নেহাল আহমেদ, রাজবাড়ী প্রতিনিধি
Published:2021-10-27 06:24:14 BdST
তিন দশকে নদী গর্ভে ৯ হাজার ৯৬০ হেক্টর জমি
আহাদ ব্যাপারীর সাথে দেখা পদ্মা নদীর পাড়ে।ভাঙ্গন দেখতে এসেছেন। এখন তিনি থাকেন রাজবাড়ী সদরের বানিবহ ইউনিয়নে। তিনি বললেন 'ঐ যে ধু ধু অঞ্চল দেখছেন, ঐখানে ছিল আমাদের বাড়ী'।
এরকম হাজারো আহাদের স্বপ্ন, আশা, ভালবাসা কেড়ে নিয়েছে রাক্ষুসে পদ্মা। সম্পতি ৩৭৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও কোন সুফল পাওয়া যাচ্ছেনা। ৩ মাসে অনন্ত ১৫ টি স্থানে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। আর এজন্য অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলনকে দায়ী করছে এলাকাবাসী।
আজ সকালে আবার শুরু হয়েছে ভয়াবহ ভাঙ্গন। মুহুর্তে তলিয়ে গেছে ২০০ মিটার এলাকা। পাড়ের মানুষের ঘর সরানো আর কান্নায় ভারী উঠেছে এলাকা।
ভাঙ্গন এলাকা মিজানপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এফটি টীমকে বলেন 'আমি কেন, আমার ইউনিয়নের সবাই বলে অপরিকল্পিত এবং অবৈধ বালু উত্তোলন নদীভাঙ্গনকে ত্বরান্বিত করেছে'।
জেলার পাঁচটি উপজেলার চারটি উপজেলা পাংশা-কালুখালী-রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলা পদ্মার পাড় ঘেষে। গেল তিন দশকের বেশি সময় ধরে পদ্মার তীব্র ভাঙনের মুখে পড়েছে এই জেলা। এরই মধ্যে নদীর পেটে চলে গেছে হাজার হাজার হেক্টর জমি, ঘড়বাড়ি, গাছপালা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, কবরস্থানসহ বিভিন্ন স্থাপনা ।
গত দুই মাসে পদ্মার ভাঙ্গনে এক হাজার মিটারের বেশি এলাকাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও বসতভিটা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সদর উপজেলায় পদ্মা এখন পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডে প্রবেশ করেছে। এলাকাভেদে শহররক্ষা বাধ থেকে নদীর দূরত্ব পাঁচ থেকে দশ ফিটের মধ্যে। যে কোন মূহর্তে শহররক্ষা বেড়িবাধটিও পদ্মার পেটে চলে যাওয়ার আশঙ্কা স্থানীয়দের।ফলে চলমান ভাঙনের ফলে পদ্মা পাড়ের মানুষেরা উদ্বেক- উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে।
সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের শফিক মোহাম্মদ আলী জানায়, একটা সময় তার জায়গা জমি ছিলো প্রায় আশি বিঘা। সে সময় তার জমিতে উস্তা, পটল, ধান, আখসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করতো। সংসারে কোন অভাব ছিলো না। গত এক দশকে নদী ভাঙ্গনের কারণে সব হারিয়ে তিনি এখন নিঃস্ব।
একই গ্রামের মোঃ কেসমত আলী মন্ডল বলেন, তার একশত বিঘা জমি ছিলো। সেই জমি থেকে ধান, পাট, সবজিসহ বিভিন্ন সবজি আবাদ হতো। ক্ষেত পরিচর্যার জন্য প্রতিদিন পনের থেকে বিশজন শ্রমিক কাজ করতো। ভাঙ্গনের কারণে তার জায়গা-জমি সব কিছুই এখন পদ্মার পেটে। এখন তিনি অন্যের বাড়িতে শ্রম বিক্রি করে সংসার চালান। অর্থের অভাবে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারেন না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, ১৯৮৫ সাল থেকে ২০২১ সালে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত নদীতে বিলীন হয়েছে ৯ হাজার ৯৬০ হেক্টর জমি। এর মধ্যে সদর উপজেলা থেকে গোয়ালন্দ উপজেলা পর্যন্ত ৮ হাজার হেক্টর, সদর থেকে কালুখালী ২৬০ হেক্টর, কালুখালী থেকে পাংশা উপজেলায় ১ হাজার ৭শত হেক্টর জমি। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী নদী ভাঙ্গন রোধে ৩টি প্রকল্পে ৫৫০ কোটি ৬৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দ এসেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল আহাদ জানান, 'নদীর গতিপথ পরিবর্তনের জন্য ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে। নদীর পাড় যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয় তার জন্য জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলে ভাঙ্গন রোধ করা হয়েছে। রাজবাড়ী জেলায় ৮৫ কিলোমিটার এলাকায় রয়েছে পদ্মা নদী। সব জায়গাতে নদীর তীর সংরক্ষন করা সম্ভব না বা প্রয়োজনও নাই। যেসব জায়গা অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ সে সব জায়গা চিহ্নিত করে বড় একটা প্রকল্পের প্রস্তাব করেছি। সেই প্রকল্পে পাংশা ও কালুখালী উপজেলায় ১১ কিলোমিটার, সদর উপজেলার চরসিলিমপুর থেকে মহাদেবপুর ৪ কিলোমিটার, গোয়ালন্দ উপজেলার অন্তর মোড় থেকে গোয়ালন্দ পযন্ত চার কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ কাজ ধরা আছে। আমরা ইতিমধ্যেই বোর্ডে একটি নোটশীট প্রেরণ করেছি। যেন সব মিলিয়ে ২০ কিলোমিটার এলাকার কাজ স্থায়ী ভাবে সিসি ব্লক দ্বারা প্রয়োজন আছে কি না এবং ড্রেজিং কম্পোনেন্ট করার প্রয়োজন রয়েছে কি না। এবং ড্রেজিং কম্পোনেন্ট অন্তভূক্ত করলে ঠিক কতটুকু দরকার আছে। এটা যুক্তিযুক্তভাবে এবং মর্ফলজিক্যাল স্ট্যাজি করবার জন্য বোর্ডে দিয়েছি। বোর্ড থেকে একটা মর্ফলজিক্যাল স্ট্যাজি হবে যে ভাঙ্গন প্রবল এলাকায় কোথায় স্থায়ী সিসি ব্লক দিয়ে কাজ হবে আর কোথায় জিও ব্যাগ ও জিওটিউবের কাজ হবে। সেই প্রস্তাবটি আমাদের কাছে আসলে আমরা আবার যাচাই বাছাই করে পাশের জন্য বোর্ডে পাঠাবো। আর আপাতত এখন রিপিয়ারিংয়ের কাজ চলছে। পানি কমে গেলে সিসি ব্লক দিয়ে পূননির্মান করা হবে'।
জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, গত দুই বছরে এই জেলায় নদী ভাঙ্গনের কারণে ৮৬০টি পরিবার বসতভিটা হারিয়েছে। ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে টিন, নগদ অর্থ সহায়তা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রসাশকের কাছে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম জানান, রাজবাড়ী জেলায় প্রতি বছরই নদী ভাঙ্গে।এবছর গোদার বাজার এলাকায় তিনটি পয়েন্টে ভাঙ্গনের কারণে নদী শহর রক্ষাবাধের কাছে চলে এসেছে। এই তিনটা পয়েন্টে বিশেষজ্ঞ দ্বারা একটা তদন্ত করে সেখানে যেন উপযুক্ত কার্যক্রম গ্রহন করা হয় তার জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ে একটি চিঠি লিখেছি। ভাঙ্গন রোধে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.