বিশেষ প্রতিবেদক
Published:2023-05-08 04:05:36 BdST
দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা নিয়ে গোপনে দেশত্যাগগনপূর্তের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন এখন কোথায়?
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বুকে ধারণ করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনকালীন রাষ্ট্রীয় আইন ও চাকরিবধি লংঘন করে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব নিয়েছেন। শত কোটি টাকা পাচার করেছেন তার সেকেন্ড হোম অস্ট্রেলিয়ায়। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে হয়েছেন সম্পদশালী। এই বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা পড়েছে বিস্তর অভিযোগ। দেশের একাধিক পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ। অতঃপর উর্ধতন কর্তৃপক্ষের বিনানুমতিতে দীর্ঘদিন ছুটি কাটিয়ে গোপনে করেছেন দেশত্যাগ।
তিনি দেশব্যাপী সমালোচিত জি কে শামীমের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাজন গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন ওরফে মুন্সি রোকন।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের এই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী একসাথে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন। সেই সাথে নামে-বেনামে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে নিজ দপ্তরেই ব্যবসা করে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন তিনি। আইনকে থোড়াই তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে উপার্জিত কোটি কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাঠিয়েছেন বিদেশে।
বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, রোকন উদ্দিন অবৈধভাবে অর্জিত তার বিশাল সম্পদের অধিকাংশই অস্ট্রেলিয়ায় পাচার করেই ক্ষান্ত হননি, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে দীর্ঘদিন অফিস না করে গোপনে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। বর্তমানে তিনি সেখানেই সপরিবারে বসবাস করছেন। দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সরকারি কর্মকর্তা হয়ে একাধারে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার দুটি পাসপোর্ট প্রায় নয় বছর ধরে ব্যবহার করেছেন প্রকৌশলী রোকন। বিষয়টি প্রথমদিকে সহকর্মীদের মুখে মুখে শুনা গেলেও পরবর্তীতে এই প্রকৌশলীর স্ত্রীই কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর অভিযুক্ত প্রকৌশলীর বিষয়ে তদন্ত শুরু করে কর্তৃপক্ষ কিন্তু কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও সেই তদন্ত এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
প্রকৌশলী রোকন উদ্দিনের স্ত্রী-সন্তান থাকেন অস্টেলিয়ায়। তিনি সেখানে অস্বাভাবিক পরিমাণ অর্থ পাঠিয়েছেন কি না তাও একটি দায়িত্বশীল সংস্থা খোঁজ-খবর নিয়েছিল বলে শোনা যাচ্ছিল।
চাকুরী বিধি অনুসারে একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী একসাথে দুটি পাসপোর্ট ব্যবহার করতে পারবেন না। এমন গুরুতর অভিযোগের সাথে যোগ হয়েছে অর্থ পাচার ও আয় বহির্ভূত অর্জিত সম্পদ।
অধিদপ্তরের একাধিক প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রকৌশলী রোকন উদ্দিনের স্ত্রী ও সন্তান বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন। রোকন তার আয়-রোজগারের একটা বড় অংশ সেখানে জমা করেছেন বলে শোনা যায়। গত কয়েক বছর ধরে তার বর্তমান কর্মস্থল তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীতে (ঢাকা সার্কেল-৩) কর্মরত থাকাকালীন অধীনস্থ একজন নারী সহকর্মীকে ঘিরে নানান সমালোচনার মুখে পড়েন এ প্রকৌশলী। একপর্যায়ে তার স্ত্রী এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের শরণাপন্ন হলেও খুব একটা কাজ হয়নি। সম্প্রতি রোকনের স্ত্রী গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। সেখানে নানা অনিয়মের সঙ্গে রোকন উদ্দিনের দুটি পাসপোর্ট ব্যবহারের বিষয়টিও আছে। বাংলাদেশি পাসপোর্টে এ প্রকৌশলীর নাম মো. রোকন উদ্দিন। পাসপোর্ট নম্বর ‘ওসি৪১৫৭১৪৮’। আর অস্ট্রেলিয়ার পাসপোর্টে তার নাম মুন্সি রোকন উদ্দিন, এর নম্বর ‘এন৮৩৭০২৭৬’।
জিকে শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর যে ৯ জন প্রকৌশলীর বিদেশ যাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা আসে; সেখানে প্রথম সারিতে নাম আসে রোকনের। তার বিরুদ্ধে জিকে শামীমের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। তাকে ঘুষ দিয়ে শামীম গণপূর্তের বড় কাজগুলো বাগিয়ে নিয়েছেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে স্বীকারোক্তি দেন।
সূত্র মতে, জিকে শামীমের বিরুদ্ধে দুদকের দায়েরকৃত মামলায় অন্যান্যদের সাথে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. রোকন উদ্দিন, আব্দুল মোমেন চৌধুরী, নির্বাহী প্রকৌশলী স্বপন চাকমা, মোহাম্মদ শওকত উল্লাহ, মো. ফজলুল হক, আব্দুল কাদের চৌধুরী, আফসার উদ্দিন, মো. ইলিয়াস আহমেদ, ফজলুল হক, গণপূর্ত-৪ সার্কেলের তৎকালীন উপ-সহকারী প্রকৌশলী আলী আকবর সরকারকে দুদক কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দুদক পরিচালক (বিশেষ অনুঃতদন্ত-২) সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের টিম তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে।
এর আগে জিকে শামীম কানেকশনে রোকন উদ্দিনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক। কারণ জিকে শামীমকে সবচেয়ে বেশি টাকার কার্যাদেশ দেন রোকন উদ্দিন। কিন্তু অদৃশ্য ইশারায় জিকে শামীমের মামলায় রোকন উদ্দিনের তেমন কিছুই হয়নি। যদিও তার বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতি, বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্থ পাচারের পৃথক অভিযোগ।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি সার্কেল-৩-এ যোগ দেন। এর আগে তিনি বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন। আগারগাঁও অফিসে যোগদান করেই তিনি তার শ্যালক মো. সাইফুল আলমের নামে লাইসেন্স নেওয়া ‘মমতা ট্রেডার্স’র এবং ছোট ভাই নাজিম উদ্দিন মিটুর নামে লাইসেন্স নেওয়া ‘মুন্সি ট্রেডার্স’কে কার্যাদেশ দেন। এ দুইটি মূলত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রোকন উদ্দিনেরই বেনামি প্রতিষ্ঠান। এখানকার দায়িত্বে এসে শুধু মহাখালী ডিভিশন থেকেই প্রতিষ্ঠান দুইটিকে কয়েকশ’ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেন।
এর মধ্যে শেরেবাংলা নগরে দুইটি প্যাকেজে ১৮ কোটি টাকা, তিনটি প্যাকেজে পাঁচ কোটি টাকা এবং আরো একটি প্যাকেজে আট কোটি টাকার কার্যাদেশ দেন। এখান থেকে তিনি নিজের বেনামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা আয় করে নেন।
এর আগে রোকন উদ্দিন ছিলেন বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী। সেখানেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে একাধিক ঠিকাদার রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে অভিযোগ করা হয়, প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন ঘুষ ছাড়া কাউকে কোনো কার্যাদেশ দেন না। ঘুষ না দিলে টেন্ডার নোটিশ গোপন করে বাগেরহাটের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারদের কার্যাদেশ দেন।
বাগেরহাটের ঠিকাদার আলমগীর কবির প্রকৌশলী রোকন উদ্দিনের দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় তাকে আর কার্যাদেশই দেননি। প্রচন্ড অর্থকষ্টে তিনি মানবেতর জীবন যাপন করেন। ঠিকাদারি পেশায় তিনি এখন পর্যন্ত দাঁড়াতে পারেননি। আলমগীর কবির ভুক্তভোগী আরও ১০ ঠিকাদারের স্বাক্ষর নিয়ে রোকন উদ্দিনের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী গণপূর্ত সার্কেল, খুলনা বরাবর দাখিল করায় তিনি এই রোষানলের শিকার হন।
জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. শামীম আখতার বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রোকন উদ্দিনের স্ত্রীর দেওয়া অভিযোগ আমরা পেয়েছি। অভিযোগটি আমলে নিয়ে তা তদন্তের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে অভিযোগের সত্যতা মিললে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'কোনো প্রকৌশলী নিজে বা তার নিকট আত্মীয় দিয়ে একই সংস্থায় ব্যবসা করলে তা মেনে নেওয়া হবে না। যারা দীর্ঘ সময় একই স্টেশনে থেকে এমন কাজ করছে তাদের সরিয়ে আনা হবে। এমন কাজ কারা কারা করেছে তাও খুঁজে বের করা হচ্ছে।'
প্রকৌশলী রোকন উদ্দিনের বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ছয় মাসের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ না দেখায় হতাশ অধিদপ্তরের অন্যান্য অনেক প্রকৌশলীরা।
কয়েকজন প্রকৌশলী জানান, রোকন বেপরোয়া প্রকৃতির কর্মকর্তা। যেখানে চাকরি করেছেন সেখানেই তিনি নানা বিতর্কে জড়িয়েছেন।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন ওরফে মুন্সি রোকনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, 'অভিযোগে ঘুষ, দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ এবং অর্থ পাচারের উপকরণ থাকলে সেটি দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ। দুদক নিশ্চয়ই সেটি খতিয়ে দেখবে।'
একাধিক অভিযোগ ও দৃশ্যমান অপরাধের পরেও দুর্নীতিবাজ এমন সরকারি কর্মকর্তাদের শাস্তির মুখোমুখি না হওয়ার বিষয়টি নিয়ে মানবাধিকারকর্মী আবু সালেহ আহমদ বলেন, 'রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাগণ পাহাড় সমান অপরাধ করার পরেও শাস্তির মুখোমুখি না হয়ে এমন নির্লজ্জ বহাল তবিয়তে থাকাটা দেশ ও জনগণের দুর্ভাগ্য বটে।'
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.