শাহীন আবদুল বারী
Published:2024-10-02 13:13:12 BdST
রাষ্ট্রে হাসিনা সরকারের বিস্তার ছিলো এককবাড়ছে ইসলামী দলগুলোর সমর্থকের সংখ্যা
রাষ্ট্রের সকল স্তরে প্রতিটি সেক্টরে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার বিস্তার করে ছিল একক আধিপত্য। সরকারের প্রভাবশালী নেতা, আমলা ,ব্যবসায়ীরা একের পর এক প্রতিটি সেক্টর দখল নিয়ে দুর্নীতিতে রের্কড ভেঙ্গেছে। পতিত সরকার আর তাদের পার্টনারশিপ আমলা এবং ব্যবসায়ীরা দেশকে দেউলিয়া করে, নিজেরা অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। সীমাহীন দুর্নীতি যেমন- শেয়ার বাজার লুট, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা চুরি, হলমার্ক গ্রুপ কেলেঙ্কারী, বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বিসমিল্লাহ গ্রুপ এবং সকল ব্যাংক গুলো লুটপাট করেছে পতিত সরকারের পেটুয়া বাহিনী। এদের বিরূদ্ধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহন না করায় জনমনে ভিষন ক্ষোভ জন্ম নেয়। দ্রব্যমূল্য'র উর্দ্ধগতি জনজীবনে নাভিঃশ্বাস হয়ে উঠেছে। মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে মেগা দুর্নীতি হতবিহবল করেছে পুরো জাতীকে। তখনও সরকার দেশের মানুষের প্রতিক্রিয়া গ্রহন করেনি। ভোটার বিহীন নির্বাচন, গণতন্ত্রহীনতা এবং আলেম ওলামাদের হয়রানী, হেনস্তা করা আওয়ামী লীগের বড় ভুল ছিল। এমপি, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, আমলা সিন্ডিকেট মিলে দিনের পর দিন উন্নয়ন গনতন্ত্রের নামে দেশটাকে লুটেপুটে খেয়ে দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনের বারোটা বাজিয়েছে। পতিত সরকার নিজেদের খেয়াল জারি রেখে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। পক্ষান্তরে, সাধারন জনগন শোষিত হতে হতে ডাল-ভাত খেয়ে বাড়ি-ভাড়া দিয়ে কোনমতে দিনাতিপাত করছেন। একে একে সমাজের মানুষের মনে শেখ হাসিনা সরকারের দুঃশাসনের বিপক্ষে তীব্র ক্ষোভ দানা বাঁধে। ফলে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভুত জনক্ষোভ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সর্বস্তরের জনতা পাশে এসে শরিক হয়ে হাসিনা সরকার হঠাতে প্রকট আকার ধারন করে। কোঠা সংস্কার আন্দোলন ৯ দফা থেকে রূপ নেয় এক দফায়। দুঃশাসন, লুটপাট ও দুর্নীতি-অনিয়ম, অহংকার দাম্ভিকতার পরিণতিতে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুথানে শেখ হাসিনার পতন হয়। ফলে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন তিনি।
শেখ হাসিনা সরকারের জনমত উপেক্ষা করে ভারত নির্ভর নতজানু পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ, বির্তকীয় শিক্ষা, কারিকুলাম, বিএনপি চেয়ার পার্সন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কে ঠুনকো মামলায় জেলে রাখা এবং বিদেশে চিকিৎসা করতে যেতে না দেয়া, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বর্ষীয়ান নেতাদের ফাঁসী, যাবৎ জীবন সাঁজা এবং হামলা মামলা দিয়ে হয়রানী, নোবেল বিজয়ী বিশ্ব বরেন্য ব্যক্তিত্ব ড. ইউনুসকে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জেলাসনেস থেকে হয়রানী মূলক মামলায় বার বার আদালতে নেয়া, সাজা দেয়া, এসব বিষয়ে দেশব্যাপী শেখ হাসিনার প্রতি বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন সর্বস্তরের জনগণ। ফলে জনমত পরোটাই চলে যায় হাসিনার বিপক্ষে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থার সংস্কার এখন দেশবাসীর মনের দাবী। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ মনে করেন, রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা এমন ভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে এই দেশে আর কোনদিন স্বৈরশাসকের জন্ম না হতে পারে। সকলের আন্তরিক প্রয়াস-প্রচেষ্টায় ঘুষ, দুর্নীতি-অনিয়ম, অপশাসন ও বৈষম্যহীন সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় দেশবাসী ড. ইউনুস এর নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তী সরকারের পাশে আছেন। গ্রাম-শহর, দেশ-বিদেশ, (প্রবাসি) অফিস-আদালত, হাঁট-বাজার, মার্কেট, শপিং মল, চায়ের দোকান সর্বোত্র তাই শোনা যায়। এদিকে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী গত ৫ আগষ্টের পর থেকে পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে সমীকরণ করছে। এখন আওয়ামীলীগ বিহীন মাঠে সামনের দিন গুলোতে চলছে নতুন হিসেব নিকেশ। জনগনের একটি অংশ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে প্রায় একই রকম মনে করেন। দেশের বিশাল একটি অংশ বর্তমান ডঃ ইউনুস এর নেৃতাত্বাধীন সরকারকে ৩ থেকে ৫ বছরের জন্য ক্ষমতায় দেখতে চায়। আবার বড় একটি অংশ মনে করেন, জামায়াতে ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম, চরমোনাই পীর সাহেব সহ সকল ইসলামী দল সমূহ ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনী জোট গঠন করলে এবং ছাত্রদেরকে এই জোটের সাথে ঐক্য গঠন করাতে পারলে ইসলামী দল সমূহের নির্বাচন ফলাফল ইতিবাচক হওয়ার সম্ভবনা আছে। বিএনপি একটি বৃহত্তর দল। দলটি ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা খুব বেশি। তবে চরমোনাই একটি গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের বিগত দিনের কর্মকান্ড নিয়ে সাধারন মানুষের মধ্যে নানা ধরনের সংশয় রয়েছে। চরমোনাই পীর সাহেব আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে অনেক সময় বিরোধী মত দমনে সচেষ্ট ছিলেন বলে চাউড় আছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন করে উজ্জীবিত ইসলামী দলগুলো। বৃহত্তর ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছেন । জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন , বেশ কয়েকটি দল ও ইসলামী চিন্তাবিদদের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা করেছেন তারা। কয়েকজন নেতা ইঙ্গিত দিয়েছেন, একক প্রতীকে নির্বাচনে যাওয়ার কৌশল নিয়েও ভাবনা আছে দলগুলোর। নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তার দূরত্ব ঘোঁচাতে চায় আলেম সমাজ । নতুন রাজনৈতিক কৌশল নিতে চায় ইসলামী দলগুলো। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পাল্টে গেছে দেশের রাজনীতির হিসাব-নিকাশ। আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় বিএনপি ও তার এক সময়ের মিত্র দলগুলোর মধ্যে চলছে নানা সমীকরণ। এরই মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলামসহ অন্যান্য ইসলামী দল রাজনীতির মাঠে এখন বেশ সরব। ইসলামী চিন্তাবিদরা বলছেন, ফ্যাসিবাদের পতন হওয়ার পর তাদের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে মানুষের। মুক্ত পরিবেশ পাওয়ায় বাড়ছে তাদের সমর্থকের সংখ্যা। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, কল্যাণরাষ্ট্র গঠনে ইসলামী দলগুলো যে ভূমিকা রাখতে পারবে এ জায়গায় জনগণ আগের চেয়ে হাজারগুণ বেশি আশাবাদী। ফলে তারাও আশাবাদী জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, এরই মধ্যে আমরা ইসলামী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছি। অনেক দল সম্মত হয়েছেন। দেশের মানুষও চাইছেন একবার অন্তত: ইসলামী দলগুলো দেশ শাসন করুক। মানুষ তখন পার্থক্য করতে পারবে ইসলামী শাসনতন্ত্র কল্যাণমুখী নাকি ফ্যাসিবাদী।
ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পক্ষে সম্মতি জানিয়ে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক বলেন, হেফাজত, জামায়াত এবং ইসলামী আন্দোলন এই তিন শক্তি এক সঙ্গে হওয়ার একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, ভালো ফল আসবে।
একই মত পোষণ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি বলেন, তারা এখন পর্যন্ত ৭টি ইসলামি দল এবং কোন দলের সাথে নেই কিন্তু ইসলামী চিন্তাবিদ, জাতির কাছে তাদের মর্যাদা আছে এমন বেশ কয়েকজনের সাথে আলাদা আলাদা কথা বলেছেন। ভোটের মাঠে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের বাইরে অন্যদের তেমন প্রভাব না থাকলেও নেতাদের দাবি, জোট হলে নতুন রেকর্ড দেখবে বাংলাদেশ। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, যদি সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে পারি এবং মানুষের আশা-আঙক্ষাকে কাজে লাগতে পারি, তাহলে আগামী নির্বাচনে একটা বড় ভোট ব্যাংক তারা দেখাতে পারবেন এবং সরকার গঠন করতে পারবেন ইনশাআল্লাহ। প্রসঙ্গতঃ নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী দেশে নিবন্ধিত ইসলামী দলের সংখ্যা ১১টি।
জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও পর্যলোচনা নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ বলছেন, দেশে গত দুই দশকে একশ্রেণির জ্ঞানপাপী সৃষ্টি হয়েছে, যারা ব্যক্তিস্বার্থে সত্যকে মিথ্যা বানিয়ে বা মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে বয়ান তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত। তাদের ঘটনার পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাখ্যা আমাদের বিভ্রান্ত করেছে। তবে, ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব ঘটনা হিসেবে ২০২৪-এর ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন এক নির্মোহ আলোচনার দাবি রাখে। আপাত:দৃষ্টিতে, এই আন্দোলন সময়ের ব্যাপ্তিতে সংক্ষিপ্ত হলেও এর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সুদূরপ্রসারী ও বৈচিত্র্যময়। খেটে খাওয়া মানুষের ভাষ্যমতে,বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্নীতি আর দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ। দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে এ দেশের নষ্ট রাজনীতি। এ দেশের মানুষ কোনও সরকারের কাছ থেকে খুব বেশি সামাজিক বা অর্থনৈতিক সুরক্ষা আশা করে না। অথচ রাজনৈতিক সরকারেরা শুধু একশ্রেণির মানুষকে সুরক্ষা দিতে চায়। যারা রাজনীতির জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়। এমনটাই দেখা গেছে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে। রাজনীতির বিশেষ মহলগুলোর কারনে বিশেষ মানুষদের ভাগ্য বদলেছে, দেশের মানুষের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে।
২০২৪-এর ছাত্র আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী প্রতিবাদ হিসেবেই ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। এই আন্দোলনের শৌর্য্য যদিও প্রকাশ পেয়েছে রাজপথে, কিন্তু এই আন্দোলনের চেতনা দেশের আপামর মানুষ ধারণ করেছে বহুদিন ধরে তার অস্থিমজ্জায় যদিও তা পূর্বে কোনও সংগঠিত রূপ প্রকাশ পায়নি। রাজনৈতিক দলের নেতাদের অনুধাবন করতে হবে জুলাই-আগষ্ট রাষ্ট্রশক্তির সামনে ছাত্র-জনতা ছিল অকুতোভয়। আন্দোলন ছিল সরকারের একচেটিয়া অন্যায় আর জুলুমের বিরুদ্ধে। বৈষম্যবিরোধী দাবির পক্ষে ছাত্রদের যে প্রতিবাদ ছিল মূলত: ‘টিপ অব আইসবার্গ’। বিগত দুই দশকে সাধারণ মানুষ বুঝে গিয়েছিল এ দেশের রাজনৈতিক সরকারেরা তাদের ঠকায়। এরা মূলত: একটা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধার করতে সরকারে যেতেন বা মরিয়া হয়ে থাকতেন। এরা সরকারি প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে রাষ্ট্রের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে শুধু নিজেরা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক সরকারগুলোর ওপর মানুষের বিশ্বাস একেবারে উঠে গেছে। তারা জনগণের ম্যান্ডেটকে থোড়ায় কেয়ার করে। কোন ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ভোটের নামে পুলিশ আর সরকারি লোক দিয়ে ভোটারবিহীন নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ভরে যায়। দুর্নীতির মাধ্যমে দেশকে দেউলিয়া করে দিতেও রাষ্ট্রের কর্তাদের বুক কাঁপে না। পুঁজিবাদী, সুবিধাভোগী যে দলই হোক তাদেরকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায়না দেশের মানুষ। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ভোগ করতে চায় সর্বস্তরের জনগণ। এজন্যই ইসলামী দল গুলো বিশ্বাস ও আস্থাশীল হয়ে উঠছে মানুষের কাছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন দানা বাঁধার অন্যতম কারণ হচ্ছে, সরকারের প্রভাবশালী নেতা, আমলা, ব্যবসায়ীরা দুর্নীতিতে একের পর এক রেকর্ড গড়ছিল। দেশের মানুষ দিন চালানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি যখন হারাচ্ছিল, তখন তারা অবাক হয়ে দেখল সরকার আর সরকারের পার্টনারশিপে আমলা ও ব্যবসায়ীরা কীভাবে দেশকে দেউলিয়া করে, নিজেদেরকে অর্থেবিত্তে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। শেয়ার বাজার লুট, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা চুরি, লক্ষ কোটি টাকা প্রতিবছর পাচার সহ মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে মেগা দুর্নীতি মানুষকে একদিকে যেমন হতবিহ্বল করেছিল অন্যদিকে তখনও সরকার এ দেশের মানুষের প্রতিক্রিয়া গ্রহণ না করে, নিজেদের খেয়াল জারি রেখে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। তাই নির্দলীয় আন্দোলন হিসেবে ছাত্র-জনতার এই বিপ্লবী অভ্যুত্থানকে সব মানুষ গ্রহণ করেছিল। নিজেদের আন্দোলন হিসেবে সাধারণ জনগণ মেনে নিয়েছিল। তাই আর কোনও দানবীয় শক্তি এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। জনঐক্য ও সমর্থন চূড়ান্ত সাফল্যের সহায়ক হয়। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারত পালানোর দিন আলোচনায় আসেন জামায়াতে ইসলামীর আমির। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জামায়াতের ইসলামীর আমিরের কথা বলতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনায় আসে দলটি। এরপর অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন থেকে শুরু করে রাষ্ট্র সংস্কারে সকল কাজে সামনের সারিতে দেখা যাচ্ছে দলটিকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শহীদ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অর্থ সহযোগিতা এবং সর্বশেষ ভারতের পানি আগ্রাসনের পর বানভাসী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে জামায়াত আমিরের বক্তব্য এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় উপহার সামগ্রী পৌঁছিয়ে দিয়ে জয় করে নিয়েছেন নেটিজেনদের। ঐ দিন বিকালে ফরায়েজি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয় জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে। একদিকে দল গোছানো, অন্যদিকে জনসম্পৃক্ততার কাজে সময় ব্যয় করছে দলটি। ইসলামী দলগুলোকে একত্রিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন দলটির আমীর ডা. শফিকুর রহমান সহ নেতারা। চেষ্টা করছেন একটি বৃহত্তর ইসলামীক ঐক্য গড়ে তোলার।
জামায়াতে ইসলামী পশ্চিমা বিশ্বে নিজেদের পরিচিত করতে সক্ষম হয়েছে একটি উদারপন্থি ইসলামীক দল হিসেবে। একই সঙ্গে ভারতের দৃষ্টিতেও নিজেদের পজেটিভ ইমেজ তৈরি করেছে দলটি। বিভিন্ন সময় মন্দির এবং হিন্দুদের বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়ে জামায়াতের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করলেও জামায়াত প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে এটি আওয়ামী লীগের ইন্ধনে হয়েছে। যখন জামায়াতকে জড়িয়ে ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করে ঠিক সে সময় জামায়াতের নেতাকর্মীদের দেখা গেছে মন্দির এবং সনাতন ধর্মীয়দের বাড়ি ও মন্দির পাহারা দিতে। এ সব কিছুই দৃষ্টি কেড়েছে অন্যান্য ইসলামিক দলগুলোর। গত ২০ আগস্টের মতবিনিময়ে অংশগ্রহণ করেন মাওলানা মুফতি মহিউদ্দীন কাসেমী, মুফতি খুরশিদ আলম কাসেমী, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মুফতি রেজাউল করীম আবরার, মাওলানা আব্দুল মজিদ আতহাবী, মুফতি আজহারুল ইসলাম, মুফতি ফখরুল ইসলাম, মুফতি রাদেশ বিন নূর, মাওলানা মুনির হোসাইন কাসেমী, মাওলানা আবু জাফর কাসেমী, মাওলানা মুফতি আবুল কালাম, মাওলানা শাহ আরিফ বিল্লাহ সিদ্দিকী, মাওলানা আব্দুল মোমেন নাসেরী, মাওলানা আবুল কাশেম কাসেমী, ইসলামি বক্তা মাওলানা আলী হাসান উসামা প্রমুখ। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, এখন থেকে আমরা সবাই একে অপরের জন্য। সবাই সিসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ থাকব, ইনশাআল্লাহ। অতীতের কোনো আচরণের জন্য আপনারা যদি সামান্য কষ্ট পেয়ে থাকেন, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই। আশা করি, আপনারা আমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। তার এমন উদারতা মন জয় করে নেয় সভায় থাকা অতিথিদের।
বাংলাদেশে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইসলামী দল এবং সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। আর তাতে নেতৃত্বের আসনে থাকতে চায় জামায়াতে ইসলামী। আর এই উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন দল এবং সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন বলে কয়েকজন জামায়াত নেতা জানান। হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, আমরা মনে করি বাংলাদেশের মানুষ চাইলে এখানে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম হবে। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। বৈঠকে আমাদের ইসলামি দল ও সংগঠনগনগুলোর ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার ব্যাপারে কথা হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ইসলামী রাষ্ট্র চায়। এখানে ইসলামী বিপ্লব হবে। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করতে চাই। এজন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, জামায়াতের আমির জেলে ছিলেন। আমরাও জেলে ছিলাম। তিনি আমাদের চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন। সেখানেই আমরা যার যার কথা বলেছি। এটা নিয়ে আরো আলোচনা হবে। খেলাফত মজলিসের নেতা মুনতাসীর আলী জানান, আমরা মনে করি ইসলামি দলগুলোর, শক্তিগুলোর সবাই সবার কাছাকাছি থাকা দরকার। এখন আলাপ আলোচনা হচ্ছে। তারপরে আমরা রাজনৈতিক ঐক্যের দিকে যাবো। তবে নেতৃত্ব কেমন হবে; কারা দেবে সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে।
ইসলামী বক্তা আলী হাসান ওসামা বলেন, জামায়াতের আমন্ত্রণে আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। সেখানে নানা জন নানা মত দিয়েছেন। কেউ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন জামায়াতের নেতৃত্বেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। মূল যে কথা হয়েছে তা হলো আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের ওপর দমন পীড়ন নেমে এলে আমরা যেন এক সাথে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারি। আরো যারা ইসলামী দল রয়েছে তারাও মনে করেন, ইসলামী দলগুলোর ঐক্য প্রয়োজন। এরইমধ্যে ঐক্যের ডাক দেয়া হয়েছে। আগামী নির্বাচনে ইসলামী দলগুলো একজোট হয়ে নির্বাচন করতে পারে কি না সেই চিন্তাও আছে। এজন্য বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দলের মধ্যে যোগাযোগ হচ্ছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ইসলামী দলগুলো তো বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এদেশের মানুষের মনোভাবও তাই। এখন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে সেই লক্ষ্যে ইসলামী দলগুলোর এক সঙ্গে কাজ করা। এটা নিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে কথা হচ্ছে। আশা করছি নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করব। প্রথমত: এটাই হবে নির্বাচনের জন্য বৃহত্তর ইসলামী জোট হতে । বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জামায়াত কি তবে বিএনপি’র জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে? বাংলাদেশে রাজনীতিতে গত ৫ আগস্টের পর থেকে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ-বিহীন মাঠে সামনের দিনগুলোতে নতুন হিসেব-নিকেশ আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান দুটো শক্তি বিএনপি এবং তাদের এক সময়কার রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামী। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোন রাজনৈতিক দল না হলেও রাজনীতির মাঠে তাদের প্রভাব অন্যদের চেয়ে কম নয়। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তী সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফসল এবং তাদের পছন্দ। তবে সম্বয়কদের অনুসারী ছাত্ররা বিভিন্ন স্কুল/কলেজের শিক্ষকদের বিতাড়িত করতে গিয়ে কিছুটা সমালোচনার মুখে পড়েছে। তাছাড়া ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়েও অনেক জায়গায় ফাটল বা চির ধরেছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইতোমধ্যে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তা দৃশ্যত: মনে হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অনেক চিন্তাধারার সাথে তারা একমত হতে পারছেন না।
প্রথম বিষয়টি হচ্ছে নির্বাচন। বিএনপি মনে করে ‘অতিদ্রুত’ কিংবা ‘যৌক্তিক সময়ের’ নির্বাচন । অন্যদিকে নির্বাচন নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর কোন তাড়াহুড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। জামায়াত বার বার সংস্কার এর দিকে জোর দিচ্ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অধিকাংশই জামায়াতের সঙ্গে উঠাবসা করছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদের দিক থেকে কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করা হয় কি না সেদিকেও দৃষ্টি রাখছে বিএনপি। এ বিষয়টিও নির্বাচনের সাথে সম্পৃক্ত। যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা বলছেন, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কোনো চিন্তা এখনি নেই তাদের। গত ১৬ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি ইঙ্গিত করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অন্তবর্তী সরকার যাঁদের দায়িত্ব দিয়েছে, তাঁদের মধ্য থেকে বলা হচ্ছে, নতুন দল তৈরি করতে হবে। নতুন দল তৈরি করার কথা বললে জনগণ কীভাবে বুঝবে তাঁরা নিরপেক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শত্রু-মিত্রের চর্চা নতুন কোন বিষয় নয়। দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাজনীতির মাঠে একটা সময় যারা পরস্পরের মিত্র হিসেবে পরিচিত ছিল পরবর্তীতে তারাই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের সাতই নভেম্বর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান বন্দি দশা থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। এরপর তার ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত হয়েছিল। সে অভ্যুত্থানের রূপকার ছিল জাসদ নেতা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবু তাহের ও জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। তখন জাসদ ছিল আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তি। কিন্তু রাজনীতির পথ পরিক্রমায় জাসদ আওয়ামী লীগের মিত্র হয়েছে এবং বিএনপির শত্রু হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আগামী দিনগুলোতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জামায়াতে ইসলামী কি বিএনপি’র জন্য বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে? মোটেই না। এখানে ছাত্র-জনতার যে বিপ্লব হয়েছে তার যে অন্তর্নিহিত স্পিরিট, সেটা যদি আমরা উপলব্ধি করি তাহলে এখানে কিন্তু কোন দ্বন্দ্ব বা মতবিরোধের সুযোগ আমি দেখছি না। বলছিলেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান। মঈন খান বলেন, এই আন্দোলনে ছাত্র-জনতা মিশে গিয়েছিল। তারা বলেছে, সাধারণ ছাত্র হিসেবে আন্দোলন করেছে। কিন্তু সাধারণ ছাত্র বলতে তো কিছু নেই। ছাত্র যারা রয়েছে তাদের কোনও মতামত থাকতে পারে। কাজেই এটাও কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই।
নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে মতভেদ দেখা যাচ্ছে। বিএনপি নির্বাচনের জন্য একটি রোডম্যাপ চায়, অন্যদিকে জামায়াত সেটি নিয়ে কিছু বলছে না। বিএনপি দাবি করছে, নির্বাচন নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সাথে মতভেদ নিয়ে তাদের কোন অস্বস্তি নেই। বিষয়টিকে তারা 'ভিন্নমত' হিসেবে বিবেচনা করছে। জামায়াত কেন বিলম্ব করতে চায়? জামায়াত বিলম্ব করতে চায় কারণ তারা জানে যে এই মূহূর্তে নির্বাচন হলে তারা যথেষ্ট ভোট পাবে না। এটাও তো হতে পারে বলেন মঈন খান। তবে নির্বাচন দেরিতে হলেই যে জামায়াতে ইসলামী ভোটের রাজনীতিতে বিএনপি’র বড় প্রতিপক্ষ হবে সেটি মানছেন না বিএনপি নেতারা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলছে, এই মুহূর্তে রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে তাদের কোন চিন্তাভাবনা নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি 'প্রেশার-গ্রুপ হিসেবে' কাজ করছে বলে তারা মনে করেন। আমরা চাচ্ছি গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে যে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটা ধরে রাখা। সেই সাথে রাষ্ট্রের ন্যূনতম সংস্কার এবং নতুন রাষ্ট্র গঠনে অন্তবর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করা। বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আরিফ সোহেল।
ইতোমধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক সমন্বয়ক ঢাকার বাইরে সমাবেশ করতে গিয়ে বাঁধার মুখে পড়েন। তাদের অভিযোগ ছিল বিএনপি সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল এসব ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। যদিও ছাত্রদল সেটি অস্বীকার করেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম না হলেও বর্তমান বাংলাদেশে রাজনীতির অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তাদের চাহিদা মতো। সে দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকে মনে করেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিএনপি এবং বিএনপির দিক থেকেও বড় চ্যালেঞ্জ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে এটিকে 'যৌক্তিক চিন্তা' মনে করছেন না ছাত্ররা। কিছু ক্ষেত্রে যদি বিএনপির নেতা-কর্মীরা মনে করে থাকেন যে ছাত্ররা তাদের প্রতিপক্ষ বা ছাত্ররা কেউ কেউ যদি মনে করে থাকেন যে বিএনপি দলগতভাবে তাদের প্রতিপক্ষ, তাহলে আমি বলবো যে এটি একটি ভুল চিন্তা। বলেছেন আরিফ সোহেল।
বিএনপি বলছে, যেকোনো রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগকে বিএনপি স্বাগত জানায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যদি কোন রাজনৈতিক দল গঠন করতে চায় সেক্ষেত্রে বিএনপি 'মোটেও চিন্তিত' নয়। ছাত্ররা যদি দল করে সেটা তো তাদের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার বিশ্বের সব সংবিধানেই দেয়া আছে, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান এমনটিই বলেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচন ঘিরেও রাজনীতির শত্রু-মিত্র নির্ধারিত হয়েছে অতীতে। ১৯৯০‘'র দশকে জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আন্দোলন করলেও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির সাথে হাত মেলাতে দ্বিধা করেনি। অন্যদিকে ১৯৯৬ সালে জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও পরবর্তীতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক মিত্র হয়েছে।
মঈন খান আরো বলেন , দল করার অর্থ এই নয় যে তারা সরকার পরিচালনা করবে। দল করার পরে তাদেরকে জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণের কাছে যাবার গণতান্ত্রিক পদ্ধতি একটি। সেটি হচ্ছে, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্তরা বলছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা কোন রাজনৈতিক দল গঠন না করছেন কিংবা নির্বাচনে অংশ না নিচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্য কোন রাজনৈতিক দলের সাথে প্রতিযোগিতা কিংবা প্রতিন্দ্বন্দ্বিতার প্রশ্ন উঠবে না। একমাত্র নির্বাচনকে কেন্ত্র করেই এসব প্রশ্ন উঠতে পারে। ভবিষ্যতে তো অবশ্যই একটি নির্বাচন হবে রাজনৈতিক সরকার গঠনের জন্য। সে নির্বাচনের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীরা বা অন্য যারা আছেন তারা যদি রাজনৈতিক দল তৈরি করতে চান সেক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে বা কিছু আগে সে চিন্তাভাবনা শুরু হতে পারে, বলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আরিফ সোহেল।
তিনি আরও বলেন, এই সম্ভাবনা তখনই তৈরি হবে যদি আমরা নির্বাচনি রাজনীতির মাঠে নামি। রাজনীতির মাঠে প্রতিযোগিতা নির্ভর করবে ভোট নিয়ে। যে জনগোষ্ঠীর ভোট বিএনপি চাচ্ছে, আমিও যদি তাদের ভোট চাই তাহলে সেক্ষেত্রে কার মতাদর্শ কার চিন্তাভাবনা বা পলিসি জনগণ গ্রহণ করছে সেটি নিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি বা পাল্টা কর্মসূচি আমরা দেখতে পাব।
বিএনপি নেতারাও বলছেন নির্বাচনি মাঠে অন্যরা তাদের প্রবল প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারবে বলে তারা আপাতত মনে করছেন না। । জনগণ যাকে ভোট দেবে সে সরকার গঠন করবে। এখানে তো জোর করার কিছু নেই। এখানে দ্বন্দ্বের কোন অবকাশ নেই। মানুষ যাকে ভোট দেবে তারাই সরকার গঠন করবে, বলেন মঈন খান। গত ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার পরে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে মতভেদ দেখা যাচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বলছেন নতুন কোন রাজনৈতিক দল আসতে চাইলে সেটিকে তারা সাধুবাদ জানাবেন। বিষয়টি নিয়ে তাদের চিন্তার কোন কারণ নেই। এখন নতুন কেউ যদি আসে, সেটা তো তাদের ডেমোক্রেটিক রাইট, সাংবিধানিক রাইট। আমরা মনে করি না যারা দীর্ঘদিন যাবত রাজনীতি করছেন, তাদের জন্য কোন নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটলে কোন চ্যালেঞ্জের কারণ হবেনা।
জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, জোট একসময় ছিল। সে সময় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জোট হয়েছিল অপশক্তির হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করার জন্য। এখন যেহেতু সেই অপশক্তি ক্ষমতায় নেই, সংগত কারণে জোটের কোন প্রয়োজন নেই। যার যে অবস্থান থেকে রাজনীতি করছে। কেউ কাউকে চ্যালেঞ্জ মনে করা বা প্রতিপক্ষ মনে করা ঠিক না।
জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল ও সংগঠনের সাথে রাজনৈতিক মোর্চা গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছে। সে রকম একটি জোট হলে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হবে বলে মনে করছেন অনেকে।
কোন রাজনৈতিক মোর্চা বা নির্বাচনী ঐক্য করার আলোচনা এখনো হয়নি। পরস্পরের সাথে মতবিনিময় করা হচ্ছে। ঐক্যটাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে জামায়াতে ইসলামী কোন তাড়াহুড়া করতে চাইছে না। অনেকে মনে করছেন, নির্বাচনের জন্য যত বেশি সময় পাওয়া যাবে জামায়াত তত বেশি নিজেদের গুছিয়ে এনে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করবে। সেক্ষেত্রে বিষয়টি জামায়াতকে রাজনৈতিক সুবিধা দেবে নির্বাচনে।
আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে আলেমদের উপর নানাভাবে প্রহার করা হতো। ওয়াজ মাহফিল গুলোতে প্রশাসনের অনুমতি নিতে হতো। বেধে দেয়া হতো সময় সীমা এবং বিষয় বস্ত। প্রায় বিশ হাজার আলেম বিনা দোষে জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এখন আলেম সমাজ তাদের উপর বর্বর নির্যাতনের কথা বিভিন্ন ধর্মীয় সভায় জানান দিচ্ছেন। যেভাবে নির্মমতা এবং নিষ্ঠুরতা দেখানো হয়েছে তা শুনলে মানুষের শরীরের লোম শিহরে উঠছে। আলেমরা হচ্ছেন নায়েবে রাসূল। পতিত সরকার আমলে যেসকল আলেমগণ নির্যাতন, নিপীড়ন ও জেল-জুলুম এর শিকার হয়েছেন তাদের সংক্ষিপ্ত নামের তালিকা হচ্ছে, মুফতি আমির হামজা, মাওলানা শায়খ আহমাদুল্লাহ, মুফতি রেজাউল করীম (পীর চরমোনাই) ড: এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী, মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী, মাওলানা হাফিজুর রহমান সিদ্দিকী, প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান, মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী,শাইখুল হাদিস আব্দুল হাই (পাহাড়পুরী), মুফতি ইমরান হুসাইন কাসেমী, মুফতি লুতফুর রহমান ফরায়েজী, মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী, মুফতি রফিকুল ইসলাম সিরাজী, আব্দুল্লাহ আল আমিন, মাওলানা তারেক মনোয়ার,আব্দুল হাই মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ, মুফতি আব্দুল কুদ্দুস, মুফতি আলী আকবর সিদ্দিকী, মাওলানা খোরসেদ আলী কাসেমী। মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব। মাওলানা মুজিবুর রহমান, আল্লামা ড: মোস্তাক আহমেদ, মাওলানা আজিজুল ইসলাম জালালী, মাওলানা মেরাজুল হক কাসেমী,মাওলানা আব্দুল বাসেত খান, মুফতি মুহসিনুল করিম, মাওলানা আব্দুল খালেক সাহেব, মুফতি মাহমুদ উল্লাহ আতিকী, মুফতি উসমান গনি (মুছাপুরি) মাওলানা আবু নাঈম মো: তানভীর, মুফতি শাহাবুদ্দিন, মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা জাকারিয়া, মুফতি আমজাদ হুসাইন আশরাফী,মুফতি আনোয়ার হোসাইন চিশতী মাওলানা আতিকুল্লাহ, মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী,মাওলানা হাবিবুর রহমান,মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ, মাওলানা কামরুল ইসলাম সাঈদ, ক্বারী আব্দুর রহীম আল মাদানী, ড.আবুল কালাম আজাদ বাশার,মাওলানা রফিকুল্লাহ আফসারী, মাওলানা শুয়াইব আহমদ আশ্রাফী,মাওলানা ইসমাঈল বুখারী,মোশতাক ফয়েজী( পীর সাহেব), ক্বারী সাইদুল ইসলাম আসাদ, মুফতী ওয়ালীউল্লাহ, মাহমুদুল হাসান (ফরিদপুরী),মাওলানা নূরে আলম সিদ্দিকী, মাওলানা হাফিজুর রহমান সিদ্দিকী (কুয়াকাটা), মুফতি ইলিয়াছুর রহমান জিহাদী, তবে ইলিয়াছুর রহমান বিভিন্ন ধমীয় সভায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শাশুরি দাবী করতেন । এটি নিয়েও আলেম সমাজের মধ্যে অলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। মুফতি সাঈদ আহমেদ( কবি), আর সাঈদ আহমেদের বিরুদ্ধে প্রয়ত আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির দাবী করেছিলেন সাহবাগ মঞ্চে গিয়ে। তার বিষয়টিও সামনে এসেছে। মাওলানা বজলুর রশিদ, আরিফ বিন হাবীব, মাওলানা নাসির উদ্দিন যুক্তিবাদী, ক্বারী আহমদ বীন ইউসুফ, মাওলানা নূরে আলম সিদ্দিকী, জুবায়ের আহমাদ তাশরীক, গোলাম রব্বানী, মাওলানা বেলায়েত হোসেন, মুফতি ওবায়দুল্লাহ আনসারী, আল্লামা শায়েখ সাকিবুর রহমান,মাওলানা মুবারক উল্লাহ, মুফতি রাফি বিন মুনির সহ শত শত ওলামায়ে কেরাম। আন্তর্জাতিক মানের এসকল আলেম আওয়ামী সরকার আমলে ধর্মীয় সভায় মন খুলে কথা বলতে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। সভা মঞ্চে উঠার আগেই বাতিয়ে দেয়া হতো রাজনৈতিক কথা বললে সমস্যা হবে। বিভিন্ন সময়ে অনেক বক্তা বক্তৃতা দিতে গিয়ে মঞ্চে অপমানিত হয়েছেন। এখন এসব ওলামায়ে কেরাম নির্দ্বিধায় আল্লাহর কোরআন ও রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিস এবং সুন্নাহর উপর আলোচনা (বয়ান) করছেন। প্রতিজন আলেম বক্তৃতা মঞ্চে উঠেই ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার আহবান জানাচ্ছেন। ধর্মপ্রাণ মুসলমান আলেমদের কথায সাড়াও দিচ্ছেন। এখন ধর্মসভা গুলোতে প্রয়াত আল্লামা দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর বিষয়েও বক্তারা বলছেন। বিগত দিনে আলেমদের মধ্যে সমন্বয়ের যে অভাব ছিলো তা অনেক টাই গুছিয়ে উঠছেন আলেম সমাজ। দেশের এহেন পরিস্থিতিতে অধিকাংশ আলেম বক্তৃতা মঞ্চে নিজেদের ঐক্যের ডাক দিচ্ছেন। ইসলামী দল গুলো নিজেদের মধ্যে ভ
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.