September 19, 2024, 7:43 am


Siyam Hoque

Published:
2020-03-23 16:21:38 BdST

হটলাইনে ঢোকাই কঠিন


প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস-সংক্রান্ত তথ্য জানতে কিংবা পরামর্শের জন্য হটলাইন চালু করেছে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এই হটলাইনে ১৭টি মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। আইইডিসিআর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, হটলাইনের এই ফোন নম্বরগুলো সার্বক্ষণিক চালু থাকবে। ১৭ জন চিকিৎসকের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করে এই হটলাইন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কেউ ফোন করলে তারা পরামর্শ দেবেন। কারও পরীক্ষার প্রয়োজন হলে কোথায়, কীভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাবে সে সম্পর্কে সব তথ্য তারা অবহিত করবেন। তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, এসব লাইনে ঢোকাই দুরূহ।

আইইডিসিআর থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়েছে, বিদেশফেরত এবং তাদের সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তিসহ কারও জ্বর, কাশি, সর্দি, শ্বাসকষ্ট, গলা-মাথা-বুক ও শরীর ব্যথা হলে হটলাইনে যোগাযোগ করবেন। হটলাইনে যোগাযোগ করলে আইইডিসিআর টিম আক্রান্ত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে আসবেন।

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাও একাধিকবার সংবাদ সম্মেলনে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সরাসরি আইইডিসিআরে না গিয়ে হটলাইনে ফোন করে সেবা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। করোনার উপসর্গ থাকা ব্যক্তিরা শতবার ফোন করেও হটলাইনের দেওয়া নম্বরের লাইন পাচ্ছেন না। ফোন নম্বরগুলো শুধু ব্যস্ত দেখায়। সৌভাগ্যক্রমে কেউ ফোনের লাইন পেলেও অনেক সময় তা আবার রিসিভ হয় না। আবার কোনো কোনো সময় ফোন নম্বরগুলো বন্ধ পাওয়া যায়। এ অবস্থায় প্রতিদিন শত শত মানুষ রাজধানীর মহাখালীর আইইডিসিআর কার্যালয়ের সামনে ভিড় করছেন। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। প্রাণঘাতী সংক্রামক ব্যাধি করোনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও বাড়ছে। ক্ষুব্ধ মানুষ প্রশ্ন তুলছেন, এমন অবস্থা চললে এই হটলাইনের কী প্রয়োজন?

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, একটি কেন্দ্রে পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার চিন্তা ছিল অবিবেচনাপ্রসূত। ১৭ কোটি জনগোষ্ঠীর জন্য মাত্র একটি পরীক্ষাকেন্দ্রে কীভাবে সামাল দেওয়া সম্ভব? সর্বত্রই এই পরীক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে, সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে দ্রুত পরীক্ষা করে শনাক্ত করতে হবে এবং তাকে অন্যদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। এটিই হলো এই ভাইরাস প্রতিরোধের মূলমন্ত্র। অথচ এই পরীক্ষার কিটেরই সংকট চলছে। তিন মাস থেকে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা যেভাবে গণমাধ্যমে বলা হলো, সেই প্রস্তুতিটা আসলে কী ছিল? এটি কারও কাছেই বোধগম্য নয়। মাত্র ১৭টি ফোন নম্বরে হাজার হাজার মানুষ ফোন করতে থাকলে সংযোগ পাওয়া অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। যেহেতু ভাইরাসটি ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে, সুতরাং পরীক্ষাকেন্দ্র বাড়াতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

হটলাইন নিয়ে সীমাহীন অভিযোগ : প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রথম মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তির সরাসরি চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন ডা. তারিকুল ইসলাম শিশির নামে এক চিকিৎসক। তিনি বর্তমানে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন। গত শনিবার সকালে তিনি নিজের ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে জানিয়েছেন, সন্দেহভাজন হওয়ার পরও তাকে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেনি। স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, 'প্রিয় বাংলাদেশ শুভ সকাল আজকে আমার হোম কোয়ারেন্টাইনের চার দিন। সুনিশ্চিত করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসার কারণে এবং পরবর্তীতে জ্বর, কাশি, গলাব্যথা, মাথাব্যথা হওয়ায় আমাকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়। আমি আমার জায়গা থেকে তা পুরোপুরি মেনে চলছি। কিন্তু এই চার দিন বিভিন্নভাবে আইইডিসিআরে যোগাযোগ করেও নিজের টেস্ট করাতে পারিনি। যদিও গলাব্যথা, কাশি ছাড়া বাকি উপসর্গ কিছুটা ভালোর দিকে। কিন্তু তারা একবারও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করে নাই। বর্তমানে সারাদেশে ৯০ হাজারেরও বেশি চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন। তাদের সবার পরিবার আছে। আমি আপনাদেরকে বলছি, আর যাই করেন নিজের নিরাপত্তা ছাড়া চিকিৎসা দিতে যাবেন না। কেননা যদি আপনি আক্রান্ত হন, তাহলে আপনার টেস্ট হবে কি-না সেটাই নিশ্চিত না। বাকি সব বাদ দেন।'

ডা. রেহেনুমা রাইয়ান মালিক নামে অন্য এক চিকিৎসক গত বৃহস্পতিবার ফেসবুকে লিখেছেন, 'আমার আব্বু ঢাকার স্বনামধন্য একটি হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান। বুধবার ৬০ বছর বয়সী এক রোগী ওই হাসপাতালে আসেন। তার তিন দিন ধরে জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট। রোগীর সবকিছু দেখে আব্বুর সন্দেহ হয়, সে করোনা পজিটিভ। রোগীর স্বজনদের করোনা চিকিৎসার নির্ধারিত হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু তারা যেতে রাজি হননি। বরং পাল্টা বলেছেন, করোনা আক্রান্তের প্রমাণ দিন। বিষয়টি আইইডিসিআরে জানানোর পর তারা গড়িমসি করে এবং বিদেশফেরত বা তার পরিবার না হলে তারা পরীক্ষা করছে না বলে জানান। কারণ কিট সংকট। বারবার বলার পর আইইডিসিআর বৃহস্পতিবার সকালে স্যাম্পল নিয়ে যায় এবং পরীক্ষার পর নিশ্চিত করা হয় রোগী করোনা পজিটিভ।'

করোনায় গত শনিবার মৃত ব্যক্তির ছেলে ফেসবুকে আবেগঘন এক স্ট্যাটাসেও আইইডিসিআরের সংযোগ পাওয়া নিয়ে দুর্ভোগের কথা জানিয়েছেন। একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা ওই ব্যক্তি লিখেছেন, 'গত ১৬ মার্চ তার বাবা অসুস্থ বোধ করলে ডাক্তার তাকে করোনার টেস্ট করাতে বলেন। এরপর টেস্টের জন্য আমরা আইইডিসিআরের হান্টিং নম্বরে ফোন দেওয়া শুরু করি। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর তাদের সঙ্গে আমরা কমিউনিকেশন করতে সক্ষম হই। তারা আমাদের জানায়, যেহেতু অসুস্থ ব্যক্তি বিদেশফেরত না এবং বিদেশফেরত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে উনি আসেন নাই সেহেতু এই টেস্ট উনার জন্য প্রযোজ্য নয়। আমি তাদের বলেছিলাম, উনি মসজিদে যান এবং ওখান থেকে এই ভাইরাস আসতে পারে কিনা? তারা আমাদের বলেছেন যে, এই ভাইরাস বাংলাদেশে কমিউনিটিতে মাস লেভেলে এখনও সংক্রমিত হয়নি। সুতরাং আপনারা চিন্তা করেন না, এটা সাধারণ শ্বাসকষ্টের প্রবলেম।'

তিনি লিখেছেন, 'এরপর ১৮ তারিখ দুপুর থেকে আমরা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি কিন্তু ব্যর্থ হই। অতঃপর ১৯ তারিখ বিকেলে আইইডিসিআর রাজি হয় এবং রাতে টেস্ট করে এবং পরদিন ২০ তারিখ দুপুরে আইইডিসিআর আমাদের জানায় যে, রিপোর্ট পজিটিভ। আমাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলে ১৫ দিন। ২১ তারিখ ভোর ৩টার সময় বাবা ইন্তেকাল করেন।'

করোনা পরীক্ষার নামে এভাবেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছে মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন অসংখ্য অভিযোগ ছড়িয়ে পড়েছে। সমকালে ফোন করেও অনেকে করোনা পরীক্ষা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন।

রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আইইডিসিআরের মতো এসব হাসপাতালও চিকিৎসার জরুরি প্রয়োজনে হটলাইন নম্বরে ফোন করার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু সেসব নম্বরেও ফোন করে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অন্তত ১০ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেও এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব কর্মকর্তা বলেছেন, হটলাইনে তারাও অনেকবার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু কখনও ফোনের সংযোগ পাননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর সমকালকে বলেন, রোববার সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তিনি প্রায় একশ' ফোন রিসিভ করেছেন। সবই ছিল করোনা তথ্য সম্পর্কিত। এভাবে সারাদিন সহস্রাধিক ফোন তাকে রিসিভ করতে হয়। এর বাইরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করতে হয়। শুরুতে হটলাইনের নম্বর ছিল মাত্র তিনটি। পর্যায়ক্রমে তা বাড়িয়ে ১৭টি করা হয়েছে। কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সারাদেশ থেকে মানুষ ফোন করে তথ্য জানতে চাইছে। হাজার হাজার মানুষ যখন একযোগে ফোন করবেন, তখন অনেক সময় নম্বর ব্যস্ত দেখাবে। আবার যারা নম্বরগুলো অপারেটর করেন, তাদেরও তো বিরতিতে যেতে হয়। একটানা তো আর ফোন রিসিভ করা সম্ভব নয়। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিধি দ্রুতই বাড়ানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, হটলাইন নিয়ে অনেকেই অভিযোগ করছেন, এসব লাইন সবসময় ব্যস্ত থাকে, পাওয়া যায় না- বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবহিত। এ ব্যবস্থাটি সহজ করার জন্য এরই মধ্যে কয়েকটি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নতুন ব্যবস্থা হিসেবে টেলিফোন নম্বরের বাইরে ই-মেইল ও অ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে। কভিড-১৯ সংক্রান্ত ব্যাপারে আমাদের একটি ফেসবুক পাতা খোলা হয়েছে। সেখানে আপনারা বক্তব্য জানাতে পারেন।

ডা. ফ্লোরা বলেন, ফেসবুক আইডি https://www.facebook.com/iedcr/ এবং ই-মেইল আইডি : [email protected]  ফেসবুক আইডিতে মেসেঞ্জারের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য জানানো যাবে। এই অ্যাপে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করার মাধ্যমে বোঝা যাবে তার নমুনা সংগ্রহের প্রয়োজন আছে কিনা। এ ছাড়া Iedcr, COVID-19 Control Room ফেসবুক আইডির মাধ্যমে তথ্য জানা যাবে।
আইইডিসিআর থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, হটলাইনে যোগাযোগের জন্য ৩৩৩, স্বাস্থ্য বাতায়নের হটলাইন ১৬২৬৩ নম্বরে ফোন করা যাবে। একই সঙ্গে আইইডিসিআরের হটলাইন নম্বর ০১৫৫০০৬৪৯০১, ০১৫৫০০৬৪৯০২, ০১৫৫০০৬৪৯০৩, ০১৫৫০০৬৪৯০৪, ০১৫৫০০৬৪৯০৫, ০১৪০১১৮৪৫৫১, ০১৪০১১৮৪৫৫৪, ০১৪০১১৮৪৫৫৫, ০১৪০১১৮৪৫৫৬, ০১৪০১১৮৪৫৫৯, ০১৪০১১৮৪৫৬০, ০১৪০১১৮৪৫৬৩, ০১৪০১১৮৪৫৬৮, ০১৯২৭৭১১৭৮৪, ০১৯২৭৭১১৭৮৫, ০১৯৩৭০০০০১১, ০১৯৩৭১১০০১১ নম্বরে ফোন করে করোনা সংক্রান্ত তথ্য জানা যাবে।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা