আবু তাহের বাপ্পা
Published:2024-10-15 11:09:42 BdST
হাসিনা সরকারের আশীর্বাদপূষ্টএলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাবেদ যেন টাকার মেশিন
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সরকারি চাকরি যেন টাকা কামানোর মেশিনে পরিণত হয়েছিল। অনুসন্ধান ও তদন্তে জানা গেছে, বিভিন্ন দপ্তরের রাঘববোয়ালদের সম্পর্কে। পতিত সরকারের আমলে বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তাদেরই একজন জাবেদ করিম। বর্তমানে তিনি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সড়ক ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিট) পদে কর্মরত আছেন ।
এক অনুসন্ধানে জানা যায়, সারা দেশে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্মাণ করা সড়ক সেতুর চিত্র হচ্ছে অনেক জায়গায় সেতু আছে তো রাস্তা নেই, আবার রাস্তা থাকলেও ব্যবহারের উপযোগী নয়। সড়ক সেতু রক্ষণাবেক্ষণের কিছু হোক আর না হোক, জাবেদ করিমের ভাগ্যে টাকার মেশিন ঘুরছে শত কিলোমিটার গতিতে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সুবিধা নেওয়া জাবেদ করিম এখন নিজেকে বিএনপি পরিবারের সদস্য বলে পরিচয় দিচ্ছেন। অথচ তিনি পতিত সরকারের একজন দোষর ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগ কোন দিন করেননি বলে দাবি করছেন। নিজেকে বঞ্চিত বলেও জানান দিচ্ছেন। আর যে অবৈধ সম্পদ করেছেন তা তিনি অস্বীকার করেছেন। দাবি করেছেন, শুধু বনানীতে তার বাবার একটি বাড়ি আছে।
জাবেদ করিমের সম্পদের হিসাবের বিবরণ দিয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা মো. আরমান হোসেন। সেই অভিযোগ থেকে তার বিস্ময় জাগানো সম্পদের ফিরিস্তি পাওয়া গেছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় আগারগাঁওয়ে দায়িত্ব নেয়ার পর বেপরোয়া হয়ে যান জাবেদ করিম। তার টাকা তৈরির মেশিন ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মো. জাহিদ হোসেন চৌধুরী। জাহিদের সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারা করে সম্পদের পাহাড় গড়েন জাবেদ। শুধু তাই নয়, গণভবন কেন্দ্রিক তার ছিলো অবাধ বিচরণ। শেখ হাসিনা পালানোর আগে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে জাবেদ সিন্ডিকেট হাসিনার নিজস্ব তহবিলে কোটি কোটি টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জাবেদ সিন্ডিকেট আগারগাঁও, মিরপুর, মোহাম্মদপুর এলাকায় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে কয়েক কোটি টাকা দিয়েছেন বলেও অভিযোগ জানা গেছে। সূত্রমতে, হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখতে জাবেদ সিন্ডিকেট টাকা সহ বিভিন্ন ভাবে উৎসাহিত করেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এলজিইডির সড়ক ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকাকালে জাহিদের সহায়তায় বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক এবং জেলায় নির্বাহী প্রকৌশলী পদায়নে ছিল বিশাল বাণিজ্য। অভিযোগ রয়েছে, পদভেদে ৫০ লাখ থেকে কোটি টাকার বেশি নিতেন জাবেদ-জাহিদ মিলে।
আরমান হোসেনের অভিযোগ ছাড়াও এলজিইডির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছ থেকেও জাবেদ করিমের অবৈধ সম্পদের কিছুটা আভাস পাওয়া গেছে। এলজিইডির কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাবেদ করিম কাউকেই পাত্তা দিতেন না। বদলি কিংবা প্রকল্পের পরিচালক হতে হলে টাকা দিতে হতো। সেই টাকার ভাগ যেত মন্ত্রীর এপিএস জাহিদের কাছেও।
জাবেদ করিমের কোথায় কী সম্পদ এবং কিভাবে টাকার পাহাড় গড়েছেন তার বিবরণ তুলে ধরা হলোঃ এলজিইডির মুন্সীগঞ্জ জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালে প্রতিটি কাজের জন্য তিনি ২ শতাংশ করে ঘুষ নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তখন সেখানে শতকোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। সেই সময় তার ১ লাখ ২৮ হাজার ৫৪৯ টাকার অডিট আপত্তি রয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় তিনি টাকা নয়ছয় করতেন। এরপর বহুমুখী দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র প্রকল্পের (এমডিএসপি) পরিচালক থাকাকালে প্রায় শতকোটি টাকা লোপাট করার অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর গুলশান ১-এর ১৩০ নম্বর সড়কের ১১/বি-এর আশক্স আমারি ওয়ে ডেভেলপার্স এলটিডির পাশে ৩০ কাঠা জমির ওপর বিশাল গ্যারেজ রয়েছে জাবেদ করিমের। গ্যারেজটির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় শতকোটি টাকা। এ ছাড়া উত্তরা, বনানী, মিরপুরে রয়েছে তার আলিশান বাড়ি ও ফ্ল্যাট। তার বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। বনানীর ২৫/এ সড়কের ৫৫ নম্বর বাড়িটি তার। এই বাড়ি নির্মাণে প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রগতি সরণির শহিদ আব্দুল আজিজ রোডের ৩০ কাঠার ৪৮নং প্লটটিও তার। প্লটটি তিনি কিনেছেন প্রায় শতকোটি টাকা দিয়ে। সেখানে পেইন টেকিং অটোমোবাইলস নামে গ্যারেজ ভাড়া দিয়েছেন। পূর্বাচলের ৩ নম্বর সড়কের ৬৫ নম্বর প্লটটি ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা দিয়ে স্ত্রীর নামে ক্রয় করেছেন। গাজীপুর চৌরাস্তা সংলগ্ন ৮ নম্বর রোডের ৭৫ নম্বর বাড়িটিও তার। এই বাড়িটি তিনি ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকায় কিনেছেন। উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সড়কের ৩৬ নম্বর বাড়িতে ৩২০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার মূল্য ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। এ ছাড়া আফতাবনগরের ২ নম্বর সড়কের ৯৮ নম্বর প্লটটিও স্ত্রীর নামে কিনেছেন ১০ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়ে। বসুন্ধরা আবাসিকের ডি ব্লকে ৭ নম্বর সড়কের ৬৯ নম্বর প্লটটি ৪০ কোটি টাকা দিয়ে কিনেছেন। সেখানে ৮ তলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ৯ নম্বর রাস্তার ৩৬ নম্বর বাড়িটি ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকায় কিনেছেন। কেরানীগঞ্জের ৬ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাড়িতে ৩৫০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনতে ব্যয় করেছেন ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর ই ব্লকের ৩ নম্বর সড়কের ৩৩ নম্বর প্লট ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকায় কিনেছেন। ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে ৪ নম্বর সড়কের ৮৫ নম্বর প্লটটি স্ত্রীর নামে কিনেছেন ২ কোটি ৯০ লাখ টাকায়।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে জাবেদ করিম মিডিয়াকে বলেন, ‘শুধু বনানীর ২৫/এ সড়কের ৫৫ নম্বর বাড়িটা আমার বাবার সম্পদ। এটাতে আমরা ছোট থেকেই থাকি। সেই ১৯৭১ সাল থেকেই রয়েছি। আর যেসব বাড়ির কথা বলা হয়েছে, সেগুলো অনুসন্ধান করে দেখুন। রাজউকে আমি আবেদন করেছিলাম, পাইনি। এটা রাজউকে খোঁজ নিলেই জানা যাবে। এ রকম অভিযোগ প্রতিদিন দুই-একটা পাচ্ছি। প্রধান প্রকৌশলী ১৭ অক্টোবর অবসরে যাবেন। এখন আমার সিরিয়াল ৭ নম্বরে। তার পরও কেন এমন অভিযোগ বুঝতে পারি না।’
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, কয়েকজন কর্মকর্তাকে ডেঙ্গিয়ে জাবেদ করিম প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এ জন্য তিনি বিভিন্ন দপ্তরে তদবির চালাচ্ছেন।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.