February 25, 2025, 7:04 pm


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2023-05-10 17:15:25 BdST

সবুজ-মলির অঢেল সম্পদের উৎস কি?


অনেকের কাছেই বিষয়টি অবিশ্বাস্য এবং নিছক গল্প মনে হতে পারে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে- রাজউকে চাকরি মানেই যেন সোনার ডিমপাড়া হাঁস কিংবা আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে পাওয়ার সমান। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নামক সরকারী এই প্রতিষ্ঠানকে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রীতিমতো ‘টাকা তৈরীর কারখানায়’ পরিণত করেছে। এখানে টাকা আয়ের বিষয়ে ‘পদ-পদবী’ কোন বাধাই নয়।

সম্প্রতি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দুই কর্মচারী জাহিদুল ইসলাম সবুজ ও ফাতেমা বেগম মলির বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, কর্মকর্তাদের হুমকি এবং অবৈধ উপায়ে সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ অভিযোগ দেওয়া হয়। তাদের অপকর্মের কথা জানেন রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিয়া। তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন।

অভিযুক্ত জাহিদুল ইসলাম সবুজ রাজউকের এস্টেট ও ভূমি-২ শাখার  অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর। আর ফাতেমা বেগম মলি জোন-৫ এর অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর এবং উচ্চমান সহকারী (অতিরিক্ত দায়িত্ব)।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজউকের সর্বস্তরের কর্মচারীদের পক্ষে মো. হেলাল উদ্দীন সবুজের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয় উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ২৮ অক্টোবর মো. আমিনুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি দুদকে অভিযোগ করেন।

অভিযোগে বলা হয়, রাজউক শ্রমিক কর্মচারী লীগের কার্যকরী সভাপতি জাহিদুল ইসলাম সবুজ কোটি কোটি টাকার মালিক। তিনি কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেন না। নিজের খেয়াল খুশিমতো অফিস করেন। অফিসের কাজ ফেলে অধিকাংশ সময়েই বিভিন্ন ফাইলের দালালীতে ব্যস্ত থাকেন তিনি। তার তদবীরকৃত ফাইলে স্বাক্ষর না করলে কর্মকর্তাদের নানা রকমের হুমকি এবং অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। ক্ষেত্রবিশেষে কর্মকর্তাদেরকে বিভিন্নভাবে নাজেহাল ও শারীরিক নির্যাতন করার অভিযোগও রয়েছে সবুজের বিরুদ্ধে।

অভিযোগে আরও বলা হয়, ১৯৯৮ সালে রাজউকে যোগদানের পর থেকেই অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ উঠে সবুজের বিরুদ্ধে। পাঁচ বছর রাজউকের এস্টেট ও ভূমি-২ শাখায় ঘুষের রাজত্ব কায়েম করেছেন তিনি। গড়েছেন বাড়ি-গাড়িসহ সম্পদের পাহাড়। তিনি বসেন ‘৪২১’ নম্বর কক্ষে। এই কক্ষেই ঘুষের যাবতীয় লেনদেন হয়ে থাকে সবুজের মধ্যস্থতায়।

সবুজের সম্পদের বিবরন

ফাইলের নথি গায়েব থেকে শুরু করে একই প্লট একাধিকজনের কাছে বিক্রি কিংবা প্যাকেজ ঘুষ; সব জায়গায় সবুজের ক্যারিশমাটিক ছোঁয়া আছে। ঘুষের টাকায় রাজধানী মাদারটেক কবরস্থান সংলগ্ন এলাকায় ১০ কাঠা জমিতে বেজমেন্টসহ নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবনে একাধিক শেয়ার কিনেছেন তিনি। গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুরেও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। বগুড়ার শেরপুরেও বাড়ি করেছেন। তিনি একটি গাড়িতে চলাফেরা করেন (নোহা ব্র্যান্ডের মাইক্রোবাস; যার নম্বর ঢাকা মেট্রো- ৫১৮৯৩৭)। এই গাড়ির চালক ও জ্বালানি বাবদ মাসে ৩০/৩৫ হাজার টাকা খরচ আছে। অথচ তার বেতন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। গাজীপুর জেলার ভবানীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে সংলগ্ন ‘রাজেন্দ্র ইকো রিসো অ্যান্ড ভিলেজ’ নামে ৪ তলার অত্যাধুনিক ভবনের শেয়ারহোল্ডার জাহিদুল ইসলাম সবুজ। রাজধানীর অভিজাত হোটেলে তার নিয়মিত যাতায়াত।

অন্যদিকে ফাতেমা বেগম মলির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন মেহেদী হাসান নামের জনৈক ভুক্তভোগী। ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে তিনি এ অভিযোগ দেন।

অভিযোগে বলা হয়, দীর্ঘদিন চাকরি করার সুবাদে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে রাজউকের ঠিকাদারদের জিম্মি করে রেখেছেন মলি। প্রাক্কলন, চুক্তিপত্র, বোর্ড সভার কর্মপত্র, ঠিকাদারদের বিল এবং প্ল্যান পাসের নথিসহ কোনো ফাইলই টাকা ছাড়া ছাড়েন না তিনি। মলির অনিয়ম দুর্নীতির কারণে ঠিকাদার ও গ্রাহক হয়রানি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।

মলির সম্পদের বিবরন 

ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে কয়েক কোটি টাকার মালিক ফাতেমা বেগম মলি। রাজধানীর পূর্বাচলে ১৭নং সেক্টরে ৫ কাঠার একটি প্লট, ২২ নং সেক্টরে ৫ কাঠার একটি এবং ২৭নং সেক্টরে ৫ কাঠার আরও একটি প্লটের মালিক মলি। রাজধানীর ঝিগাতলায় ১৫/এ, ডার্লি পয়েন্টে, হাফিজুল্লাহ গ্রীন টাওয়ারে (লেভেল ই-৫) কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ৩টি ফ্ল্যাট আছে তার।

এছাড়া নারায়ণগঞ্জসহ মলির গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরেও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। দামি নোহা গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো-চ-১৫-৪৬১৮) চড়ে অফিসে আসেন তিনি।

একজন উচ্চমান সহকারী কীভাবে ফ্ল্যাট-গাড়ি-প্লটসহ কোটি কোটি টাকার মালিক হলেন- এ প্রশ্ন রাজউকের অনেকের।

মলি নিজেকে রাজউক শ্রমিক কর্মচারী লীগের ‘মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা’ পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করেন। অথচ কাগজে-কলমে রাজউক শ্রমিক কর্মচারী লীগে ‘মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা’ নামে কোনো পদ নেই। মলির ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়ে দুদকেও একাধিক অভিযোগ রয়েছে এবং তদন্তও চলছে।

এই বিষয়ে রাজউকের একাধিক কর্মচারী বলেন, সবুজ ও মলির অনেক ক্ষমতা। তাদের আছে প্রচুর টাকা। তাদের কেউই কিছু করতে পারে না। এজন্য তাদের যা ইচ্ছে হয়; তারা তাই করে রাজউকে।

অভিযোগের বিষয়ে জাহিদুল ইসলাম সবুজ সাংবাদিকদের বলেন, আমার বিষয়ে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে তা মিথ্যা-বানোয়াট। আমি কাজের বিনিময়ে কোনো ঘুষ কারো কাছে দাবি করি না। একটি চক্র আমার পিছনে লেগেছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে ফাতেমা বেগম মলির মুঠোফোনে কল করা হয়। তবে ফোনকল গ্রহণ করেন একজন পুরুষ। তিনি রং নম্বর বলে ফোনকল কেটে দেন।

সবুজ ও মলির বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিয়া।

তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা এবং সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে অবশ্যই  অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা হবে। 

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.