল। কিন্তু সচিবালয় এবং সরকারের সিনিয়র কর্মকর্তারা মনে করেন, একটি সিন্ডিকেটের কারসাজিতেই সেই সময় তৎকালীন জনপ্রশাসন সচিবকে বাদ দিয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানকে সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

এই কারাসাজি করেছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে থাকা একটি সিন্ডিকেট। যে সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আবুল কালাম আজাদ বলেও প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তারা মনে করেন।

যদিও সরকারের নীতি নির্ধারকরা বলেন, এরকম কোন সিন্ডিকেট নেই। কিন্তু দীর্ঘ ৫ বছর পর বিদায় নেওয়ার পরপরই আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে।

অভিযোগ উঠেছে যে, তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বিভিন্ন জায়গার দায়িত্ব দিয়েছেন। তার ঘনিষ্ঠরা বিভিন্ন সময় পদ পদবি পেয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তিন বন্ধুর এই সিন্ডিকেটের কথা এখন প্রকাশ্যেই আলাপ আলোচনা হচ্ছে প্রশাসনের ভেতরে বাইরে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে যে আবুল কালাম আজাদ প্রধানমন্ত্রীর সচিব থাকা অবস্থা থেকেই তিনি তার পক্ষের লোকজনকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। এরকম অভিযোগ উঠেছে কোনো কোনো মহল থেকে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, শুধুমাত্র আবুল কালাম আজাদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণেই ড. প্রশান্ত কুমারকে সচিব করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে সুর্নির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরেও তাকে সচিব করা হয়। অন্য আরেকজন সচিব এখনও একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগ থাকার পরেও তাকে নড়ানো যায়নি শুধুমাত্র আবুল কালাম আজাদের ঘনিষ্ঠ এই বিবেচনায়।

আবুল কালাম আজাদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তার আধিপত্য নিশ্চিত করার জন্যই অনেক যোগ্যদের ডিঙিয়ে এক নারী কর্মকর্তাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব হিসেবে নিয়ে আসেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই নারী কর্মকর্তা একসময় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন এবং সংস্কৃতিমন্ত্রী তার বিরুদ্ধে অযোগ্যতার অভিযোগ এনে তাকে অন্যত্র বদলি করার জন্য লিখিত সুপারিশ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, আবুল কালাম আজাদ যখন মুখ্যসচিব হিসেবে মেয়াদ শেষ করেন, এসডিজি বিষয়ক সমন্বয়ক হন। তখন তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কামাল নাসের চৌধুরীকে মুখ্যসচিব হিসেবে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কামাল নাসের চৌধুরী একবছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও পেয়েছিলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে যে, কামাল নাসের চৌধুরী জনপ্রশাসন সচিব থাকা অবস্থায় তার পছন্দের ব্যক্তিদের পদোন্নতি দেওয়া এবং তিনি, আবুল কালাম আজাদ এবং তার বন্ধুরা মিলে প্রশাসনে একটি আলাদা বলয় তৈরি করেছিলেন, যে বলয়ের বাইরে কেউ থাকলেই তাদেরকে পদোন্নতি দেওয়া হতো না।

এই বলয়ের বাইরে থাকার কারণেই প্রশাসনের ৮২ ব্যাচের জেষ্ঠ্যতম কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও ড. জাফর আহমেদ খানকে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি করা হয়নি। তার বদলে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি শফিউল আলমকে এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। আবার ড. কামাল নাসের চৌধুরীর আত্মীয় হওয়ার কারণেই বিএনপিপন্থী একজন আমলাকে সচিব পদমর্যদায় দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া পরবর্তীতে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের জন্যও তার নাম সুপারিশ করা হয়েছিল। সর্বশেষ এই সিন্ডিকেটে যুক্ত হয়েছিলেন নজিবুর রহমান।

জানা গেছে, শুধুমাত্র আবুল কামাল আজাদ এবং ড. কামাল নাসের চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণেই নজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। নজিবুর রহমানকে প্রধানমস্ত্রীর কার্যালয়ে নিয়ে আসাটা ছিল একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা।

প্রশাসনের অনকেই মনে করেন, এই তিন কর্মকর্তার সিন্ডিকেটের কারণে অনেক মেধাবী, প্রতিভাবান আমলারা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন অথবা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় পাননি। তাদের অনুগ্রহপুষ্ট এবং আর্শীবাদ না পাওয়া গেলে আমলা হওয়া যায় না- এমন বিষয়টিও চাউর ছিল।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রশাসনের নিয়ন্ত্রক ছিলেন ড. হোসেন তৈফিক ইমাম বা এইচ টি ইমাম। কিন্তু ক্রমশ ৮২ ব্যাচের এই কর্মকর্তাদের উত্থানের পর কোণঠাসা হয়ে পড়েন এইচ টি ইমাম এবং প্রশাসনের রদবদলের কলকাঠি চলে যায় আবুল কালাম আজাদত্রয়ীদের কাছে।

পরবর্তীতে ৮৫ ব্যাচের উত্থান ঘটে এবং তখন ফয়েজ আহমেদ এবং সাজ্জাদুর রহমানরা প্রশাসনের পদোন্নতি এবং নিয়োগ-বদলির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরা দুইজন ছিলেন কৃষিবিদ। তারা ক্ষমতা পেয়ে কৃষিবিদদের এক সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন।

সাম্প্রতিক সময়ে এই সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী এবং একসাথে ১০ জন সচিব অবসরে গেছেন। এর ফলে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তারা মনে করছেন যে, এর ফলে সিন্ডিকেট ভেঙে গেছে এবং প্রশাসনে বিশেষ ব্যক্তির অনুগ্রহপুষ্ট না হয়ে শুধুমাত্র যারা মেধাবী এবং সৎ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়া উচিত এবং এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন।

তারা উদাহরণ হিসেবে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাবিনেট সচিব হিসেবে আনোয়ার ইসলামকে দায়িত্ব দেয়া ছিল প্রধানমন্ত্রীর সাহসী সিদ্ধান্ত। তেমনি ড. আহমদ কায়কাউসকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব এবং জুয়েনা আজিজকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়কের পদে দায়িত্ব দেওয়া ছিল প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্ত।

সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী তাঁর কার্যালয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন এবং একারণেই তিনি এসকল সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে তিনি এ ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।

তবে প্রশাসনের অনেকে মনে করেন যে, আবুল কালাম আজাদ বা ড. কালাম নাসের চৌধুরী অত্যন্ত সৎ-মেধাবী এবং আওয়ামী লীগের প্রতি একনিষ্ঠ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। যেকোন প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা চলে যাবার পর তাঁর যেমন ইতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়, তেমনি তাঁর নেতিবাচক দিক নিয়েও আলোচনা হয়- এগুলো স্রেফ অপপ্রচার।

তবে অপপ্রচার হোক কিংবা প্রচারই হোক, সচিবালয়ে কান পাতলেই এখন সিন্ডিকেট ভাঙার গুঞ্জন শোনা যায়।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা