বিশেষ প্রতিবেদক
Published:2024-11-17 16:06:52 BdST
নিয়োগ-পদোন্নতি-বদলী বাণিজ্য ও ব্যাংক ঋণ পুণ: তফসিলের মাধ্যমে লোপাট শতকোটি টাকাব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাষ্টারমাইন্ড আতাউর রহমান এখনও অধরা
• ব্যাংক ঋণ ও পুন: তফসিলে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পতিত সরকারের দোসরদের অবৈধ সুবিধা দিয়ে ব্যাংকখাতকে দেউলিয়ায় রুপান্তর
• এমপি ও মন্ত্রী হওয়ার খায়েশে দুহাতে কামিয়েছে টাকা
• রূপালী ব্যাংকে নিয়ম নীতির বাইরে বিজ্ঞপি ছাড়াই চার শতাধিক জনবল নিয়োগ দিয়ে রূপালী ব্যাংককে “উত্তরবঙ্গের সমিতি” বানিয়েছে
• সোনালী ব্যাংক ইউকে শাখার দুর্নীতির বিচার না হয়ে উল্টো পেয়েছেন পদোন্নতি
• ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচনে ৪ কোটি টাকার অধিক খরচ করেছে। এক্ষেত্রে ব্যাংক ও ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতকে জিম্মি করেছে।
• এখনও অধরা পতিত সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এই দুর্নীতিবাজ ব্যাংকারের সহযোগী ও ঋণখেলাপী ব্যবসায়ীরা
• করোনা মহামারীর সময়ে ব্যবসায়ীদের প্রনোদনা সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে মাসোহারা আদায়ের অভিযোগ
বাংলাদেশের ব্যাংকিংখাতে যার দ্বারা সবচেয়ে বেশী অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে তিনি হচ্ছেন আতাউর রহমান প্রধান। এই ব্যাংকার হচ্ছেন পতিত ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বেশী সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি।
৩৭ বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে সর্বশেষ রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের আসনে বসে তিনি ব্যাংকিং খাতকে সবচেয়ে বেশী কলুষিত করেছেন এবং আর্থিক খাতকে করেছেন পর্যুদস্ত।
সোনালী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক লি: এ ৩+৩=৬ বছর মেয়াদে পতিত আওয়ামী ব্যবসায়ীদের ব্যাংকি খাতকে দুর্নীতি ও লুটপাটের অভয়ারণ্যে পরিনত করেছিলেন আতাউর রহমান প্রধান। সোনালী ও রূপালী ব্যাংকে খেলাপী ঋনের সিংহভাগ দুর্নীতিবাজ এই ব্যাংকারের সময়ে সংগঠিত হয়েছে। মূলত: আওয়ামী ব্যাংক লুটেরাদের পুর্নবাসিত করতেই এই দুর্নীতিবাজ ব্যাংকারকে বার বার প্রমোশন দেওয়া হয়েছে।
আতাউর রহমানের অতীত রেকর্ড
২০১২ সালের মার্চ থেকে ২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংকের ইউকে লিমিটেডের শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তার সময়ে অনিয়ম, দুর্নীতি আর পরিচালন ব্যর্থতার জন্য বন্ধ হয়ে যায় ব্যাংকটি। ঐ সময় একের পর এক দুর্ঘটনা ও আর্থিক অপরাধ সংগঠিত হয় ব্যাংকটিতে।
বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২রা জুন ব্যাংকটির ওল্ডহাম শাখা থেকে কোড জালিয়াতির মাধ্যমে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার হাতিয়ে নেয়া হয়। এর পর ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর শাখাটি বন্ধ করে দেয় ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। ২০১০ সালের ২০ আগস্ট থেকে ২০১৪ সালের ২১ জুলাই সময়ে অর্থ পাচার প্রতিরোধ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডকে ৩২ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড জরিমানা করে যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফাইন্যান্সিয়াল কাউন্ট অথরিটি। (এফসিএ)। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ৩৫ কোটি টাকারও বেশি। এছাড়াও শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্বে অবহেলা, সুপারভাইজারি ঘাটতি, অব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য কারনে যুক্তরাজ্যের এফসিএ কর্তৃক ৭৬ হাজার ৪০০ পাউন্ড জরিমানার মুখে পড়ার বিষয়টি অনেক বিলম্বে প্রকাশ করা হয়।
এতো ঘটনা ঘটলেও পতিত ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট দুর্নীতিপরায়ণ ব্যাংকার আতাউর রহমান প্রধানকে পদোন্নতি দিয়ে ২০১৬ সালের আগষ্টে রূপালী ব্যাংকের এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুসারে, কোন আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক ব্যাংক কর্মকর্তা শাস্তিপ্রাপ্ত হলে তিনি কোনও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা হতে পারবেন না। এই বিধিমালা থাকা সত্ত্বেও কিভাবে এবং কোন কর্তৃপক্ষের সুপারিশে আতাউর রহমান প্রধানকে রূপালী ও সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা করা হলো তা এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।
দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক অথবা ব্যাংকিংখাতের দুর্নীতি প্রতিরোধে আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করে এসব দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবী উঠেছে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার কমিশনের কাছে।
রূপালী ব্যাংকে দুর্নীতির চিত্র ও অবৈধ নিয়োগ
২০১৬ সালের দুর্নীতিবাজ আতাউর রহমান প্রধান রূপালী ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদান করেই নেমে পড়েন দুর্নীতির মহাযাত্রায়। ২০১৬-২০১৯ মেয়াদে রূপালী ব্যাংকটি হয়ে উঠে উত্তরবঙ্গের দালালী প্রতিষ্ঠান।
২০১৬-২০১৯, এই তিন বছর ব্যাংকিং নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই প্রায় ৪০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয় যার অধিকাংশই উত্তরবঙ্গের। কারণ একটাই, আতাউর রহমান প্রধানের বাড়ী লালমনিরহাট জেলায়।
আতাউর রহমানের রূপালী ব্যাংকে কর্মকালীন সময়ে বিনা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পিয়ন, ক্যাশিয়ার, ঝাড়ুদার থেকে শুরু করে জুনিয়র অফিসার পদে প্রায় ৪০০ ব্যক্তিকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। উক্ত নিয়োগের প্রতিটিতে পদ অনুসারে ২ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন আতাউর রহমান।
রূপালী ব্যাংকে উক্ত নিয়োগে কোন ব্যাংকিং নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা তিনি করেননি। শুধু তাই নয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রেও উত্তরবঙ্গের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
আতাউর রহমান প্রধান ২০১৬ সালে রুপালী ব্যাংকের যোগদানের সময় ব্যাংকের ঋণ ছিলো ১৫ হাজার ৪০০ ২১ কোটি টাকা। আর খেলাপির পরিমাণ ছিলো ২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। আতাউর রহমানের মেয়াদকালে ২০১৯ সালের জুনে এই ঋণ দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এসময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয় ৪ হাজার ৩১১ কোটি টাকা।
রূপালী ব্যাংকে কর্মকালীন সময়ে আতাউর রহমানের দুর্নীতি ছিলো ভয়াবহ। তার নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের প্রতিটি কর্মকর্তা এখন বিভিন্ন ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছে। সোনালী, জনতা, কৃষি সহ বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষ পদে রয়েছে আতাউর সিন্ডিকেটের সদস্যরা। তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতি চোখে পড়ার মত।
সোনালী ব্যাংকে কর্মকাল ও উত্তরবঙ্গ সিন্ডিকেট
২০১৯-২০২২ সাল মেয়াদে সোনালী ব্যাংকে দুর্নীতির যে ভয়াবহতা সৃষ্টি হয়েছিল তার নেপথ্য নায়ক আতাউর রহমান প্রধান। করোনা মহামারিকালীন সময়ে আতাউর রহমান প্রধান ব্যাংকিং খাতে করোনা প্রনোদনার নামে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করেছেন।
আতাউর রহমান প্রধান সোনালী ব্যাংকেও উত্তরবঙ্গের যে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন তার প্রধান কারণ ছিল নিজের মন্ত্রী হওয়ার খায়েশ। তিনি বিগত ফ্যাসিষ্ট সরকারের আওয়ামী লীগের অর্থ পরিচালনা উপ-কমিটির সদস্য ছিলো। তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লালমনিরহাট-১ (হাতীবান্ধা পাটগ্রাম) আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। প্রার্থী বাছাইপর্বে প্রথমে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয় পরবর্তীতে উচ্চ আদালত থেকে মনোনয়নপত্র ফিরে পান।
উল্লেখ্য যে, দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে উচ্চাবিলাসী দুর্নীতিবাজ এই ব্যাংকার তার অবৈধ উপার্জিত অর্থের গরমে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে পরাজিত হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচনে ৪ কোটি টাকা খরচ
আতাউর রহমান প্রধান সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট নির্বাচনে ৪ কোটি টাকা খরচ করে এবং সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করে।
দুর্নীতি দমন কমিশন তার দুর্নীতির তদন্ত শুরু করলেও তার অর্থ ও দাপটের নিকট থেমে আছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এছাড়াও অর্থ পাচার, ঋণপূর্ণ: তফসিলকরনে কমিশন আদায়ের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
উত্তরবঙ্গ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বদলি-পদোন্নতি বাণিজ্য, সিএসআর বিজ্ঞাপন থেকে নামে বেনামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় দুর্নীতির নব্য এই বরপুত্র আতাউর রহমান ও তার সিন্ডিকেট। অনেক কর্মকর্তাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি ও ভালো পোস্টিং থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অন্যদিকে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিজের আত্মীয়-স্বজনকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ ও বদলি করেছেন আতাউর রহমান।
স্বজনপ্রীতির সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত তার এক ভাগ্নে জামাই এবাব হোসেন। তাকে কোন রকম নিয়মণীতির তোয়াক্কা না করেই সোনালী এক্সচেঞ্জ কোং ইনকঃ, যুক্তরাষ্ট্রী শাখায় পোস্টিং আরেক ভাগ্নে জামাই মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে সৌদি আরবের জেদ্দা শাখায়।
ব্যাংকিং খাতে দুবৃত্তায়ন ও সহযোগীদের অন্যতম কারিগর আতাউর রহমান পতিত সরকারের ব্যাংক লুটেরা চক্রের অন্যতম সহযোগী।
আপাদমস্তক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত এই ব্যাংকারের হাত ধরেই মূলত: দেশের সর্ববৃহৎ সোনালী ও রুপালী ব্যাংকে ধ্বস নেমেছে। পূণঃ তফসিলের নামে আওয়ামী ব্যবসায়ীদের পূর্ণবাসন ও ব্যাংক থেকে টাকা লুটের এই কারিগর এখনো ধরাছোঁয়ার বাহীরে।
সোনালী, জনতা, রুপালী, অগ্রণী, বেসিক ব্যাংক সহ সরকারী বেসরকারী ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানী সহ বীমা খাতের লুটেরাদের আইনের আওতায় আনা খুবই জরুরী।
অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অনিয়মের মাধ্যমে পদোন্নতিপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী। এরাই মূলত পতিত সরকারের দোসর। এই দোসরদের হাতে মোটেই নিরাপদ নয় বাংলাদেশের আর্থিক খাত।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.