বিশেষ প্রতিবেদক
Published:2022-10-05 18:58:45 BdST
২৬ বছরেও প্লটের দখল নিতে পারেননি ৩২ মালিক, মাঠ বানালেন কাউন্সিলর
রাজধানীর মিরপুর-১১ নম্বর সেক্টরে প্যারিস রোডের সি ব্লকে ‘ঢাকা শহর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের’ আওতায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে বরাদ্দ দেওয়া প্লটের জায়গায় মাঠ বানানোর অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে।
২৬ বছর আগে ৩২ জনের নামে বরাদ্দ করা হয় এই প্লট।বরাদ্দপ্রাপ্তরা জানিয়েছেন, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের বরাদ্দ দেওয়া প্রায় ৭৭ কাঠা আয়তনের নিচু জমিটি বালু দিয়ে ভরাট করিয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম মানিক। তিনি এটিকে মাঠ বানিয়েছেন যার নাম দিয়েছেন ‘শেখ ফজলুল হক মনি খেলার মাঠ।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ১৯৯৬ সালে মিরপুর-১১ নম্বরে প্যারিস রোডের সি ব্লকে তাদের ‘ঢাকা অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের’ (মধ্যবিত্ত কোটা) ৩২টি প্লট বরাদ্দ দিয়েছিল। কিন্তু বরাদ্দদানের আগে্ ৭৭ কাঠা আয়তনের জলাশয়টি ভরাট করে ঘর বানিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীরা বস্তি গড়ে তোলেন।
২০০২ সালে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করতে গেলে তারা পুনর্বাসন চেয়ে আদালতে এক রিট পিটিশন করেন। ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি হাইকোর্ট ডিভিশন রিট পিটিশন মামলাটি খারিজ করে দেন।
২০১৬ সালের ২৬ জুন জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ প্রথম শ্রেণির মেজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে উল্লেখিত প্লটগুলো থেকে বস্তিঘর উচ্ছেদ করে মালিকদের নামে বরাদ্দকৃত প্লটগুলির বাস্তব দখল বুঝিয়ে দেয়। একই বছর ২১ আগস্ট হাইকোর্ট ডিভিশন বরাদ্দপ্রাপ্তদের পক্ষে রায় দেন।
বস্তি উচ্ছেদ করা হলেও স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লা ও কাউন্সিলর জহিরুল ইসলাম মানিকের বাধার মুখে কখনোই বাড়ি করা হয়ে উঠেনি এ মালিকদের।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন মিরপুরের একটি ভাড়া বাসায়। কর্মজীবনে প্রবেশের পর তার স্বপ্ন ছিল ঢাকায় মাথাগোঁজার মতো একটি ঠাঁই করার। স্বপ্ন সত্যি করতে চাকরিতে ঢোকার চার বছর পরে ১৯৯৬ সালে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মিরপুর সেকশন-১১-এর সি ব্লকে পৌনে দুই কাঠার একটি আবাসিক প্লট বরাদ্দ নেন তিনি। বরাদ্দ পাওয়ার পর ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই স্বপ্ন বাস্তবে আর রূপ নেয়নি।
ফরিদুর রহমান বলেন, ‘মরার আগে নিজের বাড়ি চোখে দেখতে পারবো কিনা জানি না। আমার সঙ্গে আরও যারা প্লট বরাদ্দ পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে ৯ জন মারা গেছেন। আমাদের বরাদ্দপত্র, ইজারা দলিল, বাস্তব দখল সবই আছে। কিন্তু ওই এলাকার কাউন্সিলর ও প্রভাবশালী এক নেতার কারণে আমরা বাড়ি বানাতে পারছি না। '
তিনি আরও বলেন, ‘আমি প্লটটি রেজিস্ট্রি, নামজারি করেছি। খাজনা দিয়েছি। এতে আমার প্রায় সাত লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আমি চাই টিনের একটি ছাপড়া করে হলেও থাকতে।’
সম্প্রতি স্থানীয় কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম মানিকের ফেসবুক পেজ থেকে একটি লাইভ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়, যাতে দেখা যায় কয়েকদিন আগেও যেটা নিচু ভুমি ছিল সেটি এখন বালি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। সেখানে শতাধিক ছেলেমেয়ে খেলছে। এ লাইভ থেকে যে ধারা বর্ণনা করা হয় তাতে দাবি করা হয়, এ মাঠ তৈরির পিছনে মূল কারিগর কাজী জহিরুল ইসলাম মানিক।
কাউন্সিলরের ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্লট গ্রহীতা বলেন, ‘গত ২৯ সেপ্টেম্বর কাউন্সিলর মানিক স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে 'মাঠ চাই মাঠ চাই' স্লোগানে অনশনের নাটক করেন। সেখানে তিনি ভুল বুঝিয়ে উত্তর সিটি করপোরেশন মেয়র আতিকুল ইসলামকে দিয়ে এখানে আমাদের প্লটে মাঠ তৈরি ঘোষণা নেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আদালতের নির্দেশেনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সেই দিন থেকে সিটি করপোরেশনের গাড়ি এবং তার টাকা ভাড়া করা গাড়িতে বালু এনে পুরো খালি ও নিচু প্লট ভরাট করে ফেসবুকে লাইভ করেন। এ কাজ সিটি করপোরেশেনের বুলডোজার ও ডাম্প ট্রাক ব্যবহার করা হয়।’
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মিরপুর গৃহ সংস্থান বিভাগ-২-এর এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ' আমরা শুনেছি সিটি কর্পোরেশন আমাদের বরাদ্দকৃত জায়গায় মাঠ বানানোর ঘোষণা দিয়েছেন। তারা আমাদের চিঠি দিয়ে জানায়নি।'
তিনি জানান, সেনপাড়া-পর্বতা মৌজার ২৪৫ দাগের এ জায়গা গৃহায়ন মন্ত্রণালয় ১৯৬০ সালে অধিগ্রহণ করে। ১৯৯৫-৯৬ সালে ৩২ জন ব্যক্তির নামে বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু কাউন্সিলরসহ অন্যান্য দখলদারের বাধায় তারা কেউই বাড়ি করতে পারেননি।
এ বিষয়ে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম ওরফে কালা বলেন, ‘এখানে কখনও মাঠ ছিল না। এটা ছিল নিচু জায়গা। এখানে ছিল বস্তি। আমার ভাইয়েরও এখানে চারটি ঘর ছিল। বস্তিটি আমার নামে কালা মিয়ার বস্তি নামে পরিচিত ছিল। এখানে স্বেচ্ছাসেবক লীগের অফিস তৈরি করেছিলাম। পরে এটা ২০১৬ সালে কোর্টের আদেশে ভেঙে ফেলা হয়।’ তিনি জানান, এই জমি ৩২ জন বরাদ্দপ্রাপ্ত মালিকের।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে কাউন্সিলর জহিরুল ইসলাম মানিক বলেন, ১৯৬৩ সালে ডিআইটির তৎকালীন চেয়ারম্যান জি এ মাদানীর মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী মিরপুরে ১৪টি মাঠ ছিল। এর একটি এই মিরপুর-১১ নম্বর প্যারিস রোড মাঠ। এই মহাপরিকল্পনা ক্ষতবিক্ষত করে পরবর্তী প্রজন্মকে বঞ্চিত করে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ১৯৯৪ সালে কী শর্তে, কেন তাদের বরাদ্দ দিলো এই মাঠে?’
তিনি বলেন, ‘এ প্লটগুলো মূলত সেই সময়ের ক্ষমতাসীন দল বিএনপির গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম মিয়া স্বাধীনতাবিরোধীদের নামে বরাদ্দ দিয়েছিলেন। যারা বরাদ্দ পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই প্লট বিক্রি করে চলে গেছেন। হাউজিংয়ের দুষ্টু অফিসাররা এই জমি বরাদ্দ দিলেও বর্তমান ড্যাপে এটিকে খেলার মাঠ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর আমাদের বর্তমান সংসদ সদস্য মহোদয় বলেছেন, প্লট বরাদ্দপ্রাপ্তদের অন্য জায়গায় বিকল্প বরাদ্দ দেবেন। আমরা সেই শর্তে রাজি হয়েছি।’
তবে প্লটের বরাদ্দপ্রাপ্তরা কেউ বিকল্প জমি পাওয়ার বিষয়ে কিছু জানেন না।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ৩২টি আবাসিক প্লটে অবৈধভাবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য ভুক্তভোগীগন ও মিরপুরের গৃহসংস্থান বিভাগ-২ পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন যার নম্বর ১০০।
মিরপুর গৃহসংস্থান বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী কাওসার মোর্শেদ স্বাক্ষরিত এ জিডিতে বলা হয়েছে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনে প্যারিস রোড সংলগ্ন ৩২টি আবাসিক প্লট বিভিন্ন শ্রেণি/ পেশার লোকদের বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দকৃত প্লটগুলোর বাস্তব দখলে দলিল সম্পাদন করে দেওয়া হয়। ওই ৩২টি প্লটের জায়গায় কে বা কারা মাটি ভরাট করে দখলের পাঁয়তারা করছে। যা সম্পূর্ণরুপে বেআইনি। এমতাবস্থায়, সরকারি সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থে অবৈধভাবে দখলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।
তিনি ছাড়াও ভুক্তভোগীদের পক্ষে একই থানায় এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে জিডি করেন ফাতেমা বেগম। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, গত ১৮ সেপ্টেম্বর তাদের বরাদ্দ পাওয়া স্থাপনা নির্মাণ করতে গেলে স্থানীয় বেশ কিছু লোকজন আমাদের কাজ বন্ধ করে দেয় এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। তাদের বাধার কারণে বরাদ্দপ্রাপ্তরা নির্মাণ কাজ পারছে না।
পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘এ জায়গাটি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ৩২ জন প্লট মালিককে বুঝিয়ে দেয়। তবে জায়গাটি বেদখল হয়ে যায়। স্থানীয় কাউন্সিলর জানিয়েছেন এখানে ময়লা আবর্জনা পড়েছিল। পরে নাকি মেয়র সাহেব আসেন। তিনি নাকি বলছিলেন এখানে ময়লা আবর্জনার মধ্যে ডেঙ্গুর লার্ভা পাওয়া গেছে। মেয়র সাহেব নাকি ময়লা পরিষ্কার করার জন্য কাউন্সিলরকে নির্দেশ দিয়েছেন। উনি সেই ময়লা পরিষ্কার করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানিক সাহেব বলছেন এখানে নাকি মাঠ ছিল, তিনি এখানে খেলেছেন। মেয়র সাহেব নাকি তাকে বলেছেন এখানে মাঠ করার জন্য। এ বিষয়ে আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ থেকে যদি ম্যাজিস্ট্রেট আসে তারা যদি এটার দখল চায় আমরা সাহায্য করবো।’
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান এ বিষয়ে বলেন, ‘যেহেতু এটা প্রায় ৭০ কাঠার প্লট, এখানে একপাশে চার ইউনিটের আটতলা ভবন করে বাকি অংশে খেলার মাঠ করে দিলে সমস্যার সমাধান হতে পারে। এতে এলাকাবাসী খেলার মাঠও পাবে, আবার যারা ২৬ বছর বাড়ি করতে পারছেন না তাদের বঞ্চনাও দূর হবে।’
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.