বিশেষ প্রতিবেদক
Published:2024-08-15 16:47:31 BdST
তীব্র তারল্য সংকট গ্রাহককে টাকা দিতে পারছে না অনেক ব্যাংক
গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগেই ব্যাংক থেকে প্রচুর পরিমাণ টাকা তুলে নিয়েছেন প্রভাবশালীরা। বর্তমানে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ কোটি। এতে ব্যাংক খাতের চলমান তারল্য সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। বর্তমানে অনেক ব্যাংকই তারল্য সংকটে পড়েছে। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারছে না এসব ব্যাংক।
এমন অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক ২ লাখের বেশি নগদ টাকা উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যাতে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকা আর না বাড়ে। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন অনেক গ্রাহক। এটিএম বুথ থেকেও গ্রাহকরা চাহিদা অনুযায়ী টাকা তুলতে পারছেন না। এমনকি মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনও ব্যাহত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর থেকে বিগত সরকারের প্রভাবশালীরা অনেক বেশি পরিমাণে নগদ টাকা উত্তোলন করেছেন। এতে অনেক ব্যাংকে যেমন তারল্য সংকট চলছে, তেমনি বাংলাদেশ ব্যাংকেও একই সংকট দেখা দিয়েছে। এত টাকা বাইরে চলে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ যেমন কঠিন হবে, ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করাও সহজ হবে না।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, নতুন করে টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে দিতে হবে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। অনেকে আবার এক হাজার টাকার নোট বাতিলেরও পরামর্শ দিচ্ছেন। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে প্রত্যাশা করছেন ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া ব্যাংক একীভূতকরণসহ চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, একসঙ্গে অনেক আমানতকারী ব্যাংক থেকে তাদের আমানত তুলে নিচ্ছেন। ফলে চাহিদা অনুযায়ী অনেক ব্যাংকই গ্রাহকের টাকা দিতে পারছে না। এতে একদিকে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকটের তীব্রতা প্রকাশ পাচ্ছে, অন্যদিকে ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থাহীনতা আরও বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক একীভূতকরণসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশকিছু ভুল নীতির কারণেই ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট চরম আকার ধারণ করেছে।
তাদের মতে, মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণে মানুষের বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে। আবার সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নগদ টাকায় ডলার কেনায় টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে আটকে গেছে। সরকার বাজার থেকে বিল অকশনের (নিলাম) মাধ্যমে টাকা তুলে নিচ্ছে। এ ছাড়া বিতরণ করা ঋণ আদায় না হওয়া ও খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। ফলে গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ব্যাংক হিমশিম খাচ্ছে।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির অংশ হিসেবে বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়ার কারণেই এই তারল্য সংকট। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের চিহ্নিত দুর্বল ব্যাংকগুলো থেকেই টাকা তোলার হিড়িক লেগেছে। কারণ এসব ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা কমে যাচ্ছে। এই আস্থাহীনতার কারণে দুর্বল ব্যাংকের পাশাপাশি ভালো ব্যাংকগুলো থেকেও টাকা তোলার চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে, ব্যাংকে নতুন আমানত আসছে না। উল্টো ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ বাড়ছে। এতে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিদিনই এসব ব্যাংককে তারল্য সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। গতকালও এসব ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী ১ হাজার ৭৪ কোটি টাকা ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, কিছু ব্যাংকে তারল্য সংকট চলছে, এটা সত্যি। তবে সব ব্যাংকে না। ব্র্যাক ব্যাংকে কোনো সংকট নেই। গ্রাহকের ভোগান্তির বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর এই বিষয়ে ভালো একটি সিদ্ধান্ত দেবেন।
একই বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনা করে হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংক এমন নির্দেশনা দিয়েছে। আশা করছি আগামী সপ্তাহে এই নির্দেশনা প্রত্যাহার করা হবে। তবে কিছু ব্যাংকে আগে থেকেই তারল্য সংকট চলছিল। সে বিষয়ে নিশ্চয়ই নতুন গভর্নর ইতিবাচক এবং কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত দেবেন।
এদিকে, দায়িত্ব নিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেছেন, ২ লাখ টাকার বেশি নগদ উত্তোলনের নিষেধাজ্ঞা হয়তো সাময়িক, এটা শিগগির উঠে যাবে। ব্যাংকের বাইরে অনেক বেশি টাকা চলে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, দেশের টাকা যারা পাচার করছে, তাদের শান্তিতে ঘুমাতে দেওয়া হবে না। তাদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করার চেষ্টা করা হবে।
অন্যদিকে, নগদ টাকা উত্তোলনে সীমা আরোপ করায় ব্যাহত হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনও। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট ইয়াসিন আলী বলেন, আমরা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারছি না। কারণ আমাদেরকে ২ লাখ টাকার বেশি দেওয়া হচ্ছে না।
একইভাবে এটিএম বুথ থেকেও গ্রাহক তার প্রয়োজন অনুযায়ী টাকা তুলতে পারছেন না। সারাদেশের এটিএম বুথগুলোতে দৈনিক ৭০০ কোটি টাকার চাহিদা থাকলেও বুথগুলোতে ৪০০ কোটি টাকার বেশি দেওয়া হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
গতকাল উত্তরা ব্যাংকের একজন গ্রাহক বলেন, আমার বাবা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। তাই হাসপাতালের বিল পরিশোধের জন্য ৩ লাখ টাকার চেক দিলেও ব্যাংক থেকে আমাকে ৫০ হাজারের বেশি টাকা দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এতে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার টাকা আমি তুলব, তাও ব্যাংক দিতে পারছে না। খুবই দুঃখজনক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাস শেষে ব্যাংকখাতের মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪২ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। জানুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
অন্যদিকে, জুন মাসে কারেন্সি আউট সাইড ব্যাংক বা মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯০ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। যা আগের মে মাসের তুলনায় ১৯ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.