February 26, 2025, 4:14 pm


জামাল উদ্দিন

Published:
2024-01-29 13:30:48 BdST

পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার ১১ বছর: বিচার শুরু হয়নি আজও


২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট হত্যার শিকার হন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফজলুল করিম খান। রাজধানীর পশ্চিম রামপুরার ওয়াপদা রোডের নিজ বাসায় দিনে-দুপুরে দুর্বৃত্তরা তাকে গুলি করে হত্যা করে।

পরদিন ৩০ আগস্ট তার মেয়ের জামাতা রামপুরা থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হন চার বার। হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পর অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এরপর পার হয়েছে আরও ছয় বছর। তবে বিচার শুরু হয়নি হত্যাকাণ্ডের ১১ বছরেও।

বর্তমানে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ফয়সল আতিক কাদের বিন কাদেরের আদালতে এই হত্যাকাণ্ডের চার্জ (অভিযোগ) গঠনের জন্য অপেক্ষমান রয়েছে।

যেভাবে হত্যা করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফজলুল করিম খানকে

মামলার নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট রাজধানীর পশ্চিম রামপুরার ওয়াপদা রোডের নিজ বাড়ির তৃতীয় তলায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন ফজলুল করিম খান। তার স্ত্রী আফরোজা করিম খান (৪৫) তখন জামাতা ব্যারিস্টার চৌধুরী মকিম উদ্দিন খান জাহান আলীর গুলশানের বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। গাড়িচালক নাস্তা খেয়ে দরজা খোলা রেখে বাড়ির নিচে যান।

সকাল আনুমানিক ৯টা ২০ মিনিটে দিকে মুখোশধারী তিন সন্ত্রাসী বাসায় ঢুকে আফরোজা করিম খানকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। তাকে পাশের রুমে নিয়ে স্বর্ণালংকার লুট করে আটকে রাখে। কাজের ছেলে আজাদকে পাশের আরেকটি বারান্দায় আটকে রাখা হয়। অপর এক সন্ত্রাসী ফজলুল করিমের রুমে ঢুকে কপালে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর সন্ত্রাসীরা ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যায়।  

হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও অভিযোগপত্র

ফজলুল করিম খানকে হত্যার ঘটনায় পরদিন ৩০ আগস্ট তার মেয়ের জামাতা ব্যারিস্টার চৌধুরী মকিম উদ্দিন খান জাহান আলী বাদী হয়ে রামপুরা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। প্রথমে থানা পুলিশ মামলাটির তদন্ত শুরু করে। রামপুরা থানার তখনকার এসআই মো. জামাল হোসেন মামলাটির তদন্ত শুরু করেন। 

কয়েকদিনের মধ্যেই মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি)। পরে গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর শেখ মাহবুবুর রহমান, ইন্সপেক্টর মো. লোকমান হেকিম, ইন্সপেক্টর মো. নুরুন্নবী ও সাব-ইন্সপেক্টর এএনএম নুরুজ্জামান পর্যায়ক্রমে মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

তদন্তের সময় ইমাম হোসেন শাওন, অর্পন আহমেদ জাভেদ, মো. শফিকুল ইসলাম ওরফে জনি, মো. শাহজালাল, মো. হাবেল, কাজী মাসুদ পারভেজ ওরফে চৌদ্দ মাসুদ, মো. আল আমিন ওরফে মোল্লা আমিন, হাসান আবদুল বাকী ওরফে হাসান, আবু বকর সিদ্দিক ওরফে রুবেল ও মো. বেল্লালকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্ত শেষে ২০১৭ সালে ২৭ জুলাই ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর শেখ মাহবুবুর রহমান।

কিন্তু গোয়েন্দা পুলিশের এই অভিযোগপত্রের ওপর নারাজি দেন বাদী ব্যারিস্টার চৌধুরী মকিম উদ্দিন খান জাহান আলী। পরে মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিতে পাঠান আদালত।

মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য আদালত সিআইডিকে দায়িত্ব দিলে সিআইডির তখনকার সহকারী পুলিশ সুপার রতন কৃষ্ণ নাথকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনিও প্রায় এক বছর তদন্ত করেন মামলাটি। তদন্ত শেষে তিনিও ২৫ জনকে অভিযুক্ত করেন।

অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ফজলুল করিম অত্যন্ত স্বাধীনচেতা, সমাজসেবক ও সচেতন নাগরিক ছিলেন। সমাজের যেকোনও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধ অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন। যে কারণে এলাকায় মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেন ফজলুল করিম খান। মাদক প্রতিরোধের চেষ্টা করেন।

হত্যাকাণ্ডের দেড় মাস আগে আসামি শাহরিয়ার আসিফ রাসেলকে কয়েকশ বোতল ফেনসিডিল সহ পুলিশে ধরিয়ে দেন। এতে মাদক ব্যবসায়ী চক্রের সঙ্গে ফজলুল করিমের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

এর জের ধরেই হত্যাকাণ্ডের আগের দিন ২০১৩ সালের ২৮ আগস্ট আসামি এস এম মোয়াজ্জেম হোসেন তপুর রামপুরা মক্কি মসজিদ গলির ভাড়া বাসায় বসে পুলিশ কর্মকর্তা ফজলুল করিমকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী পরদিন আসামি এস এম মোয়াজ্জেম হোসেন তপুর নেতৃত্বে ওয়াসীম আহমেদ ওরফে রতন, শাহরিয়ার আসিফ ওরফে রাসেল, এনামুল হক পনির, মো. সেলিম ওরফে কলা সেলিম, মো. ইমাম হোসেন শাওন, অর্পন আহমেদ জাভেদ, শফিকুল ইসলাম ওরফে জনি, মো. শাহজালাল, মো. হাবেল, কাজী মাসুদ পারভেজ, মো. আল আমীন, হাসান আবদুল বাকী, আবু বকর ছিদ্দিক ওরফে রুবেল, মো হেমায়েত হোসেন হিমু ওরফে হিমেল খান, মো. রুহুল আমিন, শফিকুল ইসলাম বাদশা, মো. দেলোয়ার হোসেন দেলু, মো. মুন্না, হাজী বাবু, মো. বিপ্লব হোসেন, নাসির শেখ ওরফে সীমান্ত, মামুন ওরফে পাঠা মামুন ও সুজন ওরফে মাস্টার সুজন ঘটনাস্থলে যায়। পরে ফজলুল করিমের হত্যাকাণ্ড নিশ্চিত করে।

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, মামলার তদন্ত চলাকালে ১৪ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে আট আসামি ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তাদের জবানবন্দি অনুযায়ী এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ২৮ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট রাজীব অন্য একটি ঘটনায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যায়। আরেক আসামি বেল্লাল ঘটনার সময় অন্য মামলায় কারাগারে ছিল বলে প্রমাণিত হয়। নাবিদের নাম প্রকাশ পেলেও ভাসমান ও ভবঘুরে হওয়ায় তার সঠিক কোনও নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি। ফলে তাদের এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

বাদী, রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা যা বলছেন

চার্জ গঠন কিংবা বিচার শুরু না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আসামি মো. হেমায়েত হোসেন হিমু ওরফে হিমেল খানের আইনজীবী মো. লুৎফর রহমান বলেন, একাধিক আসামি বিভিন্ন সময় অব্যাহতিসহ নানা বিষয়ে আদালতে আবেদন করেন। বাদীপক্ষের তৎপরতা কম থাকায় আসামিরা আদালত থেকে সময় নিয়ে চলে গেছেন। 

চার্জ গঠন না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এই মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আবদুস সাত্তার দুলাল বলেন, মামলায় আসামি বেশি। একেক আসামি একেক বার সময় চেয়ে আবেদন করে। কেউ অন্য মামলায় গ্রেফতার থাকে। বিভিন্ন কারণেই বিলম্ব হচ্ছে। তবে বর্তমানে এ মামলার কোনও আসামি কারাগারে নেই।

১৩ আসামি জামিনে ও ১২জন পলাতক আছে। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি এ মামলার চার্জ বা অভিযোগ গঠনের দিন ধার্য রয়েছে। ওইদিন চার্জ গঠন করে বিচার কার্যক্রম শুরু করা যাবে বলে আশাবাদী তিনি।

মামলার বাদী ব্যারিস্টার চৌধুরী মকিম উদ্দিন খান জাহান আলী বলেন, মামলাটি এখন রাষ্ট্র বাদী হয়ে পরিচালনা করছে। তিনি আশা করেন, এই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.