February 24, 2025, 1:39 am


বিশেষ প্রতিনিধি:

Published:
2024-10-08 10:49:34 BdST

শ্বশুর-জামাই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্তপূর্বক আইনী ব্যবস্থা নেয়ার দাবী রেল কর্মচারীদেররেলওয়ের আলোচিত সেই জামাই মামুনুল রেল পশ্চিমাঞ্চলের জিএম


  • চারজন সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে পতিত সরকারের প্রভাবশালী এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে খ্যাত মামুনুলের নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

 

  • রেলওয়ে কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ ও নানা ধরণের প্রশ্ন দানা বেঁধেছে। মামুনুলকে নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই মন্ত্রণালয়ে

রেলওয়ের আলোচিত সেই জামাই মামুনুল ইসলাম রেলের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, চারজন সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে পতিত সরকারের প্রভাবশালী এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে খ্যাত মামুনুলের নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনার ঝড় উঠেছে। রেলওয়ের কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ ও নানা ধরণের প্রশ্ন দানা বেঁধেছে। মামুনুলকে নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। তিনি খুব দ্রুত আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিপন্থী বনে গেছেন। তার বিষয়ে কেউ জানতে চাইলে তিনি প্রশাসনের উর্দ্ধতন ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার এবং বিএনপির প্রভাবশালী একজন নেতার দোহাই দিচ্ছেন।

বিএনপির ওই নেতার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মামুনুল ইসলাম নামে কাউকে আমি চিনিনা। আওয়ামী লীগ সকল সেক্টরের বারোটা বাজিয়ে গেছে। তাদের দোসররা এখন বাঁচার জন্য নানাভাবে ফন্দি ফিকির করছে।

এদিকে মামুনুলের শ্বশুর সাবেক রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আমজাদ হোসেনের সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই বলে জানান রেলের সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত জিএম মামুনুল ইসলাম।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর ধানমন্ডির ১৫নং সড়কের তমা প্রেসিডেন্সি টাওয়ারে শ্বশুর-জামাই মিলে সাড়ে ৪৭০০ স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট তৈরি করে ৯৪০০ হাজার স্কয়ার ফিটের দুইটি অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট ক্রয় করেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। দুটি ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজারমূল্য রয়েছে ১৮/১৯ কোটি টাকা। এছাড়াও নামে বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন জামাই-শশুর।

বিগত ৫ই আগষ্টের পর রেলওয়ের সাবেক ডিজি আমজাদ হোসেন গা-ঢাকা দিয়েছেন। শুধুমাত্র জামাই মামূনুল ইসলাম এবং মেয়ে ছাড়া কেউ বলতে পারবেন না তিনি কোথায় আছেন। মামুনুল ইসলাম নিজেও নিয়মিত বাসায় থাকেন না। নিজের ভেতরে অতীতের দুর্নীতি-অনিয়মের কথা কেউ না বললেও ভয় কাজ করছে। তার বিরুদ্ধে যাতে কোন পত্রিকা, নিউজ পোর্টাল ও টিভিতে সংবাদ প্রকাশিত না হয় তা নিয়েও ভয়ের মধ্যে আছেন।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মামুনুল ইসলাম রেলে একক আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। শশুর আওয়ামীপন্থী এবং গণভবনে ভালো যোগাযোগ থাকায় তারা সব কিছুই থোড়াই কেয়ার করতেন। একচেটিয়া প্রভাব খাটিয়ে টেন্ডার, বদলি, নিয়োগ, প্রকল্প পাশ এবং সাজা পাওয়া কর্মচারীদের টাকার বিনিময়ে সাজা মওকুফ থেকে শুরু করে সবই ছিলো এই জামাই-শ্বশুরের দখলে।

২০১৫ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে তিন বছর আট মাস রেলের ডিজি ছিলেন মো. আমজাদ হোসেন। মামুনুল শ্বশুরের খুঁটির জোরে ওই সময়ে বিভিন্ন প্রকল্পের মেয়াদ বর্ধিত এবং নিজেই কনসালটেন্সির কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তবে কাগজে কলমে কোন কাজে থাকতেন না। এসব করে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন তিনি। মামুনুলের অবৈধ কর্মকান্ড দেখে তাকে সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বদলিও করেছিলেন। সাবেক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার সাথে মামূনুলের ছিলো গভীর সখ্যতা। বিষয়টি ছিলো ওপেন সিক্রেট। রেলের ছয়টি বিভাগের পরিবহন, সিগন্যাল ও টেলিকম, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, যান্ত্রিক, সেন্টার ও বৈদ্যুতিক বিভাগ ছিলো খুবই অবহেলিত। উক্ত সরকারের আমলে ৭৬টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। এরমধ্যে ৫০টি ছিলো সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের। আর এই প্রকল্পের ৮৫ শতাংশ কাজ দেয়া হয়েছিল ম্যাক্স লিমিটেড সহ তাদের পছন্দমত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে।

অভিযোগে প্রকাশ, আওয়ামী সরকারের আমলে মামুনুল ইসলাম সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে রেল ভবনে এক সভায় সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক মামুনুল ইসলামকে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলে বদলি করেন। কিন্তু ডিজির জামাতা হওয়ার সুবাদে ওই বদলি বাস্তবায়ন হয়নি।

আরো অভিযোগ হচ্ছে, বদলির বিষয়ে মামুনুলের কাছে সব কর্মকর্তা গিয়ে ধর্ণা দিতেন। একজন প্রধান প্রকৌশলী বদলি করতে তার রেট ছিলো ৪০ লাখ, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ৩০ লাখ, বিভাগীয় প্রধান প্রকৌশলী ১৫ লাখ টাকা। ঘুষের টাকার কোন নথিপত্র তিনি রাখতেন না। এছাড়াও বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্য ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে ঘুষ নিতেন মামুনুল ইসলাম। শ্বশুর ডিজি থাকা অবস্থায় শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন জামাই-শশুর সিন্ডিকেট।

এই অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওই সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ জমা পড়েছিলো। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হেসেনের তদবিরে তা ধামাচাপা পড়ে যায়। মামুনুল ইসলাম সরকারি অর্থ তসরূপ করে অসংখ্যবার বিদেশ সফর করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তবে মামুনুল ইসলামের দাবি তার চেয়ে জুনিয়ররা আরো বেশি বিদেশ সফর করেছেন।

এক অনুসন্ধানে জানা যায়, জামাই-শ্বশুরের ইচ্ছায় রেল ভবন পরিচালিত হতো। তাদের দু’জন ছাড়া রেলে কোন কাজ হতো না। বদলি, পদোন্নতি, বিদেশ সফর, টেন্ডারসহ সব কিছুতেই তাদের হাত থাকতো। সাহস পেতেন না কেউ শ্বশুর-জামাইয়ের বিরুদ্ধে মুখ খোলার।

রেলওয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, মামুনুল ইসলাম তার শশুরের আমলে পদোন্নতি নেননি এর কারণ হচ্ছে তদবির বাণিজ্য। তবে মামুনুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে সব ধরণের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

তিনি ফোনে বলেছেন, বিগত সরকারের আমলে আমি নির্যাতিত ছিলাম। আমার সাথে শ্বশুরের সম্পর্ক ভালো ছিলোনা। তবে অপর একটি সূত্র মতে, শ্বশুর-জামাই ছিলেন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ওই সময়ে শ্বশুর মিডিয়ার কাছে জামাইয়ের সব অভিযোগ নিজের ঘাড়ে নিয়ে কথা বলতেন। বলতেন মামুনুল ইসলাম সৎ, ভদ্র ও পরিশ্রমী। ৫ই আগষ্টের পর তারা যোগসাজস করে বাঁচার জন্য নানা অজুুহাত দেখাচ্ছেন। বলে বেড়াচ্ছেন কারো সাথে কারো যোগাযোগ নেই। সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই খারাপ।

সূত্রমতে, রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক মো. আমজাদ ছিলেন পতিত সরকারের প্রেতাত্না। তিনি তিন বছর আট মাসে রেলওয়ের সকল সেক্টরে জামাই-শ্বশুর সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। এর জের টানতে হচ্ছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে।

আমজাদ হোসেন গ্রেফতার এড়াতে বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। কথা বলার জন্য তার ধানমন্ডির বাসায় একাধিকবার গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি কোথায় আছেন নাকি বিদেশ পালিয়ে গেছেন তাও জানা যায়নি।

মেয়ের জামাই মামুনুল ইসলাম জানিয়েছেন, শ্বশুরের সাথে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। তবে বাসার পাশেই একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পরিবারটি অহংকারী। তারা পতিত সরকারের আমলে কাউকেই সম্মান ইজ্জত করতেন না। ক্ষমতার দাপট দেখাতেন সব সময়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে মামুনুল ইসলাম ছিলেন সক্রিয়। নগদ টাকা খরচ করে আন্দোলন ঠেকাতে তৎপর ছিলেন তিনি। এখন নতুন করে বিএনপি সাজার পায়তারা করছেন। মামুনুল ইসলামের মুখোশ এতো তাড়াতাড়ি বদলে যাবে তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনার ঝড় উঠলেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। উপরন্তু তার পদোন্নতি পেতে সার্বিক সহযোগিতা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

মামুনুল ইসলামের জিএম পদে পদোন্নতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) সরদার শাহাদৎ হোসেন বলেন, তার অনিয়ম দুর্নীতি সম্পর্কে আমার জানা নেই। তবে বলছেন যখন খতিয়ে দেখা হবে।

মামুনুল ইসলামের পরিবার ও তার সন্তানেরা দেশের বাইরে থাইল্যান্ড বসবাস করেন বলে জানা গেছে। সন্তানেরা থাইল্যান্ডে পড়ালেখা করে। যার ব্যয়ভার অনেক টাকা। রেলওয়ের একজন জেনারেল ম্যানেজার এর বেতন কত? তিনি ৮/১০ কোটি টাকা মুল্যের ফ্ল্যাটে থাকেন; এই ফ্ল্যাটের টাকা কোথা হতে এসেছে। এই অবৈধ আয়ের উৎস কি? এছাড়াও নামে-বেনামে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ রয়েছে দেশে ও দেশের বাইরে।

আপাদমস্তক একজন সুফী ভদ্রলোক এই মামুনুল ইসলাম। মামুনুল ইসলাম ও তার শ্বশুর যে বিল্ডিং এর ফ্ল্যাটে থাকেন উক্ত বিল্ডিংটি তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর। তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানী বাংলাদেশ রেলওয়ের বড় ঠিকাদার। তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর কাছ থেকে হয়তো অবৈধ সুবিধা নিয়ে জামাই শ্বশুর ফ্ল্যাট বাগিয়ে নিয়েছেন তা না হলে কি আর অবৈধভাবে অর্জিত টাকা দিয়ে ৪৭০০ × ২ = ৯৪০০ স্কয়ারফিটের ফুটবলের মাঠ বানানো যায়?

কি সেই আলোদিনের চেরাগ তা দুদক খতিয়ে দেখলে তার অবৈধ আয়ের উৎস বেড়িয়ে আসবে। পতিত সরকারের দোসর এই শ্বশুর-জামাই সিন্ডিকেটের সকল দূর্নীতি-অনিয়ম তদন্তের দাবি জানিয়েছেন রেলওয়ের সাধারন কর্মচারীবৃন্দ।

উল্লেখ্য যে, পতিত সরকারের একাধিক বড় বড় নেতা ও এমপি উক্ত প্রেসিডেন্সি ট্যওয়ারে বসবাস করেন। সপরিবারে সন্তানেরা দেশের বাইরে পড়ালেখা করে ও বসবাস করে। এত টাকার উৎস কোথায়? বাংলাদেশ রেলওয়ের মুখোশধারী কালো বিড়ালদের একজন এই জামাই-শ্বশুর সিন্ডিকেট।

দ্যা ফিন্যান্স টুডের চলমান বিশেষ অনুসন্ধানে আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব। ধারাবাহিকভাবে জামাই ও শ্বশুরের বিস্তারিত অবৈধ কর্মকান্ড ও সম্পদের বিবরনী প্রকাশিত হবে।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.